অনিয়ন্ত্রিত ওজন সমস্যা অনেকেরই আছে। আর আমাদের কিছু অভ্যাসের কারণেই মূলত ওজন বৃদ্ধি পায়। এই অভ্যাসগুলো খুব সহজেই আমরা পরিবর্তন করে ওজন নিয়ন্ত্রণ করার পথ সহজ করে দিতে পারি। তাই সঠিক ডায়েট চার্ট আর ব্যায়ামের পাশাপাশি আমদের সেই অভ্যাসগুলো সম্পর্কেও জানা উচিত যেগুলোর কারণে আমাদের ওজন বৃদ্ধি পায়। চলুন তবে জেনে নেই অনিয়ন্ত্রিত ওজন সমস্যা থেকে বাঁচতে আমরা কী করতে পারি!
অনিয়ন্ত্রিত ওজন সমস্যা নিয়ে যত কথা
১) টিভি অথবা কম্পিউটারের সামনে বসে খাওয়া
টিভি দেখতে দেখতে খেতে থাকলে আমরা নিজের অজান্তেই অতিরিক্ত খেয়ে ফেলি। কারণ তখন আমাদের মনোযোগ থাকে টিভির প্রতি। পেট হয়ত অনেক আগেই ভরে যায় কিন্তু তারপরেও শুধু শুধু খেতে থাকি যেহেতু সামনে খাবার থাকে। একে বলা হয়- “mindless calorie consumption”
২) অনিয়ন্ত্রিত ওজন সমস্যা দূর করতে বড় প্লেটে না খাওয়া
আমরা সাধারণত ততক্ষণ প্লেটে খাবার তুলতে থাকি যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের প্লেট না ভরে যায়। এখন প্লেট যদি অতিরিক্ত বড় হয় তখন সেটার অর্ধেক অংশে খাবার নিলেই তা আমাদের শরীরের জন্য যথেষ্ট কিন্তু আমরা ভাবি যে আধা প্লেট খাবার খেয়ে কি পেট ভরবে? তাই পুরো প্লেট ভরে খাবার নিয়ে নেই। তাই বড় প্লেটে না খেয়ে ছোট প্লেটে খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। ভালো হয় যদি ৮.৫ থেকে ১০ ইঞ্চি ব্যাসের প্লেটে খাওয়া যায়।
৩) অনিয়ন্ত্রিত ওজন সমস্যা দূরে অতিরিক্ত স্ট্রেস না নেওয়া
এখনকার ব্যস্ত যুগে অতিরিক্ত স্ট্রেস (Stress) হচ্ছে অ্যাবডোমিনাল (abdominal) ওজন বৃদ্ধির একটি কারণ। স্ট্রেসের কারণে আমাদের শরীরে কর্টিসল (cortisol) উৎপন্ন হয়, একে স্ট্রেস হরমোনও বলা হয়। এই কর্টিসল ব্লাড স্ট্রিম (cortisol bloodstream)-এ অনেক বেশি থাকলে ওজন বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। কারণ অতিরিক্ত কর্টিসল শরীরকে সাহায্য করে ইনসুলিন রিলিজ করতে যা আপনার অ্যাপেটাইট (appetite) বাড়িয়ে দিবে। কাজেই যত বেশি কর্টিসল থাকবে আপনি ততো বেশি ক্ষুধা অনুভব করবেন আর বেশি বেশি খাবেন। আপনি যখন স্ট্রেস ফিল করবেন তখন কর্টিসল আপনার ব্লাড সুগার (blood sugar) বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু যখন স্ট্রেসের সময়টুকু কেটে যায় তখনও আপনার ব্লাড সুগার উচ্চ লেভেল এই থাকে। তাই এই অতিরিক্ত গ্লুকোজ (glucose) আপনার শরীরে ফ্যাট হিসেবে জমা হয়।
৪) সিড়ি ব্যবহার না করা
আজকাল বাড়ি, অফিস, মার্কেট সব জায়গায় এলিভেটর বা লিফট (elevator) থাকায় অনেকেই ২য় ফ্লোরে উঠার জন্যও আর সিড়ি ব্যবহার করেনা। এই অভ্যাস ধীরে ধীরে আমাদের অলস করে ফেলে। তাই বিভিন্ন ছোট ছোট কাজের মাধ্যমে আমরা আমাদের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি। যেমন- সিড়ি ব্যবহার করা, কাছে কোথাও গেলে বাস, রিকশা না নিয়ে হেঁটে যাওয়ার অভ্যাস করা।
৫) কম প্রোটিন খাওয়া
যাদের খাদ্য তালিকায় প্রচুর পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট থাকে তাদের ওজন বৃদ্ধি পাবেই। তাই সব কিছু পরিমিত পরিমাণে খেতে হবে। অন্যান্য খাবারের সাথে প্রোটিন খাবেন কারণ প্রোটিন খেলে আপনার শরীর আরও বেশি ক্যালোরি বার্ন করবে সেটা পরিপাক করার জন্য। সামুদ্রিক খাবার (Seafood) আর চামড়া ছাড়ানো মুরগীর মাংস প্রোটিন হিসেবে খেতে পারেন।
৬) অনেক বেশি লিকুইড ক্যালোরি (Liquid Calories) গ্রহণ করলে
আমরা ঘরের বাইরে থাকলে প্রায়ই পানির বদলে জুস, সফট ড্রিঙ্কসের উপর নির্ভর করি। বাইরে খেতে হলে সফট ড্রিঙ্কসগুলোর বদলে পানি নিয়েছেন এরকম খুব কমই দেখা যায়। এগুলো খেলে যেহেতু পেট ভরে না তাই আমরা অনেক সময় এগুলো অতিরিক্ত খেয়ে ফেলি। কিন্তু এগুলোতে পরিমাণ অল্প থাকলেও ক্যালোরি থাকে প্রচুর। ফলে যারা প্রতিদিন বা ঘন ঘন এসব পান করেন তাদের দ্রুত ওজন বৃদ্ধি পেতে থাকে।
৭) প্রয়োজনের তুলনায় কম ঘুম
ঘুমের অনিয়ম ওজন বৃদ্ধির একটি কারণ। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে যারা ৫ থেকে সাড়ে ৫ ঘন্টা ঘুমায় তাদের চাইতে ৭ ঘন্টা যারা ঘুমায় তাদের ওজন কম। এর কারণ হলো লেপ্টিন (leptin) আর গ্রেলিন (ghrelin) হরমোন। ঘুম কম হলে লেপ্টিন লেভেল কমে যায় আর গ্রেলিন লেভেল বেড়ে যায়। বেশি গ্রেলিন আমাদের অ্যাপেটাইট বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে অল্প লেপ্টিনের কারণে খাওয়ার পরেও মনে হয় ক্ষুধা কমে নি। কাজেই আপনার তখন একটু পরপরই এটা সেটা খেতে ইচ্ছে করবে।
৮) নাশতা না করা
সকালে ঘুম থেকে উঠেই অনেকে কিছু না খেয়ে বের হয়ে যায়। কেউ অফিসে, কেউ সন্তানকে স্কুলে দিতে, কেউবা বাজার করতে। কিন্তু এটা আমাদের সবার মনে রাখা প্রয়োজন যে সকালে নাশতা না করলে তা আমাদের ওজন বৃদ্ধির পথটা আরও সহজ করে দেয়। নাশতা আমাদের মেটাবলিজমকে পূর্ণ উদ্যমে শুরু করে যা সঠিক নিয়মে ক্যালোরি বার্ন করার জন্য জরুরি। তাছাড়া নাশতা না করলে দুপুরে আরও বেশি ক্ষুধা অনুভবের কারণে আরও বেশি খাওয়া হয়ে যায়। অনেকের সকালে ঘুম থেকে উঠে কিছু খেতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু এটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আপনি ঘুম থেকে উঠর পর ২ ঘন্টার মধ্যে কিছু একটা হালকা খাবার খেয়ে নিবেন যেন পেট খালি না থাকে।
৯) খাদ্যের পরিমাণ হিসেব না করে খাওয়া
আমরা বেশিরভাগ সময়ই আমাদের ক্যালোরি গ্রহণের পরিমাণ রেকর্ড করে রাখি না। ওজন কমাতে চাইলে আমরা যদি প্রতিদিন প্রতিবেলায় কী কী খাচ্ছি তা রেকর্ড হিসেবে না রাখি তাহলে বুঝতে পারবো না যে কতটুকু ক্যালোরি আমাদের বার্ন করতে হবে। আপনার যদি ইচ্ছে থাকে যে আপনি প্রতিদিন ১৪০০ ক্যালোরির বেশি গ্রহণ করবেন না। তাহলে সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা, রাত বিভিন্ন সময়ের জন্য ক্যালোরি ভাগ করে নিন। প্রতি বেলার হিসেব রাখুন যেন একবেলা বেশি খেলে পরের বার কম খেয়েও মানিয়ে নিতে পারেন। আপনার হয়তো রাতে ২৫০ ক্যালোরি নেয়ার কথা। অথচ আপনি হিসেব করে দেখলেন যে সারাদিনে ১২০০ ক্যালোরি গ্রহণ করে ফেলেছেন সেক্ষেত্রে আপনি রাতে ২০০ ক্যালোরি নিবেন যেন সারাদিনের ক্যালোরি গ্রহণের পরিমাণ ১৪০০ এর বেশি না হয়ে যায়। আপনি হয়তো একটা আইসক্রিম খেয়ে ফেললেন তখন সেটার কথা লিখে রাখুন এবং যখন ব্যায়াম করবেন তখন আইসক্রিমের জন্য যতটুকু বেশি ক্যালোরি নিলেন সেটা হিসেব করে ওইটুকু বার্ন করে ফেলুন।
১০) অনিয়ন্ত্রিত ওজন সমস্যা খুব তাড়াতাড়ি না খাওয়া
অনেকেই খাওয়ার পেছনে বেশি সময় নষ্ট করবেন না ভেবে খুব তাড়াতাড়ি খাবার খেতে থাকেন। এতে তারা বুঝতে পারেন না যে আসলে কতটুকু খেয়ে ফেললেন। হয়তো তাড়াতাড়ি খেতে গিয়ে ৩/৪ চামচ ভাত বেশি নিয়ে ফেললেন অথবা ২টির বদলে ৪টি রুটি খেয়ে ফেললেন। তাই ৩ বার খাবার মুখে দেয়ার পর ৭/৮ সেকেন্ড অপেক্ষা করুন। বোঝার চেষ্টা করুন আপনার আর কতটুকু খাবারের প্রয়োজন বা আপনি কত বার খাবার নিচ্ছেন।
১১) জিম মেশিন মনিটরের প্রতি নির্ভর করা
অনেক জিমেই ট্রেডমিলের মনিটরে ক্যালোরি বার্ন হওয়ার পরিমাণ ঠিক মতো আসে না। অর্থাৎ আপনি যত বার্ন করবেন তার চাইতেও বেশি বার্ণ করেছেন এমনটা দেখাবে। যা দেখে আপনার মনে হবে আপনি যতটুকু ক্যালরি বার্ন করা প্রয়োজন তার চাইতে বেশি বার্ন করে ফেলেছেন। ফলে আপনি বাড়িতে ফিরে নির্ধারিত ক্যালোরির চাইতে বেশি গ্রহণ করে ফেলবেন। সব জিমের ক্ষেত্রে অবশ্য কথাটা প্রযোজ্য নয়, তারপরেও মেশিনের উপর অতিরিক্ত ভরসা না করাই ভালো। ট্রেডমিল (Treadmil) ব্যবহার করুন কিন্তু মনিটরের তথ্যের উপর খুব বেশি নির্ভরশীল না হয়ে জিম ইন্সট্রাকটরের কাছ থেকে জেনে নিন যে কত স্পিডে কতক্ষণ ট্রেডমিল ব্যবহার করলে আপনার জন্য ভালো হবে।
১২) খাওয়ার আগে পানি পান না করা
আমরা সাধারণত খালি পেটে আগেই খাবারের দিকে হাত বাড়াই। প্রতি বেলা খাওয়ার আগে এক গ্লাস পানি পান করে নিলে ওজন নিয়ন্ত্রণে আনা সহজ হবে। কারণ পানি আপনার পাকস্থলীর (stomach) কিছু জায়গা নিজের জন্য নিয়ে নিবে তখন আপনি অতিরিক্ত খেতে পারবেন না। পানির বদলে হার্বাল চা খেতে পারেন। শুধু পানি ভালো না লাগলে এক স্লাইস লেবু পানিতে নিয়ে খেতে পারেন।
১৩) জিমের সবার সাথে মেলেমেশা না থাকা
যেহেতু জিমে লম্বা সময় থাকতে হয় তাই সেখানে একা থাকাটা খুবই বিরক্তিকর। এজন্য অনেকেই জিমে যেতে চান না আবার বাড়িতে নিজে নিজেও আর ব্যায়াম করা হয় না। কেউ কেউ জিমে ভর্তি হয়ে গেলেও একা থাকার কারণে কয়েকদিন পরেই ছেড়ে দেয়। তাই চেষ্টা করুন আপনার কোন বন্ধু বা পরিবারের অন্য কোন সদস্যকে আপনার সাথে জিমে ভর্তি করাতে। অথবা জিমে আপনার আশেপাশে যারা থাকেন তাদের সাথেই মেলা মেশা করার চেষ্টা করুন। ট্রেডমিল অথবা সাইক্লিং-এর সময় আপনার পাশের মেয়েটির সাথে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতে থাকুন দেখবেন সময় কেটে যাচ্ছে অথবা কিছুক্ষণ ব্যায়াম করে নিন, ৩/৪ মিনিট বিশ্রাম নেয়ার সময় আশে পাশে যারা আছে তাদের সাথে হালকা কথা বলে আবার শুরু করতে পারেন।
১৪) অনিয়ন্ত্রিত ওজন সমস্যা সমাধানে সময়মতো খাওয়া
সকাল, দুপুর রাত এভাবে যদি আমরা খাওয়ার সময় ৩ বেলায় ভাগ করে নেই তাহলে প্রতিবেলায় খাওয়ার সময় হলে প্রচন্ড ক্ষুধার্ত থাকব আর বেশি খাব। তাই খাবারের সময় কে আরও বেশি ভাগ করে নিন। সকাল ৮ টায় নাশতা করুন, ১১টায় একটি আপেল খান, ২টায় দুপুরের খাবার, বিকেল ৫টা থেকে সাড়ে ৫টার মধ্যে হালকা কিছু খান। যেমন – আধা কাপ নুডলস বা আধা কাপ মুড়ি খান, আবার রাত ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে রাতের খাবার শেষ করুন। এর ফলে সারা দিন আপনার পেট ভরা থাকবে আর কোন বেলায় অতিরিক্ত খেয়ে ফেলবেন না।
এইতো এই ছিল অনিয়ন্ত্রিত ওজন সমস্যা থেকে বাঁচতে কিছু টিপস। আশা করি এই টিপসগুলো মেনে চললে আপনার ওজনের সমস্যা দূর হবে। সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন!
ছবি- hindustantimes