আন্তর্জাতিক কিছু পরিসংখ্যান বলে সারা বিশ্বের শতকরা ৮০ ভাগ কর্মী তাদের কাজ নিয়ে অনাগ্রহী। তাদের ভাষ্যমতে এই কাজ নিয়ে তারা উত্তেজনা, আগ্রহ অনুভব করেন না। কেবলমাত্র বেতন পান এবং করার জন্য করতে হয় বলেই করে থাকেন। ব্যাপারটা আসলেই কিন্তু ঠিক। আপনি যদি আপনার কাজকে ভালো না বাসেন কিংবা পছন্দ না করেন তাহলে সেই কাজে ক্যারিয়ার গড়া অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ।
তাই কর্মক্ষেত্রে ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে চাইলে আগে সেই কাজটিই বেছে নেয়া উচিত যেই কাজ করতে আপনি আনন্দ বোধ করেন। তাহলেই আপনার কাজ করার দক্ষতা ও প্রতিভা বিকশিত হবে এবং আপনি আপনার কাজে আরো সফল ও কর্মক্ষম হতে পারবেন।
পছন্দের কাজ খুঁজে বের করাটাও কিন্তু অতটা সহজ কাজ নয়। একজন উদ্যোক্তা শুরুতেই ভাবতে শুরু করেন যে আসলে কোন কাজে তিনি আনন্দ বোধ করেন, বা কোন কাজ করলে তিনি সহজে করতে পারবেন বা সফল হবেন। এরপর আসে এই কাজে আপনার সফল হওয়ার সম্ভাবনা কতখানি। তারপর আসে কাজটি কীভাবে করবেন এবং সেখান থেকে কীভাবে সফলতা অর্জন করবেন। আজকের লেখায় তার জন্যই কিছু পরামর্শ রইলো।
১. এই ক্ষেত্রে আপনাকে শুরুতেই খুঁজে বের করতে হবে কোন কাজটি আপনি করতে পছন্দ করেন। এক জায়গায় ঠান্ডা ও শান্ত মনে বসুন, তারপর নিজেকে কিছু প্রশ্ন করুন –
- সকালে কীভাবে আপনার ঘুম ভাঙ্গে?
- টাকা পয়সা যদি কোন সমস্যা না হত তাহলে আপনি কোন কাজটি করতেন?
- কোন কাজে আপনার দক্ষতা বেশি?
- আপনি কোন ব্যাপারে জানতে ও কাজ করতে বেশি আগ্রহী?
- কোন কাজ করতে আপনি বেশি আনন্দ বোধ করেন?
- অন্যান্য সফল মানুষের কোন ব্যাপারটিতে আপনি ঈর্ষা বোধ করেন?
২. প্রশ্নের উত্তরগুলো একটা কাগজে লিখুন। এরপর একটি বড় কাজ আপনার করতে হবে। আপনাকে ভেবে বের করতে হবে “সাফল্য” বলতে আপনি আসলে কী বোঝেন? আমাদের সমাজের একটা বড় অংশ ভেবে থাকেন সাফল্য মানে হচ্ছে মাস শেষে একটি বড় অংকের স্যালারি। সুতরাং আপনি একটু ভেবে বের করুন আপনার কাছে সফলতা আসলে কী জিনিস? কারণ আপনি সফলতাকে যেভাবে দেখবেন, আপনাকে ঠিক সেইভাবেই প্রস্তুতি নিতে হবে। যেমন ধরুন, আপনি চান যে আপনার ক্যারিয়ার এমন ভাবে গড়ে উঠুক যেখানে আপনি আপনার সময়ের একটা বড় অংশ পরিবারকে এবং সামাজিকতা পালনে দিতে পারবেন। এইক্ষেত্রে নিজের ব্যবসা শুরু করা একটা ভালো উপায় হতে পারে। কিন্তু ব্যবসা শুরু করার সময় আপনার যে পরিমাণ পরিশ্রম করতে হবে সেটি করতে আপনি মানসিকভাবে প্রস্তুত কি না তা নিয়েও চিন্তা করুন।
৩. এবার আপনি আপনার কার্যক্ষমতা নিয়ে চিন্তা করুন। কারণ অনেক উদাহরণ আছে যে কেউ একজন একটা কাজে ভালো নয়, কিন্তু সেটি কে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। সেই ব্যক্তি কখনোই সফল হবেন না। ডিজাইনিং এ আপনার দক্ষতা ভালো নয় কিন্তু ফ্যাশন ডিজাইনিং কে আপনি পেশা হিসেবে বেছে নিতে চান তাহলে কিন্তু ব্যাপারটা ব্যর্থতায় রুপ নেবে। তাই আগে চিন্তা করুন কোন আইডিয়া গুলো নিয়ে আপনার বেশ ভালো দক্ষতা ও জ্ঞান আছে এবং কোন আইডিয়া গুলো এখনো নতুন এবং মানুষ আগ্রহী হবে। এরপর সেগুলো নিয়ে কাজ করার কথা ভাবা যাবে।
৪. যে কাজে স্বাচ্ছ্যন্দবোধ সবচাইতে বেশি করবেন আইডিয়া গুলো থেকে সেটা বেছে বের করুন। আপনি যেই কাজ করতে শুধু ভালোবাসেন সেটি পছন্দ করার চাইতে যে কাজটি ভালোবাসেন এবং সেই কাজে আপনার দক্ষতা আছে সেটিই বেছে নিন। যেমন আপনি রান্না করতে ভালোবাসেন, ডিজাইন করতেও ভালোবাসেন। কিন্তু দক্ষতা আপনার রান্নায় বেশি, সুতরাং সেটিই আপনি বেছে নিন। কারণ শুধু ভালোবাসেন বলে একটা কাজ শুরু করলে যদি পরে সফল না হোন তবে জিনিসটা থেকে আগ্রহ চলে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।
৫. যদি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন তাহলে সবগুলো আইডিয়াই একবার করে ট্রাই করুন। তবে বাণিজ্যিক ভাবে না করাই শ্রেয়। কারণ শুধু শুধু অর্থ নষ্ট না করে জমিয়ে রাখা উচিত। স্বাচ্ছন্দ্যবোধক কাজ খুঁজে পাওয়ার জন্য শখের বশেই কাজগুলো করুন। ধরুন কিছু একটা রান্না করলেন, কিংবা একটা ড্রেস ডিজাইন করলেন। ভেবে দেখুন কোনটাতে আপনি দক্ষ বেশি এবং কোনটা করতে আনন্দ বেশি লেগেছে। সেটা বেছে নেয়ার চেষ্টা করুন।
৬. আইডিয়া পছন্দ হওয়ার পর এইবার আপনার আইডিয়া নিয়ে একটু রিসার্চ করুন। যদি আপনি একটি ফ্যাশন হাউজ দিতে চান তাহলে কেমন খরচ পড়বে, কী কী উপকরণ লাগবে, কী ধরনের যন্ত্রপাতি লাগবে, বাজার কেমন, বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বী ফ্যাশন হাউজগুলো কেমন ব্যবসা করছে, তাদের কাপড়ের কোয়ালিটি কেমন, ডিজাইন কেমন, তাদের পণ্যে ঘাটতি কী এগুলো খুঁজে বের করুন। তারপর ভাবুন আপনি যে পণ্য আনবেন সেগুলো তে নতুন কী থাকবে যা বর্তমান ব্যবসায়ীরা দিতে পারছে না। এবং সেটা করার জন্য আপনার কী কী নতুনত্ব আনতে হবে সেগুলো নিয়েও গবেষণা করুন।
৭. এবার আপনার কাজ হবে কিছু মানুষ খুঁজে বের করা যারা আপনার মত একই কাজে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তাদেরকে সাথে নিন। অন্তত ৫ জন মানুষ খুঁজে করুন। তাদের থেকে আইডিয়া নিন, আপনার আইডিয়া গুলো আলোচনা করুন। সবার আইডিয়া একত্র করে সেগুলোর ভুল ত্রুটি, ভালো মন্দ খুঁজে বের করে সেগুলো নিয়ে কথা বলুন। মনে রাখবেন ১ মাথার চাইতে ৫ মাথা অনেক বেশি চিন্তা করতে সক্ষম।
৮. এরপর আপনি যখন আপনার আইডিয়া বাস্তবায়ন করতে শুরু করবেন, তখন সেই কাজের পাশাপাশি অন্যান্য আইডিয়া গুলো নিয়েও অল্প অল্প করে কাজ করতে শুরু করুন। কাজগুলো এমন ভাবে করবেন যাতে আপনের চলমান প্রজেক্টের ক্ষতি না হয়, আবার অন্য প্রজেক্টগুলোও পড়ে না থাকে। ক্যারিয়ার ভাষায় এটিকে বলা হয় ওয়াইড অ্যাচিভার (Wide Achiever)। যদি একাধিক প্রজেক্ট একসাথে চলতে থাকে, তাহলে একটা প্রজেক্টের ক্ষতি হলেও অন্যটি দিয়ে সবগুলো ব্যালেন্স করে নেয়া সম্ভব। এইক্ষেত্রে অবশ্য আপনার ভাবা উচিত যে আপনি আসলে কোন পন্থায় বিশ্বাসী? কেবলমাত্র একটি আইডিয়ার উপর নির্ভর করে সফলতা অর্জন? নাকি একাধিক আইডিয়ার উপর বিভিন্ন সেক্টরে সফলতা অর্জন? আপনার চিন্তাধারায় যে সিদ্ধান্ত নিতে চান, নিয়ে নিন।
৯. যে আইডিয়া নিয়ে কাজ করছেন বা প্রজেক্ট চালু করেছেন। সেই আইডিয়ার একটি নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে শাখা প্রজেক্ট খুলতে পারেন। যেমন ধরুন আপনার যদি একটি রেস্টুরেন্ট হয়ে থাকে, সেই রেস্টুরেন্ট এর একটা আইটেমের একটি নির্দিষ্ট উপকরণ নিয়ে কাজ করতে পারেন। এতে আপনার ক্লায়েন্ট বাড়বে, প্রজেক্ট বড় হবে, আয়ও বাড়বে।
১০. নিজের কার্যক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির চেষ্টা করুন। একবারে প্রজেক্ট শুরু হয়ে গেলেই সেটা নিয়ে কাজ না করে তার পাশাপাশি আপনি যে কাজটি করেন সেটি নিয়ে আরো পড়াশোনা করুন। প্র্যাক্টিস করুন। ধরুন আপনি একজন শেফ, খুব ভালো রান্না করেন। তাহলে আপনি শেফ এর নতুন একটি কোর্স করুন, আরো নতুন ও ভিন্নধর্মী কিছু রান্না শিখুন। মনে রাখবেন, আপনার দক্ষতা যত বাড়বে, প্রজেক্টের কাজ ও উন্নতি ও তত বেশি হবে।
১১. নিজেকে চ্যালেঞ্জ করা ক্যারিয়ারে অনেক বড় একটি পরিবর্তন আনতে পারে। তাই প্রতিনিয়ত নিজের ক্ষমতা ও দক্ষতাকে চ্যালেঞ্জ করুন। যতটুকু কাজ করতে পারেন তার চাইতে বেশি করার চেষ্টা করুন। তবে খেয়াল রাখবেন, আপনি যখন সেটা করতে যাবেন, আশেপাশের মানুষ আপনাকে যা আছে তাই নিয়ে খুশি থাকতে বলবে। সেইদিকে কান না দিয়ে আত্মবিশ্বাসী হোন, নিজেকে সাফল্যের নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান।
১২. একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আপনার দক্ষতার উপর নির্ভর করে আপনি যে প্রজেক্ট শুরু করেছেন, শুরু থেকেই সেটি সফল হবে এমন কোন কথা নেই। অনেক ক্ষেত্রে আপনার ভালো পরিমাণে আয় আসতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। কিন্তু তাই বলে ধৈর্য্য হারিয়ে প্রজেক্ট বন্ধ করে দেয়ার প্রশ্নই আসে না। খানিক আগে বলছিলাম, নিজেকে চ্যালেঞ্জ করুন। আজকে হচ্ছে না? কালকে আবার চেষ্টা করুন। কালকে না হলে পরশু আবার চেষ্টা করুন। কিন্তু ধৈর্য্য হারানো চলবে না।
আপনার স্বাচ্ছন্দ্যবোধ, আপনার ধৈর্য্য, আপনার দক্ষতাই আপনাকে অনেকদূর নিয়ে যাবে। আর আগেই বলেছি, যে কাজে আপনি আনন্দ পাবেন, সেটি করতেও ভালো লাগবে। আগ্রহ থাকলে করতে ভালো লাগে, দক্ষতাও বাড়ে। তাই যে কাজেই ক্যারিয়ার করুন না কেন, সেই কাজটিকে আপনি কতটুকু ভালোবাসেন সেইদিকে নজর দেয়া জরুরী।
লিখেছেনঃ ফরহাদ রাকিব
ছবিঃ ক্লাউডম্যাজিক.কম