শরীরের বাড়তি ওজন কমিয়ে নিয়ে নিজেকে সুস্থ রাখতে কে না চায়? ভালো স্বাস্থ্য, সুস্থ শরীর আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেক ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। একজন সুস্থ মানুষের আত্মবিশ্বাস, একজন অসুস্থ মানুষের আত্মবিশ্বাসের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি হয়।
সমস্যা হচ্ছে, মানুষের খাদ্যাভ্যাসের ধরণের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে অনেক সময়ই সুস্বাস্থ্য ধরে রাখা সম্ভব হয় না। কারো শরীরে মেদ বাড়ে, কারো উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়, কারো আবার অন্যান্য পেটের পীড়া ও শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। তাই এসব ঝামেলার হাত থেকে বাঁচতে অনেকেই ডায়েট কন্ট্রোল করা শুরু করেন। কম খাওয়া, অধিক ক্যালরিযুক্ত খাবার বন্ধ করা, কার্বোহাইড্রেটের সরবরাহ লিমিটেড করে দেয়া এসব তখন হয়ে উঠে নিত্য সঙ্গি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যেসব খাবার যতটা ক্ষতিকর, সেসব খাবার ততটাই লোভনীয়! কার ইচ্ছে করে চোখের সামনে এত লোভনীয় খাবার থাকা সত্বেও কেবলমাত্র মেদ বাড়বে বলে মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে বসে থাকতে?
আপনি চাইলেই এই ধরনের ডায়েটিং বাদ দিয়েও নিজের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখতে পারেন। তার জন্য আপনার কয়েকটি নিয়ম কানুন নিয়মিত অনুসরণ করলেই চলবে। যার ফলে আপনাকে আর বেছে বেছে খাবার খেতে হবে না, আবার স্বাস্থ্যহানি নিয়েও চিন্তা করতে হবে না!
শরীরের বাড়তি ওজন কমিয়ে নিতে কিছু সহজ উপায়
১. প্রচুর পরিমাণে বীজ জাতীয় খাবার গ্রহণ
গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত পরিমাণ বীজ জাতীয় খাবার যেমন মটরশুঁটি, ডাল এগুলো হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং ক্যান্সারের মত রোগ প্রতিরোধে অনেক বড় ভূমিকা রাখে। তাই ডায়েট করতে না চাইলে প্রচুর পরিমাণে মটরশুঁটি, বিভিন্ন রকমের ডাল, ছোলা, শিমের বিচি এগুলো খেতে পারেন। এই খাবারগুলো শরীরের বাড়তি ওজন কমিয়ে নিতে সহায়কও বটে!
২. কার্বোহাইড্রেটের রেগুলার ডোজ, বারবার
কার্বোহাইড্রেট আপনার শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান। তাই খেয়াল রাখবেন হাজারো খাবারের ভিড়ে যাতে কার্বোহাইড্রেট বা শর্করার ঘাটতি না পড়ে। সাধারণত শস্যদানা এবং অধিকাংশ সবজিতে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ বেশি থাকে। তাই শর্করার জন্য যেসব খাদ্য উপাদান এবং সবজি আপনি ব্যবহার করতে পারেন-
গম (আস্ত এবং ভাঙ্গানো), বার্লি, সাগুদানা, ভাত, পপকর্ণ, কুমড়া, আলু, মিষ্টি আলু, সয়াবীজ ইত্যাদি। এগুলো শরীরের বাড়তি ওজন কমিয়ে নিতে সাহায্য করে।
৩. চর্বিযুক্ত স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করুন
ভাবছেন যেখানে শরীরের বাড়তি ওজন কমিয়ে নিতে চিন্তা করছেন সেখানে চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণের বুদ্ধি দেয়া হচ্ছে কেন? জ্বি না, ভুল শোনেন নি। নির্দিষ্ট পরিমাণে চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ করুন, তবে সেটা অবশ্যই স্বাস্থ্যকর উপাদান দিয়ে প্রস্তুত করা হতে হবে! বাইরের খাবারে যে ধরণের ফ্যাট ব্যবহার করা হয় তা আসলে প্রস্তুতকারক কোম্পানির লাভ চিন্তা করে ব্যবহৃত হয়। কারণ ফ্যাট উপাদানগুলো এমন ভাবেই খাবারে ব্যবহৃত হয় যাতে ব্যাকটেরিয়া, অক্সিজেন এবং অন্যান্য জীবাণু খাবারে প্রবেশ করে খাবারকে নষ্ট করতে পারে এবং খাবার যাতে অক্ষত থাকে। যার কারণে এইসব খাবার পেটে যাওয়ার পর আমাদের হজম ক্রিয়ায় ব্যবহৃত এনজাইমও এই ফ্যাটের স্তর ভেদ করে খাবারের পুষ্টি উপাদান কাজে লাগাতে পারে না। ফলে ওই খাবার আমাদের শরীরের জন্য এক ধরণনের বিষ হয়ে ওঠে। যেহেতু সেই ধরনের খাবার লোভনীয়, সুতরাং সেগুলো গ্রহণ করুন। তবে শরীরের প্রয়োজনীয় চর্বি উপাদানের জন্য সেগুলোর উপর ভরসা করতে যাবেন না। শরীরের চর্বির ঘাটতি পূরণের জন্য যে ধরনের খাবার স্বাস্থ্যকর –
পিচ ফল, বাদাম (সকল ধরনের), প্রাকৃতিক উৎস হতে আহরিত তেল (অলিভ অয়েল, ক্যানোলা, সূর্যমুখীর তেল, বাদাম তেল), বীজ থেকে আহরিত তেল (সয়াবিন তেল, ভুট্টার তেল, রাইস অয়েল), জলপাই, বাদাম থেকে উৎপাদিত মাখন, বীজ (সূর্যমুখী, শিম, কুমড়ার বীজ), বিভিন্ন পদের মাছ, স্বাস্থ্যকর প্রাণীর মাংস (গরু, খাসি অবশ্যই পরিমিত পরিমাণে) ইত্যাদি।
৪. অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ কমিয়ে দিন, সম্ভব হলে বিরত থাকুন
অনেক আগে থেকেই ভাবা হত দুধ আসলে ক্যালসিয়ামের একটি ভালো উৎস। কিন্তু এই ধারণাটি একেবারেই ভুল। আসলে দুধ থেকে ভালো ক্যালসিয়াম পাওয়া যায় এটি প্রক্রিয়াজতকরণ কোম্পানিগুলোর ব্যবসা কৌশল মাত্র। দুধ থেকে আসলে খুব বেশি ক্যালসিয়াম মানুষের শরীরে আসে না। সুতরাং ক্যালসিয়ামের জন্য দুধের উপর ভরসা করা ছেড়ে দিন। এর চাইতে ক্যালসিয়াম যুক্ত শাক সবজি, ফল এগুলোর উপর ভরসা করুন।
এছাড়া রাস্তার পাশের খাবার, ফুড কার্ট এর খাবার গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে দিন। শরীরের বাড়তি ওজন কমিয়ে নিতে এ খাবারগুলো এড়িয়ে চলার বিকল্প নেই। খাবারগুলো বন্ধ করতে বলাটা অন্যায় হবে কারণ এই ধরনের খাবারগুলো বেশিই সুস্বাদু হয়। খাদ্য প্রেমীরা চাইলেও এ ধরনের খাবার থেকে দূরে সরতে পারবেন না। তবুও চেষ্টা করবেন যতটুকু সম্ভব কম গ্রহণ করা যায়।
৫. খাবারে ফলের পরিমাণ বাড়ান
এটা কমবেশি সবাই জানেন যে আমাদের শরীরে প্রতিদিন ১১৫ গ্রাম ফলের চাহিদা রয়েছে। তাই প্রতিদিন খাবারের পর ফল গ্রহণের চেষ্টা করুন। অনেক ফল বেশি দামী হয়ে থাকে, তাই অত্যাধিক খরচ বলে সেগুলো অনেকেই কিনতে চান না। তাদের প্রতি পরামর্শ থাকবে দেশীয় ফল কেনার। এগুলোর দাম কম, গুণে মানেও বিদেশী ফলের সমান। কলা, পেঁঁপে, বরই, পেয়ারা এ ধরনের ফলগুলো সকলের সাধ্যের মধ্যেই কেনা সম্ভব। এ খাবারগুলো খেলে ওজন তো বাড়েই না উল্টো দেহের পুষ্টি চাহিদা পূরণ হয়।
৬. হাঁটুন এবং সাঁতার কাটুন, সাইক্লিং করুন
হাঁটা এবং সাঁতার কাটা আপনার শরীরের রক্ত সঞ্চালন এবং পেশী সঞ্চালনের জন্য বেশ কার্যকরী দুটো ব্যায়াম হতে পারে। তাই প্রতিদিন হাঁটার চেষ্টা করুন। সপ্তাহে অন্তত ১/২ দিন সাঁতার কাটার চেষ্টা করুন। লিফট ব্যবহার না করে সিঁড়িতে চড়ুন। আরো ভালো হয় আপনি চলাচলের জন্য লোকাল যানবাহন ব্যবহার না করে যদি সাইক্লিং করেন। এতে শরীরে চর্বি জমবে না, পর্যাপ্ত ব্যায়াম হবে এবং স্বাস্থ্য ঠিক থাকবে।
৭. শরীরের যত্ন নিন, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকুন
শরীরের ভেতরের অঙ্গগুলোর যত্ন নেয়ার পাশাপাশি বাইরের আবরণের উপরেও দৃষ্টিপাত করুন। শরীর যত সম্ভব পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করবেন। শরীরে ঘাম, ময়লা জমতে দেবেন না। প্রতিদিন অন্তত একবার গোসল করুন। নিয়মিত হাত ধুয়ে রাখুন। খাবারের আগে ও পরে, বাথরুম ব্যবহার করে সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করুন। বাইরের জীবাণু যাতে ভেতরে ঢুকতে না পারে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো থাকলে ওজন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা আরো ভালো ভাবে আপনার কাজে আসবে।
৮. প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন
পানি ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। তাই পর্যাপ্ত পানি পান করুন। দিনে অন্তত চার লিটার পানি গ্রহণের অভ্যাস করুন। বিশেষ করে রাতে ঘুমানোর আগে পর্যাপ্ত পানি পান করবেন। এতে আপনার শরীরে হজম ক্রিয়া খুব ভালোভাবে সম্পন্ন হবে। পর্যাপ্ত পানিপানে ত্বক রুক্ষ হবে না, চেহারায় উজ্জ্বলতা বাড়বে। কিডনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে, শরীর সুস্থ ও সবল থাকবে। শরীরকে সচল রাখে, ফলে ওজন থাকে নিয়ন্ত্রণে।
৯. পর্যাপ্ত ঘুমান
পূর্ণবয়স্ক একজন মানুষের জন্য কমপক্ষে ৮ ঘণ্টা ঘুমানো অত্যন্ত জরুরী। ঘুমের সময় আপনার শরীরের যাবতীয় বৃদ্ধির ব্যাপারগুলো ঘটে থাকে। তাই প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমানোর চেষ্টা করুন। বেশি রাত জাগবেন না, কারণ এতে শারীরিক ক্রিয়াকলাপ বাধাগ্রস্ত হয়। যেদিন কম ঘুমাবেন সেদিন দেখবেন চোখের নিচে কালি পড়েছে। কারণ আপনার শরীরের উপর চাপ পড়ে। ঘুমালে আপনার শারীরিক অনেক ক্রিয়াকলাপ বন্ধ থাকে, যার কারণে সম্পূর্ণ শক্তিই হজম, বৃদ্ধি এইসব কাজে ব্যয় হয়। কিন্তু জেগে থাকলে অন্যান্য কাজে শক্তি ব্যয় হয় বলে শরীরের উপর চাপ পড়ে যায়। তাই প্রতিদিন পর্যাপ্ত ঘুমান। একই সময়ে ঘুমানোর অভ্যাস করুন।
১০. ডাক্তারের পরামর্শ নিন
আপনার শরীর ঠিক আছে কি না, কিংবা খাবার দাবার ঠিকমত হচ্ছে কি না এসব ব্যাপারে নিশ্চিত হতে কিছুদিন পর পর পুষ্টি বিশেষজ্ঞের শরনাপন্ন হতে পারেন। ৬ মাসে অন্তত একবার মেডিক্যাল চেক আপ করান, ডাক্তারের পরামর্শ নিন।শরীরের বাড়তি ওজন কমিয়ে নিতে কিছু সহজ উপায় আজ আপনাদের জানিয়ে দিলাম। ডায়েট কন্ট্রোল করে, উপোস থেকে শরীর বাঁচানোর কী দরকার? জীবন একটাই, সেটাকে উপভোগ করুন। জীবনের যত্ন নিন, জীবন আপনাকে অনেক কিছু উপহার দেবে।
ছবিঃ সংগৃহীত – ফিটনেসউইথএনার্জি.কম, সাটারস্টক