পৃথিবীর বয়স যত বাড়ছে, নিত্য নতুন অসুখও যেন বেড়েই চলেছে। তার উপরে আছে দুশ্চিন্তা । কোন ডাক্তার ভালো হবে। কে সঠিক ভাবে আমাকে বুঝতে পারবে। অনেকে শুধু ডাক্তার কেই দোষ দিয়ে থাকেন। কিন্তু ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা হোক অথবা অপারেশন হোক সবখানেই রোগীকে ডাক্তারের পাশাপাশি সচেতন হতে হবে। আজ এমন কিছু বিষয় নিয়েই আলোচনা করব।
রোগীর সচেতনতাঃ
মেডিকেল ট্রিটমেন্টে – ডাক্তারকে কথায় কথায় দোষ দেয় এমন মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। কিন্তু রোগীরাও ভুলে যান ডাক্তাররাও মানুষ । খুব সতর্ক থাকলেও তাদেরও ভুল হতে পারে। পথ্য দিয়ে চিকিৎসার ক্ষেত্রে এখানে কিছু টিপস দেয়া হল যাতে রোগী লাভবান হয়।
০১. কোন ধরনের ইনফেকশন হলে অথবা আশংকা থাকলে ডাক্তাররা এন্টিবায়োটিক খেতে বলেন । এটি ৩ , ৫, ৭ বা চলবে হিসেবেও ডাক্তাররা দেন। অনেক সময় খাওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে কোর্স শেষ হওয়ার আগেই কিছুটা সুস্থ মনে হয়। তার কারণ তখন জীবাণু কিছুটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে। সব জীবাণু মেরে ফেলতে হলে পুরো কোর্স শেষ করতে হবে। জীবাণু আমাদের শরীরে যাতে আবার বাসা না বাঁধতে পারে। ছেড়ে দিলে কয়েক দিন পর রয়ে যাওয়া জীবাণু আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। ফলে বার বার ইনফেকশন হয়।
০২. গ্যাস্ট্রিক এর ওষুধ অন্যান্য ওষুধের সাথে ডাক্তাররা খেতে দেন। অনেকে ভাবেন আমার তো গ্যাস্ট্রিকের প্রবলেম নেই কাজেই খাওয়ার দরকার নেই। এটা ভুল ধারনা। কিছু ওষুধ আছে খেলে সাইড এফেক্ট হিসেবে গ্যাস হতে পারে। তাই আস্থা রেখে খেয়ে যেতে হবে।
০৩. মাঝে মাঝে ওষুধ খেলে খুব দুর্বল লাগে। সাইড এফেক্ট হিসেবে এমন হয়। এন্টিবায়োটিক খেলে এমন হতে পারে অথবা বেশি পাওয়ার এর ওষুধ খেলে। মাছ, মাংস, দুধ ডিম খেতে হবে। মনে রাখতে হবে, ওষুধ রোগ সারানোর জন্যে হলেও, মূল সুস্থতা কিন্তু সঠিক ও সুষম খাবার এবং পর্যাপ্ত বিশ্রামে।
০৪.ওষুধ কিনতে কার্পণ্য করেন না এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়। ডাক্তাররা কিছু ওষুধ চলবে লিখে থাকেন। আপনি ভাবতে পারেন কি রকম ডাক্তার? আমি সুস্থ হয়ে গেছি এখনও কিসের ওষুধ? আপনি যাতে ভবিষ্যতে একই রোগে না ভুগেন, তাই এই ব্যবস্থা ।
০৫.ফার্মাসিস্ট দের কাছ থেকে অনেকেই রোগের লক্ষণ বলেও ওষুধ নেন। আপনি কি জানেন এতে আপনার কত ক্ষতি হয় ? সে শুধু লক্ষণের ওষুধ দিতে পারে। কিন্তু আপনার রোগের মূল কারণ ধরতে পারে না, যার ফলে আপনি বার বার ভুগতে থাকেন। একজন ভদ্রলোক গ্যাসের সমস্যার জন্যে ব্যথা হওয়ায় দোকানদারের কাছে ওষুধ চাইলে তাকে পেইন কিলার দিলো। কিন্তু গ্যাসের ব্যথায় পেইন কিলার দিলে যে পারফোরেশন ( খুদ্রান্ত্র ছিদ্র হওয়া ) হতে পারে, তা সে জানে না। ফলে রোগীর হাসপাতালে ভর্তি হয়ে অপারেশন করা লাগলো। ৫০০ টাকা বাঁচাতে গিয়ে তার লাখ টাকার ক্ষতি হয়ে গেল।
০৬. বেশ কিছু ওষুধ আছে যার প্রভাবে এনাফাইলেক্টিক রিঅ্যাকশন হয়। কোন এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করার পরে যদি অ্যালার্জি হয় তবে তা আর ব্যবহার না করে এর বদলে অন্য কিছু ব্যবহার করা যায়। কিছু ওষুধ খেলে সাইড এফেক্ট বেশি হয়। তখন ওষুধটি বন্ধ করে সাথে সাথে জানাতে হবে চিকিৎসককে। এর মানে এটা নাও হতে পারে যে ওষুধ টা ভুল। এটা হয়ত আপনার শরীরের সাথেই মানানসই হয়নি।
অপারেশনের পূর্বে ও পরে –
০১. অপারেশনের পূর্বে কিছু রুটিন টেস্ট আছে, যা আপনি শারীরিক ভাবে কতটা ফিট বা এই অজ্ঞান প্রক্রিয়া আপনাকে কতটা প্রভাবিত করতে পারে তা জানার জন্যে সত্যিই জরুরী। অপারেশনের সময় কিছু জিনিস মনিটর করতে হয়। আপনার যদি রক্ত চাপ বেশি হয়, ডায়াবেটিস থাকে, রক্তের কোন অস্বাভাবিকতা থাকে অথবা যদি হার্টের কোন সমস্যা থাকে তখন অপারেশনে জটিলতা দেখা দিতে পারে। সেগুলোকে ম্যানেজ করার জন্যেই এগুলো টেস্ট করা প্রয়োজন।
০২. অপারেশনের পূর্বে অস্থির না হয়ে, যা হয়েছে ভালো হয়েছে এবং আল্লাহ যা করবেন ভালো করবেন ভেবেই ঢুকতে হবে। কারণ মানসিক চাপ নিয়ে গেলে তা আপনার অপারেশন এবং ডাক্তার উভয়কেই প্রভাবিত করতে পারে।
০৩. শুধু অপারেশন নয়, রক্ত দেয়া নেয়া দুটোতেই ব্লাড টেস্ট খুব জরুরী। প্রতিটি মানুষের নিজের ব্লাড গ্রুপ জানা জরুরী। যে কোন ইমারজেন্সি হলে রক্ত সবার আগে দরকার। ভুল গ্রুপের রক্ত দেয়া হলে রোগীর জ্বর, অ্যালার্জি দিয়ে শুরু হয়ে, তাড়াতাড়ি বন্ধ না করলে কিডনি নষ্ট হয়ে মারা যেতে পারে।
০৪.অপারেশনের পরে ডাক্তারের দেয়া ওষুধ নিয়মিত খেতে হবে যাতে কোন ইনফেকশন না হয় এবং স্থানটি তাড়াতাড়ি শুকায়। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা খুবই জরুরী। অঙ্গ প্রতিস্থাপন , যেমন কিডনি , লিভার অথবা হার্ট , কোন বড় অপারেশনের পর কিছু দামী ওষুধ দেয়া হয়, যাকে immunosuppressant বলে। নতুন অঙ্গটি আরেক জনের অংশ ছিল। শরীর এর বিরুদ্ধে স্বাভাবিক ভাবেই প্রতিরোধ সৃষ্টি করে। এই প্রতিরোধ ক্ষমতা কে ভাঙতেই ওষুধ দেয়া হয়। যা নিয়মিত না খেলে নতুন অঙ্গটি রিজেক্ট হয়ে যায়। পাশাপাশি এটাও মাথায় রাখতে হবে, এই ওষুধের সাইড এফেক্ট হিসেবে পুরো শরীরেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ফলে বেশি জীবাণুর সংক্রমণ হয়। এ ব্যাপারেও সচেতন থাকতে হবে।
ডাক্তারের সচেতনতাঃ
০১. ডাক্তারদের কোন ছোট ভুল ও অনেক বড় ক্ষতি করতে পারে। একটা মানুষের জন্ম হয় ডাক্তারের হাতে, আবার মৃত্যু-ও । তাই তাদের সচেতনতাও জরুরী। অনেকেই প্রাইভেট প্র্যাকটিসে সময় নিয়ে ভালো করে সব জিজ্ঞেস না করে রোগী দেখেন। রোগীকে সময় দেয়া জরুরী। বিরক্ত না হয়ে সব শুনলে রোগীর-ও ডাক্তারের প্রতি আস্থা সৃষ্টি হয়। নিয়মিত ওষুধ খাওয়ার প্রতি আগ্রহ বাড়ে।
০২. মানসিক চাপে থাকলে রোগী না দেখাই ভালো। জীবনে খারাপ সময় আসতে পারে কিন্তু তার প্রভাব যেন রোগীর উপর না পড়ে। এতে রোগীর যেমন ক্ষতি হয় তেমনি নিজের সুনামও নষ্ট হয়
০৩. এক জনের স্থানে আরেক জনের অঙ্গ কেটে ফেলা, ভুল লোককে ভুল গ্রুপের রক্ত দেয়া, পেটে ছুরি কাচি রাখার কথা প্রায়ই শোনা যায়। এতে ডাক্তারের রেজিস্ট্রেশন বাতিল হয়ে যেতে পারে। তাড়াহুড়া না করে নাম, বয়স ঠিকানা অর্থাৎ পরিচিতি নিশ্চিত করে কাজ করতে হবে।
০৪. ভালো ব্যবহার পাওয়া রোগীর অধিকার। প্রয়োজন হলে কম রোগী দেখতে হবে, কিন্তু যা দেখতে হবে মনোযোগ নিয়ে। হতে পারে আপনার একশ রোগীর মধ্যে একজন কিন্তু তিনি তার আপন জনদের জন্যে অনন্য ও প্রয়োজনীয়।
০৫. পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক রোগীর জন্যে ব্যবহার করা জিনিস আরেক জনকে দেয়া যাবে না। কারণ প্রথম ব্যাক্তির ইনফেকশন থাকলে তা অন্য ব্যাক্তির শরীরেও প্রভাব ফেলতে পারে। আজকের আলোচনায় একটা জিনিস নিশ্চিত, রোগীর সুস্থতায় রোগীরই করনীয় বেশি। সঠিক সময়ে ব্যবস্থা নিলে তাড়াতাড়ি অসুখ ভালো হয়ে যায় এবং অনেক জটিল অপারেশন এড়ানো সম্ভব হয়। কথায় আছে প্রতিকার অপেক্ষা প্রতিরোধ ভালো। আবার অপারেশনের মত পরিস্থিতি তৈরি হলে কিভাবে মোকাবেলা করতে হবে তাও জানা জরুরী। আপনিই নিজের আসল চিকিৎসক। তাই মেনে চলুন নিয়মগুলো , আস্থা রাখুন সৃষ্টিকর্তার প্রতি। সুস্থতা থাকবে আপনার হাতের মুঠোয়।
লিখেছেনঃ শারমিন আখতার চৌধুরী
ছবিঃ সাটারস্টক