সব পরিবারেরই স্বপ্ন থাকে ঘর আলো করে ফুটফুটে একটি কন্যা বা পুরো বাড়ি তোলপাড় করা এক রাজপুত্র। কিন্তু বাচ্চা কনসিভ করতে ইচ্ছুক অনেক দম্পতিদেরই সঠিক দিক নির্দেশনার অভাবে পড়তে হয় জীবনের নানান বিপর্যয়ের মুখে। একজন ডাক্তার হিসেবে আমি এসকল সমস্যার একজন প্রত্যক্ষদর্শী। অনেকের ধারণা থাকে যে শুধু কম বয়স হলেই বাচ্চা কনসিভ করতে কোন সমস্যা হয় না। অথচ এ ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। ৩ টি ইনফার্টিলিটি কেস স্টাডি নিয়ে আজকের এই ফিচার!
ইনফার্টিলিটি কেস স্টাডি
যেকোনো বয়সেই বাচ্চা নেবার ক্ষেত্রে যে সমস্যা হতে পারে সেরকমই ৩টি ইনফার্টিলিটি কেস নিয়ে আজ আপনাদের সাথে শেয়ার করবো।
কেস-১
রোগীর নাম তানিয়া (ছদ্দনাম), বয়স ২৯। সে এসেছিল ফলিকুলোমট্রি রিপোর্ট নিয়ে। দেখলাম রিপোর্ট সেই একই অবস্থা, তার ওভারিয়ান ফলিকলগুলো ইনজেকশন দেওয়ার পরেও বড় হয় নি, অর্থাৎ রেজিস্টেন্ট হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন সে পলিসিসটিক ওভারিয়ান সিনড্রোম (PCOS)-এ ভুগছিল, এখন আর ফলিকলগুলো কোন ওষুধে বড় হচ্ছে না। উনি গত ১০ বছর যাবত বাচ্চা নেওয়ার চেষ্টা করছে এবং বিভিন্ন ডাক্তার দেখিয়েছিলেন। একের পর এক ওভুলেশন হবার ওষুধ খেয়েছে কিন্তু এই ওষুধে তার ওভারি রেসপন্স করছে কিনা এটা আর দেখা হয় নি।
এভাবেই ব্লাইন্ড ট্রিটমেন্ট চলছিল। এটা শুধু তার ক্ষেত্রেই না, এরকম অনেক পেশেন্টই আসে যারা প্রপার ট্রিটমেন্ট না পেয়ে অনেক মূল্যবান সময় পার করে ফেলে এবং পরবর্তীতে অনেক চেষ্টা চালালেও আর ভালো ফলাফল পাওয়া যায় না। ইনফার্টিলিটি চিকিৎসায় একটি বড় প্রগ্নস্টিক ফ্যাক্টর (Prognostic Factor) হল বয়স, কারণ বয়সের সাথে সাথে ওভারির ফলিকলের সংখ্যা কমে আসে এবং এগুলোর কোয়ালিটিও খারাপ হয়ে যায়। যার ফলে বাচ্চা হবার সম্ভাবনা কমতে থাকে। রিপোর্ট দেখে তাকে বললাম পরবর্তী চিকিৎসা হচ্ছে ল্যাপরোস্কপিক ওভারিয়ান ড্রিলিং (Laparoscopic ovarian drilling) করা, যাতে ওভারির রেসপন্স করার সম্ভাবনা বাড়ে এবং IVF (টেস্ট টিউব বেবী)-এর ব্যাপারেও কাউন্সেলিং করলাম।
এরপরে সে অঝরে কান্না শুরু করে দিল। পেশেন্ট শিক্ষিত হলেও যৌথ ফ্যামিলিতে সময় দিতে গিয়ে নিজের চাকরীর কথা ভাবে নি। অথচ এখন তারা চিকিৎসার ব্যাপারে কোন ধরনের অর্থনৈতিক সাহায্য দিতে রাজি নয়। শুধু শ্বশুর-শাশুড়ি নয়, তার হাসবেন্ড-ও অনেক কটু কথা শুনায় বাচ্চা না হওয়ার জন্য। আমি তাকে অনেক ভাবে সান্তনা দিতে চেষ্টা করলাম, বললাম নিজের সুদৃঢ় আইডেন্টিটি এবং পজিটিভ মনোভাব জীবনে অনেক কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সাহায্য করতে পারে। আর সবকিছু আল্লাহর মর্জির উপর ছেড়ে দিলে অনেক দুশ্চিন্তা লাঘব হয়ে যায়।
কেস-২
রোগীর বয়স ৩৫। বিয়ের প্রথম থেকেই সে বাচ্চা নেয়ার চেষ্টায় ছিল। কিছুদিন পরে কনসিভ হলেও ভাগ্যের পরিহাসে তিন মাসের মধ্যে অ্যাবরশন হয়ে যায়। এরপরে তারা আবারও চেষ্টা চালায় কিন্তু এবার আর কনসিভ হচ্ছিল না। একের পর এক ডাক্তার দেখিয়েছে, ফলপ্রসূ হয় নাই । এদিকে তার প্রতিমাসে পিরিয়ড-এর সময় পেটে ব্যথা এবং রক্তপাত ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। পরিচিত এক আত্মীয়ের মাধ্যমে যখন আমার চেম্বার-এ আসলো তখন তার প্রধান সমস্যা মাসিকের সময় প্রচন্ড তলপেটে ব্যথা এবং প্রচুর রক্তক্ষরণ। ইনভেস্টিগেশন করে দেখলাম হরমোন লেভেল নরমাল এবং ওভুলেশনে কোন সমস্যা নেই, তবে আল্ট্রাসনোগ্রামে অনেকদিন আগে থেকেই তিন থেকে চার সেমির একটি চকলেট সিস্ট (chocolate cyst) পাওয়া যায়, যা এন্ডোমেট্রিওসিস (Endometriosis) রোগের কারণে হয়ে থাকে।
এই কারণে গত ৫-৬ বছর ধরে সে বিভিন্ন ডাক্তারের পরামর্শমত মাঝে মাঝে ওভুলেশন হবার ওষুধ খেলেও তা কোন কাজ করে নি। আমি তাকে এন্ডোমেট্রিওসিস রোগটি কিভাবে কনসিভে বাধা সৃষ্টি করে সেটি বুঝিয়ে বললাম এবং এই সমস্যাটি এখন কোন পর্যায়ে রয়েছে তা ভালোভাবে ডায়াগনোসিস-এর জন্য ল্যাপরোস্কপি করার পরামর্শ দিলাম। এরপর তারা ইন্ডিয়া যাবার সিদ্ধান্ত নিল এবং সেখানেও যখন একই পরামর্শ দেওয়া হলো তখন ল্যাপরোস্কপি করতে সম্মত হল। ল্যাপরোস্কপি করে দেখা গেল ফ্রজেন পেলভিস(frozen pelvis) অর্থাৎ জরায়ু, ওভারি, ফেলোপিয়ান টিউব, ইন্টেসটাইন (নাড়িভুঁড়ি) সবগুলো এমন ভাবে অ্যাডহেশন (একটার সাথে আরেকটা লেগে থাকা) হয়ে ছিল যে কোনোটাকেই আর আলাদা করে চেনা যাচ্ছিল না। এমতাবস্থায় নরমাল ভাবে চেষ্টা করে কোনোভাবেই কনসিভ করা সম্ভব না। আইভিএফ বা টেস্টটিউব বেবি পদ্ধতি এর পরবর্তী চিকিৎসা।
কেস-৩
রোগীর বয়স ২৪, হাজবেন্ডের ২৭- নতুন বিবাহিত দম্পতি। বিয়ের পর বাচ্চা নেওয়ার জন্য এক বছর ট্রাই করে যখন ব্যর্থ হলো তখন তারা বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল এবং একজন ইনফার্টিলিটি বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হলো। সেখানে বেশকিছু টেস্ট করানোর পর চিকিৎসকের সহকারী তাদেরকে ল্যাপরোস্কপিক অপারেশন করার জন্য একটি ডেট দিল। সেইসাথে অ্যানেসথেটিক (অজ্ঞান করার জন্য) ফিটনেস দেখার জন্য কিছু ইনভেস্টিগেশন করতে বলা হল। যেহেতু তারা ভালোভাবে বুঝতে পারল না অপারেশনটা কেন করা হবে তাই তারা পরবর্তীতে আমার চেম্বারে শরণাপন্ন হলো। আমি তাদের পূর্বের ইনভেস্টিগেশনে দেখলাম হাসবেন্ড এবং ওয়াইফ উভয়ের সব রিপোর্ট ভালো আছে, আর বন্ধ্যাত্ব জনিত চিকিৎসা শুরু করার মতো এখনই কোন ইনডিকেশন নাই, তাই তাদেরকে কোন চিকিৎসা ছাড়াই আরো ছয় মাস স্বাভাবিক পদ্ধতিতে বাচ্চা নেয়ার চেষ্টা করতে বললাম। আল্লাহর রহমতে এর ৩-৪ মাসের মধ্যেই তারা কনসিভ করতে সমর্থ হন।
একটি সন্তান পৃথিবীতে আলোর মুখ দেখে বাবা ও মা দুজনের মাধ্যমেই। অথচ আমাদের দেশে মেয়েদেরকেই বন্ধ্যা ও অন্যান্য অনেক কিছু বলা হয়ে থাকে সন্তান না হবার কারণে, এটা কি মানসিকভাবে নেয়া যায় বলুন? না। সঠিক চিকিৎসা ও দিক নির্দেশনা পেলেই ঘোচানো যায় এই শারীরিক বন্ধ্যাত্ব।
ছবি- সংগৃহীত: coloradopaincare
ডাঃ নুসরাত জাহান
অ্যাসোসিয়েট কন্সালটেন্ট অবস-গাইনী
ইমপেরিয়াল হসপিটাল, চট্টগ্রাম।