ঘুম আপনার, আমার সবার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি জিনিস। প্রতিদিন কাজ কর্ম শেষ করে রাতে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়ার মধ্যে যে প্রশান্তি, তা হয়তো অন্য কিছুতে পাওয়া কষ্টকর! একটি ভালো ঘুম, ইংরেজিতে যাকে আমরা বলি Safe and Sound Sleep আপনার শরীরকে চাঙ্গা করে তুলতে মূল ভূমিকাটি পালন করে। একটি মানুষের শরীরের বৃদ্ধি, হজম ক্রিয়া ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কার্যকলাপ ঘুমের মধ্যেই বেশি হয়। ঘুমের যত গল্প গাঁথা জেনে নিন!
রাতে ভালো ঘুম হয় না, এমন মানুষ খুঁজলে আশেপাশে প্রচুর পাওয়া যাবে। ঘুম না আসা, পাতলা ঘুম, মাঝরাতে হঠাৎ জেগে যাওয়া এই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় অনেককেই। তাই, ভালো ঘুমের জন্য যদি কিছু নিয়ম অনুসরণ করেন তাহলে এই ধরনের সমস্যাগুলো থেকে সহজেই মুক্তি পাওয়া সম্ভব। আমার এই লেখাটি কিঞ্চিৎ বড় হলেও কথা দিচ্ছি, আপনার ঘুমানোর ক্ষেত্রে আমার লেখাটি বেশ কাজে দেবে।
প্রথম ধাপ – আপনার বিছানা ও শোবার ঘরের পরিবেশ ঘুমানোর উপযোগী করে তুলুন
আপনার ঘুমের জন্য সবার আগে যেটা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে উপযুক্ত পরিবেশ। তাই সবার আগে বেডরুমে অফিসের বা কর্মক্ষেত্রের কাজ, কম্পিউটারের ব্যবহার, টিভি দেখা, ফোনে কথা বলা, খাওয়া, ব্যায়াম করা কিংবা অন্য যে কোন ধরনের ক্রিয়া কলাপ বন্ধ রাখুন। শুধু মাত্র বই পড়া, হালকা লো ভলিউম মিউজিকের ব্যাবস্থা থাকতে পারে।
এরপর শোবার ঘরকে গোছানোর দিকে মনোযোগ দিন। ঘরের আসবাবপত্র, বিছানা, অন্যান্য জিনিস গুছিয়ে রাখুন। শোবার ঘরে ধুলোবালি, আবর্জনা, কাগজ, ময়লা প্লেট, গ্লাস এগুলো থেকে পরিষ্কার রাখবেন। এছাড়াও শোবার ঘরে ইঁদুর, তেলাপোকা জাতীয় প্রাণী ও পোকামাকড় যাতে প্রবেশ না করতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন। কারণ শোবার ঘর ও বিছানা যদি গোছানো এবং পরিষ্কার থাকে তাহলে ঘুমানোর ইচ্ছেটা বেশি হয়।
আপনার শোবার ঘরে সৌন্দর্যবর্ধক জিনিস ব্যবহার করতে পারেন। যেমন বেডসাইড টেবিলে একটা ছোট ফুলদানি, দেয়ালে নান্দনিক পেইন্টিং জাতীয় কিছু। শোবার ঘরে হালকা বেলী ফুল জাতীয় এয়ার ফ্রেশনার ব্যবহার করতে পারেন। তবে মনে রাখবেন, কোন কিছুই যাতে বেশি কড়া না হয় বা দৃষ্টিকটু না লাগে।
এরপর ঘরের আলো কমানোর ব্যাবস্থা করুন। কারণ আলোতে কারোই ঘুম ভালো হবে না। ঘুমানোর আগে বাতি নিভিয়ে দিন। এছাড়া ঘরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করুন। বেশি গরম বা বেশি ঠান্ডায় আপনি ঘুমাতে পারবেন না। এর জন্য দরকার হলে গরমে ঘরে ফ্যানের স্পিড বাড়িয়ে দিন, এসি থাকলে এসি ছেড়ে দিন। আর শীতে পর্যাপ্ত কাঁথা, লেপ কিংবা কম্বল নিয়ে ঘুমান যা আপনার শরীরকে ঘুমানোর সময় উষ্ণ রাখবে।
আর সবশেষে আপনার বিছানা ঠিক করুন। বিছানায় যে ম্যাট্রেস ব্যবহার করছেন সেটা আপনার শরীরের সাথে মানাচ্ছে কি না এটা দেখা জরুরী। কারণ বিছানা অধিক শক্ত বা অধিক নরম হলে আপনি ঘুমাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন না। তাই আপনার সাথে যে ধরনের ম্যাট্রেস উপযোগী সেটাই নির্বাচন করুন।
দ্বিতীয় ধাপ – ঘুমানোর আগে খাবার গ্রহণে সাবধান হোন
ঘুমানোর আগে খুব বেশি খাবার গ্রহণ না করাই শ্রেয়। যতটুকু প্রয়োজন, তার বাইরে বেশি খাবার গ্রহণ আপনাকে অসুস্থ করে ফেলতে পারে। বেশি ঝাল মশলা যুক্ত খাবার না খাওয়ার চেষ্টা করুন। অনেকেই মশলাযুক্ত খাবার বেশি পছন্দ করেন। খাবার পছন্দ করাতে দোষ নেই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সেই খাবার যদি আপনাকে রাতে অস্বস্তিকর অনুভূতি প্রদান করে তবে অবশ্যই রাতে এই ধরনের খাবার গ্রহণের আগে দ্বিতীয়বার চিন্তা করা উচিত। কারণ এই ধরনের খাবারে প্রচুর গ্যাস সৃষ্টি হয়, যা অ্যাসিডিটি জাতীয় অসুস্থতার জন্ম দিতে পারে।
রাতে বেশি খাওয়া যেমন উচিত নয়, তেমনি না খেয়ে ঘুমাতে যাওয়াও শরীরের জন্য বেশ ক্ষতিকর। কারণ না খেয়ে ঘুমালে কিছুক্ষণ পর পর আপনার পাকস্থলী আপনাকে খাদ্য গ্রহণের জন্য তাড়া দেবে। যার কারণে আপনি ঘুমাতে পারবেন না। খিদে পেটে ঘুমানো যায় না এটা আমরা সবাইই জানি। তাই রাতে প্রয়োজনীয় খাবার গ্রহণ করুন।
ঘুমানোর আগে কখনোই চা কিংবা কফি পান করবেন না। চা, কফি ঘুম নষ্ট করে। এই দুইটি পানীয়ের মধ্যে ক্যাফেইন থাকে যা মস্তিষ্ককে উত্তেজিত করে রাখে। একবার কফি পান করলে তার ক্যাফেইনের প্রভাব ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত থাকতে পারে। তাই রাতে ঘুমানোর আগে কখনোই চা, কফি পান উচিত নয়! তবে রাতে ঘুমানোর আগে এক গ্লাস গরম দুধ কিংবা হারবাল চা আপনাকে ঘুমাতে সাহায্য করবে।
রাতে ঘুমানোর আগ মুহূর্তে কখনোই পানি পান করবেন না। কারণ এর কারণে ঘুমানোর পর আপনার বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন পড়তে পারে। আর ঘুমানোর পর পর এভাবে ঘুম ভেঙ্গে গেলে আবার ঘুম ফেরত আনা খুবই কষ্টকর বিষয়। তাই রাতে ঘুমানোর ১ ঘণ্টা আগে শেষবারের মত পানি পান করে নিন।
তৃতীয় ধাপ – আপনার শরীর ও মনকে ঘুমের জন্য প্রস্তুত করুন
ঘুমানোর জন্য শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি নেয়াটা অত্যন্ত জরুরী। রাতে ঘুমানোর আগে শাওয়ার নিতে পারেন। এতে শরীর ফ্রেশ থাকবে। এছাড়া শাওয়ারের পর বিছানায় শুলে স্বাভাবিকভাবেই একজন মানুষের ঘুম আসে। পরিসংখ্যান বলে যে সাধারণ ১৭ থেকে ২৩ বছর বয়সী এবং ৬৭ থেকে ৮৩ বছর বয়সী মানুষদের ক্ষেত্রে রাতে গোসল করে বিছানায় যাওয়া বেশ ভালো উপকারী।
রাতে ঘুমানোর জন্য ঢিলেঢালা পোশাক ব্যবহার বাঞ্চনীয়। ভারী এবং টাইট পোশাক আপনাকে অস্বস্তিকর অনুভূতিতে ফেলবে। যার কারণে রাতে ঘুমানো কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে। তাই ঘুমানোর জন্য সুতি পায়জামা, ঢিলেঢালা শার্ট জাতীয় পোশাক ব্যবহার করতে পারেন।
উজ্জ্বল আলো আপনার শরীরকে বিভ্রান্ত করে। আপনার ইন্দ্রিয় সেটাকে দিনের আলো ভাবতে থাকে। যার কারণে উজ্জ্বল আলোর মাঝে ঘুমানো কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। আপনি আলো জ্বেলে রেখে ঘুমাতে গেলে মস্তিষ্ক সেটাকে দিনের আলো ধরে নেবে, এবং আপনাকে ঘুমাতে বাধা দেবে। তাই ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয়া শুরু করলেই ঘরের আলোর উজ্জ্বলতা কমিয়ে দিন।
বিছানায় শোয়ার আগে আপনার ঘরের আলো একেবারেই নিভিয়ে দিন। কারণ অন্ধকারে শরীর ঘুম উৎপাদনকারী হরমোন নিঃসরণ করে। ঘরের জানালার পর্দা ফেলে দিন, যাতে বাইরের আলো ঘরে না ঢুকতে পারে। তবে যদি একদম সমস্যা হয় তাহলে হালকা আলোর ডিম লাইট ব্যবহার করতে পারেন। এছাড়া ঘরে কম্পিউটার, ট্যাবলেট থাকলে সেগুলো শাট ডাউন করে দিন। সেলফোন ভাইব্রেট মোডে কিংবা সাইলেন্ট মোডে রাখুন। যাতে কোন কল আসলেও তার উচ্চ শব্দ উৎপাদনকারী রিংটোন আপনার ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটায়।
চতুর্থ ধাপ – শুয়ে পড়ুন বিছানায়
প্রস্তুতি শেষ হয়ে গেলে আর দেরী কেন? শুয়ে পড়ুন বিছানায়! পরদিনের জন্য অ্যালার্ম দিয়ে রাখুন যাতে সময় মত উঠতে পারেন।
ঘুমানোর পূর্বে চোখে আই পিলো ব্যবহার করতে পারেন। এগুলো এক ধরনের চোখের মুখোশ, যা আপনার চোখকে ঘুমানোর সময় ঢেকে রাখবে। বিছানায় শোয়ার পর বড় করে নিঃশ্বাস নিন, আপনার শরীরকে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ করুন। যাতে শরীর প্রশান্ত হতে পারে।
এছাড়াও ঘুমানোর মুহূর্তে হালকা মিউজিক শোনার অভ্যাস করতে পারেন। এতে আপনার মন প্রশান্ত হবে। যা ঘুমের জন্য বিশেষ ভাবে জরুরী।
ঘুমানোর পজিশন নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। তবে ঘুমানোর জন্য সঠিক পজিশন বেছে নেয়া জরুরী। ঘুমানোর জন্য আপনার শরীরকে সোজা রাখুন। ঘাড় এবং মাথা যাতে উঁচু নিচু না থাকে। রাতে ঘুমানোর জন্য কোলবালিশ খুবই উপকারী। তাই কোলবালিশ ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে তুলুন। যদি কোল বালিশ না থাকে তবে পায়ের নিচে একটি বালিশ রাখুন। এতে কোমরের ভার কম থাকবে। উপুড় হয়ে ঘুমানোর অভ্যাস পরিহার করুন। কারণ বুকে ভর দিয়ে ঘুমালে ব্যথা হতে পারে। যদি সেভাবে ঘুমানোর অভ্যাস থেকেই থাকে, তাহলে নিচে একটি বালিশ রাখুন। এতে বুকের পেশীতে চাপ কম পড়বে।
পঞ্চম ধাপ – নিয়মিত রুটিন গড়ে তুলুন
প্রতিদিন একই নিয়ম অনুসরণ করলে আপনার ভালো ঘুমের অভ্যাস গড়ে উঠবে সহজেই! তবে এখানে কিছু ব্যাপার আছে। আপনার যদি ঘুমাতে ৩০ মিনিটের বেশি সময় লাগে, কিংবা মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায়, তাহলে বুঝতে হবে আপনি স্বাভাবিকের চাইতে বেশি ঘুমাচ্ছেন। সেটা পরিহার করার চেষ্টা করবেন। প্রতিদিন শরীরকে ৮ ঘণ্টা ঘুমানোর সুযোগ দিন। এর বেশি নয়!
এছাড়া নিয়মিত এক্সারসাইজ করুন। শরীরে জমা হওয়া শক্তি খরচ হতে দিন। সাঁতার কাটুন, দৌড়ান, সাইক্লিং করুন। অফিস কিংবা কর্মক্ষেত্রে লিফটের পরিবর্তে সিঁড়ি ব্যবহার করুন। মস্তিষ্ককে কাজে লাগান। সময়মতো খাবার গ্রহণ করুন। শরীরকে ক্লান্ত করুন, এতে করে রাতে ঘুমানো সুবিধাজনক হবে।
তবে মনে রাখবেন, রাতে ঘুমানোর আগে ২ ঘন্টার বেশি এক্সারসাইজ করবেন না। তবে মেডিটেশন করতে পারেন, বা ইয়োগা জাতীয় এক্সারসাইজ করতে পারেন। এতে মস্তিষ্ক শান্ত হবে, মন প্রশান্ত হবে।
ঘুমানোর জন্য যদি এই নিয়মগুলো অনুসরণ করেন, তাহলে ঘুম আসাটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। তবে এরপরেও যদি আপনার ঘুমাতে সমস্যা হয় তাহলে আপনার ডাক্তারের পরামর্শ নিন। চাইলে মেন্টাল কাউন্সেলিং করাতে পারেন। হালকা ডোজের ঘুমের ওষুধ গ্রহণ করতে পারেন তবে সেটা অবশ্যই ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী।
মনে রাখবেন, আমাদের জন্য ঘুম অত্যন্ত মূল্যবান। সুতরাং সেটা যাতে ঠিকমত হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা জরুরী!
লিখেছেনঃ ফরহাদ রাকিব
ছবিঃ jooinn.com