ওজন বেড়ে যাওয়া বা ওয়েট গেইন আমাদের বেশিরভাগ মানুষেরই চিন্তার একটি মূল কারণ। যে কোন কারণে ওজন বেড়ে যাওয়াটাই যেন আজকাল খুব স্বাভাবিক একটি ব্যপার। ওজন কমে যাওয়ার চাইতে ওজন বেড়ে যাওয়ার হার বেশি পরিলক্ষিত। কারণ ওজন বাড়ার জন্য তেমন কোন কষ্টই করতে হয় না বরং এটি না চাইতেও যেন হুরহুর করে বেড়ে যায়, অন্যদিকে ওজন কমানোর জন্য প্রচুর ডায়েট এবং কসরত করেও লাভ কিন্তু খুব কমই হয়, ওজন যেন কমতেই চায় না। যাই হোক, সার্জারির পেশেন্টদের ক্ষেত্রে ওজন বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা খুব বেশি লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে যারা সম্প্রতি কোন ধরনের অস্ত্রোপচার করেছেন তাদের ক্ষেত্রে ওজন বেড়ে যাওয়ার অর্থাৎ সার্জারির পর ওজন বাড়া ও এর হার তুলনামূলকভাবে বেশি।
সার্জারির পরে অবিলম্বে ওজন বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়। আসলে, এই ওজন প্রায়ই ফলোআপ-এর মধ্যে ঘটে। সার্জারির পর ওজন বৃদ্ধির খুব কমন একটি উদাহরণ হলো, প্রেগন্যান্সি-এর পর ওজন বৃদ্ধি। এক্ষেত্রে তাদের ডেলিভারি সি-সেকশন সাহায্যে ঘটে। এই ক্ষেত্রে, প্রায় ৮০% নারীর সার্জারির পর উল্লেখযোগ্য ওজন বৃদ্ধি ঘটে। অন্যান্য ক্ষেত্রে, যেমন জটিল সার্জারি এমনকি ছোটখাটো টনসিলেক্টোমি-এর মত সার্জারিও ওজন বৃদ্ধির কারণ হতে পারে।
চলুন তাহলে সার্জারির পর ওজন বাড়া যে ৫টি প্রধান কারণে হয়ে থাকে সেগুলো দেখে নেয়া যাক।
সার্জারির পর ওজন বাড়া যে কারণে ঘটে
১. ফ্লুইড রিটেনশন বা তরল ধারণ
সার্জারির পর ওজন বাড়া ও এর একটি প্রধান কারণ হলো সার্জারির পর শরীরে তরল ধারণ করা। একে মেডিকেলের ভাষায় এডিমা (Edema) বলা হয়। পানি জমে যায় আপনার শরীরের অন্তর্বর্তী স্থানগুলোতে- অর্গান-গুলোর মধ্যবর্তী স্পেইস-এ। এই কারণে ওজন বেড়ে যায়। এটি স্থায়ীভাবে থেকে যেতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, দেখা গেল কোন সার্জারির রোগীর হাত এবং পা ফুলে গেছে এটা সাধারণ মনে হলেও এটা তরল স্থানীয়করণের জন্য হয়ে থাকে।
২. ট্রমা (Trauma)
অস্ত্রোপচারের সময়, শরীরের টিস্যুগুলো অনেক মানসিক আঘাত ভোগ করে। এর কারণে ইনফ্লামেশন হয় এবং এটিও তরল ধারণের একটি কারণ। যদি সার্জারি কোন দুর্ঘটনা ঘটার কারণে হয়ে থাকে, তাহলে তা তরল ধারণের ক্ষেত্রে আরো বেশি সম্ভাবনাময় হয়ে থাকে। তাই কোন দুর্ঘটনাব্যতীত সার্জারি হলে তাতে ট্রমা-এর প্রভাব পড়ে এবং ওজন বৃদ্ধি পায়।
৩. চাপ (Stress)
স্ট্রেস হলো হরমোনাল ভারসাম্যহীনতার একটি প্রধান কারণ যা শরীরকে অত্যধিক তরল ধারণ করার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। সার্জারি সম্পর্কিত চাপের ফলে অ্যান্টি-ডায়োরেটিক হরমোন (Anti-diuretic hormone- ADH) হাই লেভেলে পৌছে যায় যা কিডনিকে শরীরের অতিরিক্ত পানি সংরক্ষণ করার জন্য তৈরি করে। এই কারণে অযৌক্তিকভাবে শরীরে ওজন লাভ হয়। এছাড়াও অস্ত্রোপচারের পর, রোগী সার্জারির আগের সমস্যা দূর করার জন্য সার্জারির পর অনেক সময় তাদের ঔষুধ মিশ্রণের ফলে শরীরে অনেক পরিবর্তন দেখা দেয় যা তরল ধারণের জন্য অনেকাংশে দায়ী। এটি ওজন বেড়ে যাওয়ার একটি অন্যতম কারণ।
৪. স্থিরতা
অস্ত্রোপচারের পর, সাধারণত রোগীদের জন্য খুব বেশি কাজ করা বা শারীরিক কসরত করা নিষেধ থাকে। তাদের খুব কম নড়াচড়া করতে বলা হয়ে থাকে। এই কারণে রোগীদের স্বাস্থ্য বেড়ে গিয়ে খুব দ্রুত ওজন বৃদ্ধি ঘটে থাকে। তাই এক্ষেত্রে ডাক্তারদের পরামর্শ থাকে, রিকোভারি পিরিয়ড শেষ হয়ে গেলে রোগী যেন হালকা ব্যায়াম করে এতে তার পোস্ট-সার্জারি ডিপ্রেশন কাটিয়ে ওঠা সহজ হয়ে উঠে।
৫. কমফোর্ট ফুড
এটি ওজন বেড়ে যাওয়ার আরেকটি মেজর ফ্যাক্টর। এক্ষেত্রে দেখা যায়, রোগী ভাবেন যে সার্জারির পর তার বেশি বেশি খেতে হবে শরীর দ্রুত সুস্থ হওয়ার জন্য। এছাড়াও এমনও দেখা যায় যে রোগীর আত্মীয়স্বজন রোগীকে দেখতে আসেন বিভিন্ন ধরনের খাবার-দাবার নিয়ে। এতে রোগী প্রচুর পরিমাণে রিচ ফুড বা ওয়েট গেইন হওয়ার মত ক্যালরি খেয়ে ফেলেন নিজের অজান্তেই। এতেও দ্রুত ওজন বেড়ে যেতে দেখা যায়।
কিভাবে এই ওজন কমানো যেতে পারে?
অস্ত্রোপচারের পরে ওজন বেড়ে যাওয়া কিছুটা স্বাভাবিক। কিন্তু সেটা ১ সপ্তাহে ৫-৬ পাউন্ডের বেশি নয়।
১) যদি রোগীর ওজন আরো দ্রুত বৃদ্ধি পায়, তাদের ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত। সাধারণত, একটি রোগীর সার্জারির পর বেশি বেশি ক্ষুধা পায় এবং শরীর দুর্বল মনে হয়। এটি স্বাভাবিক হতে এক সপ্তাহ বা এর বেশি সময় ও লাগতে পারে। তাই এই সময় বেশি বেশি খেতে চাওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে, এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে অস্বাস্থ্যকর খাবার এড়িয়ে চলা উচিত এবং উচ্চ ক্যালোরি সম্পন্ন খাবার সঠিক মাত্রায় গ্রহণ করা উচিত।
২) এছাড়াও পরিমিত ক্যালোরি এবং সুষম খাবারের পাশাপাশি ডাক্তারগণ হালকা ব্যায়াম করার পরামর্শ ও দিয়ে থাকেন। এমনকি যাদের তলপেটে সার্জারি হয়েছে, তাদেরকেও নির্দিষ্ট সময়ের পর সম্পূর্ণ বসে থাকতে বারন করেন। এমনকি যাদের তলপেটে অপারেশন হয়েছে তাদেরকেও পেটে হালকা চাপ দিয়ে ব্যায়াম করতে বলেন যাতে শরীর ফিট থাকে।
৩) সর্বোপরি, প্রচুর পরিমাণে পানির পানি পান করা অবশ্যই কর্তব্য। কারণ ওজন কমানোর জন্য পানির কোন বিকল্প নেই। তাছাড়াও সঠিক পরিমাণে পানি পান করলে এটি ফ্লুয়িড রিটেনশান হতে বাঁধা প্রদান করে তাই অতিরিক্ত ওজন বেড়ে যেতে পারেনা। এর কারণ হলো, শরীর পর্যাপ্ত পরিমানে পানি পেলে কিডনিতে সংকেত পাঠায় এবং কিডনি অতিরিক্ত পানি কনসার্ভ করা থেকে বিরত থাকে।
সার্জারির পর ওজন বাড়া অনেক কারণে হতে পারে তবে উপরিউক্ত ৫টি কারণই হলো সার্জারির পর ওজন বৃদ্ধি পাওয়ার প্রধান কারণ। তাই সার্জারির পরে আপনার ডাক্তারের পরামর্শমত জীবনযাপন করুন এবং পরামর্শব্যতীত কোন কাজ করবেন না কারণ এই সময়টিতে শরীর খুব দুর্বল থাকে। এছাড়াও পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণ করুন এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করুন। খুব সাধারণ কিছু নিয়ম মেনে চললেই আপনার শরীর থাকবে ফিট এবং আপনি থাকবেন সুস্থ।
ছবি- সংগৃহীত: সাটারস্টক