কাগজের সাথে আমার সখ্য খুব বেশিদিনের নয়। বছর দুয়েক আগে হুট করেই আবিষ্কার করলাম গুণহীন এই মানুষটা কার্ড বানাতে খুব আনন্দ পাচ্ছে। একের পর এক শুধু বানিয়েই যাচ্ছি। যাচ্ছিতো যাচ্ছিই, থামার যেন আর নাম নেই। ধীরে ধীরে কাগজের প্রতি নেশা বাড়তে থাকল। শেখার নেশায় অন্তর্জালের এপিঠ থেকে ওপিঠ দাবড়ে বেড়াতে থাকি সারাক্ষণ। নতুন এক জগত খুঁজে পেলাম যেন। সেখানে ক্ষুদ্র পোকামাকড় থেকে শুরু করে একটা গোটা পৃথিবীই যেন বানিয়ে ফেলা যায় কাগজ দিয়ে এক নিমেষেই! অদ্ভুত বিস্ময় নিয়ে দেখলাম কাগজ শিল্পের কতরকম রূপ হতে পারে, কত রকমভাবেই না কাগজকে বানানো যায় হাঁস, হাঁস থেকে সজারু!
সেই কবেকার কথা। প্যাপিরাস গাছের পাতায় লেখা হত মিশরে। প্যাপিরাস থেকে ধীরে ধীরে তৈরি হল ‘পেপার’। শুধু লেখায় আবদ্ধ না থেকে কাগজ একসময় পরিণত হল একটি আলাদা শিল্পে। সে শিল্পের জগত দিনে দিনে আরও বিস্ময় তৈরি করছে। বিস্ময় সৃষ্টিতে বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই কিন্তু!
আমি যখন কাগজ নিয়ে কাজ করতে শুরু করি,তখন আমার মত আর কেউ নেই ভেবে খুব মন খারাপ হত। কিন্তু ধীরে ধীরে আবিষ্কার করলাম অনেকেই আছে এবং কাগজ শিল্পের অনেক অলিগলি তাদের জানা! নতুন করে জানতে শুরু করলাম যে কাগজ দিয়ে কত কী করা যায়! সে জানা এখনও চলছে।
বাংলাদেশে কাগজ শিল্পের কয়েকটি জনপ্রিয় ধরন নিয়ে আজ কথা বলব। দেশি শিল্পীরা কিন্তু মোটেও পিছিয়ে নেই সেসব থেকে!
অরিগ্যামিঃ
এটি জনপ্রিয় একটি কাগজ শিল্পের নাম। জাপানে এর উৎপত্তি হয় সর্বপ্রথম। জাপানি শব্দ ‘Ori’ এর অর্থ হল ‘ভাঁজ করা’ আর ‘Kami’ অর্থ ‘কাগজ’। ‘Orikami’ থেকেই ‘Origami’. অর্থাৎ কাগজকে ভাঁজ করে যে শিল্প, সেটাই আসলে অরিগ্যামি। বড় আনন্দের এই কাগজ ভাঁজ করার খেলা। ছোট্ট চারকোণা একটি কাগজকে ভাঁজ করে করে কী বিশাল যজ্ঞ যে তৈরি করা যায়, সে না দেখে বিশ্বাস হওয়ার নয়! অরিগ্যামিতে আমি আমার আদর্শ হিসেবে যে দু’জন শিল্পীকে মানি, তারা হলেন জাপানি শিল্পী জো নাকাশিমা ও আমেরিকান শিল্পী জেরেমি শেফার। মুগ্ধ হয়ে আমি তাদের অরিগ্যামির জাদু দেখি!
অরিগ্যামিতে আমাদের সিলেটের তাসনিয়া মতিনও কিন্তু ছাড়িয়ে যাচ্ছেন কখনও কখনও নিজেকেই! তার কাজের বিশেষত্ব হল অরিগ্যামিতে প্রকৃতি ও দেশিয় উপাদানকে ফুটিয়ে তোলা।
ছবিতে পত্রিকার কাগজ দিয়ে বানানো খাঁচায় দুটি অরিগ্যামি পাখি। অতি অসাধারণ একটি সৃষ্টি, আমার খুব পছন্দের। উৎসঃ তাসনিয়ার ফ্যানপেইজ ‘খেয়াল-পেপার ক্র্যাফটস’।
বাংলাদেশে অরিগ্যামির আরেকটি জনপ্রিয় ধারা হচ্ছে থ্রি-ডি অরিগ্যামি। থ্রি-ডি অরিগ্যামির ব্যাপারটা হচ্ছে, সাধারণ অরিগ্যামি দিয়ে কতগুলো ছোট ছোট টুকরো তৈরি করা হয়, যা থ্রি-ডি অরিগ্যামির ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পরবর্তীতে সেসব ছোট ছোট অরিগ্যামিকে জোড়া দিয়ে নানারকম আকৃতি দিয়ে কী না বানানো যায়! ঘর সাজাতে শো-পিস হিসেবে এর জুড়ি মেলা ভার।
থ্রি-ডি অরিগ্যামিতে মেধার ছাপ রেখে যাচ্ছেন আমাদের দেশের শিল্পী নাহিদা পারভিন। অত্যন্ত পরিশ্রম ও ধৈর্য্যের এ কাজটিকে ভালোবেসে তিনি নিয়ে গেছেন অন্য এক মাত্রায়। নিপুণ হাতে একের পর এক তৈরি করে চলেছেন প্রকৃতির সুন্দরতম নিদর্শনলোকে শুধুমাত্র টুকরো টুকরো অরিগ্যামিগুলোকে জোড়া লাগিয়ে লাগিয়ে!
ছবিতে নাহিদা পারভিনের তৈরি একটি ত্রিমাত্রিক মা মাছ ও শিশু মাছ। উৎসঃ “নাহিদা’স অরিগ্যামি ওয়ার্ল্ড” ফ্যানপেইজ।
কিরিগ্যামিঃ
কিরিগ্যামিও একটি জাপানি কাগজ শিল্পের নাম। ‘Kiru’ অর্থ কাটা আর ‘Kami’ অর্থ হল কাগজ। ‘Kirukami’ থেকেই ‘Kirigami’। মূলত কিরিগ্যামি অরিগ্যামির মতই, তবে অরিগ্যামিতে শুধুই ভাঁজ করতে হয়, কোন কাট-পেস্টের ব্যাপার থাকে না আর কিরিগ্যামিতে কাগজ কেটে সেটিকে অন্য কোন ব্যাকগ্রাউন্ডে পেস্ট করার একটি বিষয় আছে। কিরিগ্যামিরও বেশ কিছু ধারা আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ধারাটি হল স্নোফ্লেক্স। কাগজকে ভাঁজ করে ইচ্ছেমত কেটে-কুটে ভাঁজ খুলে দিলেই অদ্ভুত সুন্দর সব প্যাটার্ন তৈরি হয়ে যায়! সেগুলোকে কার্ড বানানোর সময় স্ট্যাম্পিঙের কাজে বা গিফট প্যাকেজ অথবা যেকোন কাগজের সাজ-সজ্জার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়।
অরিগ্যামিক আর্ক্টিটেকচার নামে আরেকটি ধারা আছে কিরিগ্যামির। সাধারণত পপ-আপ কার্ড হিসেবে এই শিল্পের ব্যবহার খুব চোখে পড়ার মত। এখানে কাগজকে কেটে স্থাপত্য, জীব-জন্তু বা যেকোন কিছুর একটি ত্রি-মাত্রিক রূপ দেয়া হয়। তাছাড়া এটি অরিগ্যামি ও কিরিগ্যামির একটি মিশেলও বলা চলে!
ছবিতে নবীণ পপ আপ শিল্পী ইমা নায়েরার করা একটি মজার কাজ তার পেইজ “দ্য পপ আপ ফ্যাক্টরি” থেকে নেয়া! কার্ডের ভেতরে একটি থ্রি-ডি বার্থডে কেক করা হয়েছে।
কুইলিংঃ
এটি আমার নিজের অত্যন্ত পছন্দের একটি কাগজ শিল্প। ইচ্ছেমত মাপে কাগজের অনেকগুলো স্ট্রাইপ কেটে নিয়ে সেগুলোকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নানানরকম আকার দিয়ে যে শিল্প,সেটিই কুইলিং। রেনেসাঁর যুগে ফরাসি ও ইতালিয় নানরা ধর্মীয় গ্রন্থের প্রচ্ছদ সাজাতে কুইলিং ব্যবহার করতেন। রাশিয়ান কুইলিং শিল্পী ম্যানুয়েলা কুশ আমার কুইলিঙের আদর্শ। তবে আমাকে প্রথম কুইলিং কী জিনিস তা চিনিয়েছিলেন শারমিন হোসেন। অসম্ভব মেধাবী ও নিপুণ এই শিল্পীর কাজ প্রথম দেখাতেই আমাকে বিমোহিত করে দিয়েছিল।
এছাড়াও থ্রি-ডি কুইলিংও হয়। তা দিয়ে পুতুল,জীব-জন্তু এমন কী গহনাও তৈরি করা যায়!
ছবিতে আমার নিজের তৈরি করা থ্রি-ডি কুইলিং পুতুল।
মিক্স-মিডিয়াঃ
এই শিল্পে কয়েক ধরনের কাগজ বা বোতাম, শুকনো ফুল, চুমকি, রং, সুতা বা কাপড় ইত্যাদি অনেক কিছু ব্যবহার করে একটি ছবির মত করে ফুটিয়ে তোলা হয়। স্ক্র্যাপবুকে সাধারণত এই মিক্স মিডিয়াই ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
ছবিতে আমার তৈরি করা একটি স্ক্র্যাপবুক, যেখানে কাগজ, কাপড়, তার, পুঁতি, কাঁচ, বোতাম, চুমকি, ফিতে ইত্যাদি অনেক কিছু ব্যবহার করেছি। আমার পেইজ “প্যাপিরাস” এ গেলে আরও অনেক মিক্স মিডিয়ার কাজ দেখা যাবে।
পেপার ম্যাশেঃ
কাগজের মণ্ড দিয়ে নানান ধরনের জিনিস তৈরি হয় এই শিল্পে। কাগজকে কিছুদিন ভিজিয়ে রেখে দিলে এই মণ্ড তৈরি হয়। সাথে আটা কিংবা ময়দা দিয়ে আরও মজবুত করা যায় মণ্ডকে। এরপর সেটি দিয়ে হ্যান্ড-মেইড কাগজ থেকে শুরু করে আসবাবও তৈরি করে ফেলা যায়!
চিত্রে হ্যান্ড-মেইড কাগজের তৈরি নোটবুকের মলাট। উৎসঃ বিমূর্ত
এই হচ্ছে আমাদের দেশের কাগজ শিল্প চর্চার একটি ক্ষুদ্র চিত্র। কাগজশিল্পের আরও অনেক অনেক ধারা আছে। ধীরে ধীরে সেসবও আমাদের শিল্পীরা রপ্ত করে নেবেন বলেই আমার ধারণা। কাগজের পৃথিবীতে আপনাকেও স্বাগতম!
লিখেছেনঃ নুজহাত ফারহানা
ছবিঃ প্যাপিরাস, খেয়াল-পেপার ক্র্যাফটস, বিমূর্ত, দ্য পপ আপ ফ্যাক্টরি, নাহিদা’স অরিগ্যামি ওয়ার্ল্ড