‘প্লাস্টিক’ আমাদের জীবনের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে মিশে আছে। প্লাস্টিকের ব্যবহার ছাড়া আমাদের জীবন এখন চিন্তাই করতে পারি না। কম বেশি সব রকম কিছুতেই প্লাস্টিকের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। প্লাস্টিকের ভাল-মন্দ দুটি দিকই আছে। কিন্তু চিকিৎসকরা বেশিরভাগ সময়ই প্লাস্টিকের বক্সে খাবার রাখতে নিষেধ করেন। কারণ এর থেকে এক ধরনের রাসায়নিক বের হয়, যা আমাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। তবুও গৃহস্থালীর নানা কাজে নিত্য প্রয়োজনীয় এই প্লাস্টিকের জিনিস ব্যবহার করা হয় বহুল পরিমাণে।
হাত থেকে পড়ে গেলে সহজে ভাঙে না, পরিষ্কার করাও সহজ- ব্যবহারের এমন সুবিধার জন্য প্লাস্টিকের জিনিস এখন জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পানি রাখা থেকে শুরু করে- তেল, রান্নাঘরের মশলার কৌটা, টিফিন বক্স, শ্যাম্পু ও বাচ্চার খাবার রাখাসহ সব জায়গাতেই প্লাস্টিকের ছড়াছড়ি। কিন্তু অনেকেই জানেন না, দিনের পর দিন একই প্লাস্টিকের যথেচ্ছ ব্যবহার আমাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে কতটা ক্ষতিকর।
প্লাস্টিকের জিনিস ব্যবহারের বিধিনিষেধ
তাই প্লাস্টিকের জিনিস ব্যবহার করলেও মেনে চলুন এই বিধি নিষেধগুলো
১. প্লাস্টিকের বক্সে ১ দিনের বেশি খাবার ফ্রিজে রেখে খাওয়া একদমই উচিত নয়।
২. বাসায় যতটা সম্ভব কাচের বোতলে পানি রাখুন, কাচের জগ ব্যবহার করুন।
৩. প্লাস্টিক কন্টেইনারে কখনোই খাবার গরম করবেন না।
৪. এমনকি তা মাইক্রোওয়েভ সেফ হলেও প্লাস্টিকের জিনিস ব্যবহার করা ঠিক নয়।
৫. প্লাস্টিকের পাত্রে গরম খাবার রাখাও ঠিক নয়। প্লাস্টিকের পাত্র যতটা সম্ভব গরম পানির থেকে দূরে সরিয়ে রাখা উচিত।
৬. অনেকেই কন্টেইনার বা বোতল জীবাণুমুক্ত করার জন্য গরম পানিতে তা ধুয়ে নেন। অনেকে আবার পানি গরম রাখতে এয়ারটাইট প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার করেন। কিন্তু এই অভ্যাস থেকে দূরে থাকাই ভালো।
৭. কাঁচ বা স্টিলের বাসনের মতো প্লাস্টিক কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করা যায় না। পুরনো প্লাস্টিকের ব্যবহার স্বাস্থ্যের পক্ষে বিপজ্জনক।
৮. একবার পলি মলিকিউল (অণু) তৈরি করলে তা আর বিনাশ হয় না। পুড়ে ভস্ম হয় না। ডোবে না। মাটিতে মেশে না। মাটির স্তর পৃথক হয়ে থাকে। মাটির অক্সিজেন শোধনের ক্ষমতা হারায়। মাটির মধ্যে অসংখ্য জৈব পদার্থের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়। নগরীতে ড্রেইন বদ্ধ করে দেয়। জলাশয় দূষিত করে ফেলে। এই অণু অজয় অমর অক্ষয়। এই অমর শত্রুকে আমরা ঘরে তুলেছি।
৯. চিকিত্সকেরাও বলছেন, পানীয় জল বা নরম পানীয়ের এই ধরনের প্লাস্টিকের বোতলে জল ভরে বার বার খাওয়া মানুষের শরীরের জন্য যথেষ্টই ক্ষতিকারক। নরম পানীয় বা প্যাকেজড ড্রিংকিং ওয়াটারের বোতলগুলির ফাঁকা হওয়ার পরে সেগুলো নষ্ট করে দেওয়ার কথা বোতলের গায়েই লেখা থাকে। কার্যক্ষেত্রে আমরা করি ঠিক উল্টোটা।
১০. দুর্গাপুরের একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের প্রধান চিকিত্সক গৌতম ঘোষের কথায়, যত সময় যায়, এই ধরনের বোতলগুলোর প্লাস্টিকের সঙ্গে জলের রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে। একে বলা হয় ‘লিচিং’। এতে প্লাস্টিকের মধ্যে মিশে থাকা রাসায়নিক অংশ জলের সঙ্গে মিশতে থাকে। আর সেই জলই পান করেন মানুষ। সরাসরি যোগাযোগের প্রমাণ না পাওয়া গেলেও এই লিচিং-এর ফলে মানুষের দেহে ক্যানসারের মতো রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
১১. পলিব্যাগ ও পলি প্লাস্টিকের পাত্রে দীর্ঘ সময় তরল ও শুকনো যে কোন খাদ্যদ্রব্য বা কোন জিনিস রাখা হলে ট্রেস অ্যামাউন্ট-এ ঢুকে পড়ে। ট্রেস অ্যামাউন্ট বলতে বোঝায় এমন রাসায়নিক যৌগ যা খালি চোখে দেখে বোঝার উপায় নেই। সূক্ষ্ম পরীক্ষায় কেবল শনাক্ত করা যায়। মনে করা হয় পলি প্লাস্টিকের ভেতরে যা রয়েছে তা অবিকৃত। এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। পলি ব্যাগে মাছ-গোশত ভরে ফ্রিজে রেখে দেয়ার পর অনেকটা সময় ধরে একটু একটু করে রান্না করে খেলে কিছুটা টের পাওয়া যায়। স্বাদের পরিবর্তন ঘটায়। যে পরিবর্তন বিষাক্ত টক্সিক।
১২. কিন্তু প্লাস্টিকের বোতল থেকে ফুড কন্টেইনার সব জায়গাতেই থাকে কিছু চিহ্ন, যে চিহ্নতে নির্দিষ্ট করে বলা থাকে কোন বোতল কতদিন ব্যবহার করা উচিত। আর কোন বোতল স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকারক। তবে অজ্ঞতার কারণে বেশিরভাগ সময়ই সেই সব চিহ্নের দিকে আমাদের খেয়াল থাকে না। গ্যালারি থেকে জেনে নিন, কোন চিহ্নের কী অর্থ? প্রতিটি প্লাস্টিকের বোতল বা কন্টেইনারের নীচে ত্রিভুজের মধ্যে কিছু নম্বর দেওয়া থাকে, এই নম্বর-গুলোই নির্দেশ করে কতদিন বা কতবার ওই কন্টেইনারটি ব্যবহার করা বিজ্ঞানসম্মত।
১৩. প্লাস্টিকের বোতল হোক বা কন্টেইনার, কেনার আগে ভালো করে দেখে নিন সেটি আপনার স্বাস্থ্যের জন্য সুরক্ষিত কিনা। প্লাস্টিকের কন্টেইনারের গায়ে বিভিন্ন নম্বর খোদাই করা থাকে। ২, ৪ এবং ৫ নম্বর থাকলে বুঝবেন তা সুরক্ষিত। অন্যদিকে ৩ বা ৭ নম্বর এড়িয়ে চলাই ভালো।
১৫. প্লাস্টিকের বোতলের নিচের বিভিন্ন ত্রিকোণচিহ্নের অর্থ
এটি আসলে প্লাস্টিক বোতলের চারিত্রিক ইনডেক্স। এ চিহ্নটি থাকলে বোঝা যায় বোতলটি বিধিসম্মতভাবে তৈরি। কিন্তু, বোতলটি ব্যবহার কতটা নির্ভরযোগ্য বা কী ধরনের জিনিস তাতে রাখা যাবে, তা ত্রিকোণ চিহ্নের মধ্যে থাকা সংখ্যা দ্বারা বোঝা যায়।
১) ত্রিকোণের মধ্যে ১
এর মানে বোতলটি একবারই মাত্র ব্যবহার করা যাবে এবং বোতলটিতে পলিথিলিন টেরেপথ্যালেট প্লাস্টিক ব্যবহার হয়েছে। এ ধরনের বোতল বহু ব্যবহার স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক।
২) ত্রিকোণের মধ্যে ২
এ ধরনের প্লাস্টিক বোতলে ঘন পলিথিন ব্যবহার করা হয়েছে। মূলত শ্যাম্পু বা ডিটারজেন্ট রাখার ক্ষেত্রে এ ধরনের বোতল ব্যবহার হয়।
৩) ত্রিকোণের মধ্যে ৩
এ ধরনের বোতল বেশি ব্যবহার করা উচিত নয়। কারণ, এ বোতল তৈরি হয় ‘পোলিভিনিল ক্লোরাইড’ বা ‘পিভিসি’ থেকে। এতে ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ‘পিনাট বাটার’ রাখতে এ বোতল ব্যবহার করা হয়।
৪) ত্রিকোণের মধ্যে ৪
এ ধরনের প্লাস্টিক বহু ব্যবহারের উপযোগী। বিশেষ করে, প্লাস্টিকের প্যাকেটে এ চিহ্ন প্রচুর দেখা যায়। খুব দামি বোতলে এই চিহ্ন থাকে।
৫) ত্রিকোণের মধ্যে ৫
এ ধরনের প্লাস্টিক একদম নিরাপদ এবং ব্যবহারযোগ্য। আইসক্রিম কাপ বা সিরাপ-এর বোতল অথবা খাবারের কন্টেইনারে এ ধরনের চিহ্ন দেখা যায়।
৬) ত্রিকোণের মধ্যে ৬
প্লাস্টিকের রেড কার্ড বলা হয় একে। এ ধরনের প্লাস্টিক মারাত্মক ক্ষতিকর। কারণ, এ ধরনের প্লাস্টিক তৈরি হয় পলিস্টিরিন এবং পলিকার্বনেট বিসপেনল-এ। এটি মানুষের মধ্যে হরমোন সমস্যা তৈরি করে। ক্রমাগত এ ধরনের প্লাস্টিকের ব্যবহার ক্যানসারের প্রবণতা বাড়ায়।
আসুন সচেতন হই, নিজের স্বাস্থ্যের জন্য, ভবিষ্যতের জন্য। সামান্য অবহেলা ডেকে আনে মারাত্মক ক্ষতি। প্লাস্টিকের জিনিস ব্যব্যহার করে আমরা নিজেরাই নিজেদের দেহে বিষ ঢুকিয়ে দিচ্ছি। আসুন, প্লাস্টিক পণ্য যতটা সম্ভব উপেক্ষা করে চলি। কাচের বা মাটির জিনিসপত্রের ব্যবহার করা শুরু করি।
ছবি- সংগৃহীত: সাজগোজ