হঠাৎ করেই ওজন বেড়ে যাচ্ছে, অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন বা সারারাত জেগে থাকতে হচ্ছে ঘুম না হবার কারণে অথবা কোন কারণ ছাড়াই প্রচুর ঘামছেন। সাম্প্রতিক সময়ে এ সমস্যাগুলোতে বেশিরভাগ মানুষ ভুগছেন। আর এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য একেক জন একেক পন্থা অবলম্বন করছেন কিন্তু কিছুতেই যেন কোন কাজ হচ্ছে না! কেন কাজ হচ্ছে না? একবার ও খতিয়ে দেখেছেন কি? শরীরে নীরব ঘাতক টক্সিন এর আধিক্য এর কারণ। চলুন জেনে নিই এ নিয়ে বিস্তারিত।
টক্সিন শব্দটি অনেকেই শুনেছেন। কিন্তু এর ভয়াবহতা এবং এর সৃষ্টির পিছনের কারণ সম্পর্কে জানেন খুব কম সংখ্যক মানুষ। তাই ঠিক করেছিলাম সময় করে এই বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত লিখব। এই পর্বে আপনারা জানবেন দেহে টক্সিন কীভাবে তৈরি হয়, দেহে টক্সিনের আধিক্য নির্ণয়ের উপায় সমূহ সম্পর্কে।
শরীরে নীরব ঘাতক টক্সিন এর আধিক্য
টক্সিন কী?
এটি হচ্ছে এক ধরণের জৈব বিষ যা দীর্ঘ সময় নিয়ে শরীরে প্রবেশ করে অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন অর্গানগুলোকে আক্রান্ত করে ফেলে। মানবদেহে প্রতি মুহূর্তে টক্সিন তৈরি হয়। শরীর থেকে টক্সিন বের হতে না পারলে তা আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষকে আক্রমণ করে বসে যা পরবর্তীতে বিভিন্ন জটিল রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। টক্সিন সাধারণত দূষিত পানি, অপরিষ্কার–অপরিচ্ছন্নতা, বাসি খাবার, দূষিত বায়ু ইত্যাদির মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে থাকে।
টক্সিন কিভাবে তৈরি হয়?
আমাদের শরীরে যে বর্জ্য উৎপন্ন হয় তা মল-মুত্র, ঘাম, নিঃশ্বাস ইত্যাদির সাথে দেহ থেকে বের হয়ে যায়। যদি উৎপন্ন বর্জ্যের পরিমাণ নির্গত বর্জ্যের থেকে বেশি হয় তবে কিছু পরিমাণ এই দূষিত দেহে জমতে জমতে টক্সিনে পরিণত হয়। হজমে সমস্যা থাকলে, মলত্যাগে সমস্যা হলে, ঘাম না হলে, পরিমিত পানি পান না করলে শরীরে টক্সিন জমতে শুরু করে বা টক্সিন উৎপন্ন হওয়া সহজ হয়ে যায়। এছাড়া কায়িক পরিশ্রমের অভাবেও শরীরে টক্সিন জমে। যারা শাক সবজি কম খান, জাংক ফুড বেশি খান এবং মদ বা সিগারেট পান করেন তাদের শরীরে টক্সিন উৎপন্ন হওয়ার মাত্রা বেশি। মানবদেহে এমন কোন জায়গা নেই যেখানে টক্সিন জমতে পারে না। সামান্য সর্দি জ্বর থেকে শুরু করে স্ট্রোক, প্যারালাইসিস, ব্রংকাইটিস ছাড়াও বেশিরভাগ শারীরিক রোগের জন্য টক্সিন দায়ী ।
শরীরে টক্সিনের আধিক্য কিভাবে বুঝবেন?
শরীরে অত্যধিক টক্সিন জমা হলে তা শরীর নিজেই তা জানান দেয়। কিছু শারীরিক লক্ষণ রয়েছে যা দেখলে আপনি নিশ্চিত হতে পারবেন আপনার শরীরে টক্সিনের আধিক্য রয়েছে।
(১) শরীরে নীরব ঘাতক টক্সিন কোষ্ঠকাঠিন্য
লারজ ইন্টেস্টাইন প্রত্যহ মলের সঙ্গে শরীরের টক্সিন বের করে দেয়। নিয়মিত মল ত্যাগ না হলে শরীরে টক্সিন জমে এবং ফলস্বরুপ কোষ্ঠকাঠিন্য হয়।
(২) শরীরে নীরব ঘাতক টক্সিন এর জন্য ওজন বেড়ে যায়
কিছুই খাচ্ছেন না অথচ ওজন বেড়ে যাচ্ছে অথবা হঠাৎ করেই ওজনটা বেড়ে গেল এমনটা অনেকের ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। আবার অনেক চেষ্টা করেও ওজন কমাতে পারছেন না। এমন ক্ষেত্রে বুঝবেন শরীরে টক্সিন জমেছে। সাধারণত চিনি বেশি খেলে, রাসায়নিক খাবার, ক্যানবন্দি খাবার, জাংক ফুড বেশি খেলে এক সময় এই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় ।
(৩) একটুতেই ক্লান্ত
শরীরে টক্সিনের আধিক্যে একটুতে ক্লান্তি ভর করে। রোজকার সাধারণ কাজ করতেই হাপিয়ে উঠছেন, অফিস থেকে ফিরে বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না বা শুয়ে থাকলেই যেন ভালো লাগে। এমন হলে বুঝবেন টক্সিনের মাত্রা বেড়ে গেছে। টক্সিন শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয় বলেই এমনটি হয়।
(৪) শরীরে নীরব ঘাতক টক্সিন চর্ম রোগ
চামড়া বা ত্বক আমাদের দেহ থেকে টক্সিন বের করে দিতে সহায়তা করে। অন্ত্র এবং লিভার যখন খাবারে থাকা টক্সিন বের করে দিতে পারে না, তখনই ত্বক সেই টক্সিন বের করার চেষ্টা করে এর ফলেই ফোঁড়া, র্যাশ, বিভিন্ন চর্ম রোগ হয় ।
(৫) শরীরে নীরব ঘাতক টক্সিন মাথা ব্যথা
টক্সিনের অন্যতম লক্ষ্য হল মস্তিষ্কের সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমে বাসা বেঁধে যাওয়া । এর ফলে বিভিন্ন টিস্যু খুব অনুভূতি প্রবণ হয়ে পড়ে। তখন সামান্য কারণেই এই টিস্যুতে যন্ত্রণা দেখা দেয়। এর নাম হল মাইগ্রেন ।
(৬) মুড সুইং
প্রসেসড ফুড, এডিটিভ ফুড এবং কৃত্রিম উপায়ে তৈরি খাবার থেকে এক ধরণের টক্সিন শরীরে ঢোকে যাতে জেনোইস্ট্রোজেন থাকে। এ ধরণের টক্সিন এর প্রভাবে হঠাৎ করেই মেজাজের পরিবর্তন ঘটে। শুধু তাই নয় এস্পারটেস নামক ধরণের টক্সিন শরীরে প্রবেশ করলে ডিপ্রেশন হয়। যারা এসব খাবার বেশি খান তারা ডিপ্রেশনের শিকার হন।
(৭) পেশিতে ব্যথা ও কালশিটে
কোন চোট লাগেনি কিন্তু শরীরে বিভিন্ন পেশিতে ব্যথা হচ্ছে। সঙ্গে রয়েছে কালশিটে। এটা অত্যধিক টক্সিনের লক্ষণ। খাবার, ঘর পরিষ্কার করার বিভিন্ন জিনিস প্রসাধনী ইত্যাদি ক্রমাগত ব্যবহারের ফলে আমাদের শরীরে স্ট্রেস পড়তে থাকে এবং ডিফেন্স সিস্টেম দুর্বল হয়ে পড়ে। এতে পেশিতে অক্সিজেনের জোগান কমে যায় ,তার ফলেই পেশিতে ব্যথা হয়। সঙ্গে কালশিটে পড়ে যায় ।
(৮) শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া
শরীরে অত্যধিক টক্সিন জমে গেলে রক্তের সংগে তা লিভারে পৌছায় ।লভার তখন সেই টক্সিন মিশ্রিত রক্ত শোধন করতে অতিরিক্ত খাটে ।এর ফলেই দেহের তাপমাত্রা বেড়ে যায় ।সঙ্গে প্রচুর ঘাম হয় ।
(৯) অনিদ্রা
শরীরে টক্সিন বেড়ে গেলে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে বা ঘুম আসে না। কারণ টক্সিন শরীরের টিস্যুতে জমা হয়, ঠিক মতো ব্লাড সার্কুলেশন হতে দেয় না।
(১০) শরীরে নীরব ঘাতক টক্সিন যকৃতে অসুবিধা
যকৃতে টক্সিন জমা হবার ফলে যকৃতের মুখ বুজিয়ে দেয়। এতে করে জিহ্বাতে হলুদ দাগ পড়ে থাকে। যদি এমনটা হয় তবে বুঝবেন রক্তে টক্সিন বেড়ে গেছে।
(১১) পেটে অতিরিক্ত মেদ জমা
শরিরে ক্ষতিকারক টক্সিন বেড়ে গেলে শরীর গ্লুকোজ লেবেল ব্যালেন্সড থাকে না। এর সঙ্গে কোলেস্টেরলকে সঠিক ভাবে কাজে লাগাতে পারে না । ফলে পেটে মেদ জমে যায়।
(১২) শরীরে নীরব ঘাতক টক্সিন নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধ
প্রসেসড ফুড খাওয়ার ফলে শরীরে অত্যধিক মাত্রায় শর্করা প্রবেশ করে। যাতে ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়া তৈরি হয় এবং বাড়তে থাকে। তা পরিপাক তন্ত্র তো বটেই সঙ্গে মুখেও বাসা বাধে। ফলে মুখের দুর্গন্ধ থেকে মুক্তি পান না। এছাড়াও অত্যধিক ঢেকুর এবং হজমের সমস্যা হয়ে থাকে।
এই তো জেনে গেলেন শরীরে নীরব ঘাতক টক্সিন এর আধিক্য বুঝবার ১২টি উপায়। আজ এই পর্যন্তই। পরের পর্বের জন্য একটু অপেক্ষা করতে হবে। খুব শীঘ্রই শরীরে নীরব ঘাতক টক্সিন থেকে পরিত্রাণের উপায় নিয়ে হাজির হয়ে যাব।
শরীরকে টক্সিন মুক্ত রাখার কিছু উপায় (পর্ব ২)
ছবি – পিন্টারেস্ট ডট কম