আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় প্যারেন্টিং। শিরোনাম দেখে ভ্রু কুঁচকানোর অনেক কারণ আছে। একটা বলি। বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ বাবা-মা, চারদিকে অযুত নিযুত উপদেশ। এর মধ্যে নতুন একজন উপদেশদাতাকে ধর্তব্যের মধ্যে আনার কোন কারণ নেই। তবে একটা ব্যাপার, যেখানে দেখিবে ছাই নীতিতে আপনি যদি কোনমতে লেখাটার শেষ পর্যন্ত যেতে পারেন আর নতুন কিছু খুঁজে পান, তাহলে সেটা হবে একটা সাফল্য, আপনার আমার দুজনের জন্যই। আমরা যেই বিষয়টাকে খুব সহজভাবে নিই, সেই অবিভাবকত্ব একটা বিশাল গবেষণার বিষয় উন্নত বিশ্বে। হবে না কেন? বাচ্চারা বাবা মায়ের জিম্মায় থাকে বড়জোর আঠারো থেকে পঁচিশ বছর, তারপরই তারা সম্পূর্ণভাবে নিজেদের জগত নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সেই জগতে তারা কেমন করবে সেটা নির্ধারিত হয় তাদেরকে কি শেখানো হয়েছে তার ওপর (মতান্তরে তারা কি চর্চা করছে তার ওপর, অনেক সময়ই শিক্ষা আর চর্চার মধ্যে বিশাল পার্থক্য রয়ে যায়)।
বাবামায়ের ভুল বাচ্চার জীবনে অনেক শক্তিশালী ঋণাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে, তাদের ‘মানুষ’ হয়ে ওঠার পথে পর্বতপ্রমাণ বাধা হয়ে উঠতে পারে, কখনো কখনো জীবনকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিতে পারে। এই অঘটনগুলো যাতে না ঘটে, আজকের বাচ্চারা বড় হয়ে যেন শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয় এবং সম্পূর্ণ স্বাবলম্বী জীবনযাপন করতে পারে সেই নিয়ে গবেষণাটা খুব শক্তভাবে হওয়া উচিৎ, আমার নিজের অন্ততঃ সেই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। আজ কোন খুঁটিনাটি আলোচনা করছি না। আপাতঃদৃষ্টিতে খুব সাধারণ কিছু বিষয়, যেগুলো আমরা মোটামুটি অবহেলায় সরিয়ে রাখি, সেরকম কয়েকটি ব্যাপার তুলে ধরতে চাই। এখানে বলে রাখা ভালো, লেখক কোন বিশেষজ্ঞ নন, অনলাইন অফলাইনে কিছু পড়াশোনা আর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, এটুকুই তার সম্বল। পাঠকের সম্পূর্ণ অধিকার আছে অগ্রাহ্য কিংবা দ্বিমত করার, প্রয়োজনে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করার। বাবা মা সন্তানের ভালো চান এটা মোটামুটি ধ্রুব সত্য। কিন্তু তাঁরা যেটাকে ভালো বলে মানেন, সেটা আসলেই ভালো কিনা সেটা সময়ে সময়ে বিরাট প্রশ্নসাপেক্ষ। সব মানুষের জ্ঞানের মাত্রা এক নয়, পড়াশোনা এক নয়, পরিবেশ এক নয়, অভিজ্ঞতা সমান নয়। অথচ বাচ্চাদের পরিপূর্ণ বিকাশের রাস্তাটা বিশ্বজুড়ে কমবেশি একই রকম। মাঝে মাঝে বাবা মায়েরও সন্তান লালনপালনে ‘ভুল’ হতে পারে। কিরকম ভুল? আসুন দেখি প্যারেন্টিং করার সঠিক উপায়।
প্যারেন্টি ভুল করতে করতে শেখা
১) খুব দ্রুত প্রশংসা বা তিরস্কার করে ফেলা
বাচ্চারা সারাক্ষণ কিছু না কিছু করছে। সচেতন বাবা-মায়েরা জানেন বাচ্চাদেরকে কাজে উৎসাহ না দিলে বা তিরস্কার করলে তারা উদ্যমটা হারিয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু আপনি যদি খুব দ্রুত রিঅ্যাক্ট করেন তাহলে কি হবে? ধরুন বাচ্চা লেগো টাইপের জিনিস দিয়ে খেলছে। কিছু একটা বানাচ্ছে। আপনি হয়তো কোন কাজে হাত দেবেন এক্ষুনি এবং সেটা শেষ হতে সময় লাগবে। তাই বানানোর মাঝামাঝি অবস্থাতেই বিশাল একটা প্রশংসা করে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আপনার বাচ্চা কিন্তু ভেবে বসলো সে বিশাল কিছু করে ফেলেছে। ফলাফল, সে হয়তো আরও জটিল কিছু বানানোর পরিকল্পনা করছিলো, যথেচ্ছ প্রশংসা পেয়ে অল্পতেই থেমে গেলো।
মূল সমস্যা আসলে এটা নয়। সমস্যা হচ্ছে, বাচ্চারা যখন খুব সহজে প্রশংসা পায়, তখন তারা এটাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। সে যা যা করে সব কিছুর জন্য সে একধরনের অনুমোদন খোঁজে। কাঙ্ক্ষিত প্রশংসা না পেলে মনে করে সে আর আগের মত চমক লাগানো কিছু করতে পারছে না। ধীরে ধীরে সে হতাশ হতে শুরু করে। আরেকটি বাজে পরিণতি হচ্ছে বাচ্চা প্রশংসা পাবার জন্য বেপরোয়া হয়ে যা যা করে নি তাও বলা শুরু করতে পারে অথবা কারচুপির আশ্রয় নিতে পারে। তারপর অপরিমিত প্রশংসার একটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে নিজেকে অযথা জাহির করবার প্রবণতা।
খুব দ্রুত তিরস্কারে বাচ্চা আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। এধরনের বাচ্চারা ভুল করতে ভয় পায়। তাই নতুন কিছু চেষ্টাই করে না বেশিরভাগ সময়। সে মনে করতে থাকে সে যতটুকু ভালোভাবে করতে পারে তার বাইরে কিছু করতে গেলেই বকা খাবে, কি দরকার ঝামেলায় গিয়ে?
সুতরাং প্রশংসা বা তিরস্কারের ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন করাই শ্রেয়। বাচ্চাকে শিখতে দিন যে প্রশংসা অর্জন করতে হলে প্রতিবার নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে হয়। তাকে আকাশ ছুঁতে উদ্বুদ্ধ করুন। অন্যদিকে তাকে আশ্বাস দিন যে ভুল করলেও সে আপনাকে পাশে পাবে, কারণ ভুল হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক!
২) অপরাধবোধের পুরষ্কার কিংবা শুধুই পুরষ্কার
আজকে হয়ত বাচ্চাকে বেশি সময় দিতে পারেন নি। গতকাল তো সারাদিন অতিথি সামলানো নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। আগামীকাল বাচ্চার স্কুলে একটা প্রেজেন্টেশন-এ যাবার কথা, কিন্তু আপনি জানেন কালকে চেকআপ-এ না গেলেই নয়, কারণ মেরুদণ্ডের ব্যথাটা গতকাল থেকেই অনেক বেশি। আজ ডাক্তারের সিরিয়াল পান নি।
এইরকম ক্ষেত্রে অনেক সময় বাবা-মায়েরা একটা ভুল করে বসেন। বাচ্চাকে কিছু একটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে তাকে খুশি করতে চান অথবা নিজের অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পেতে চান। জেনে রাখুন এটা ভুল বার্তা দিতে পারে। বাচ্চাকে আপনার জটিলতা কিছুটা বুঝতে দিন। আপনি সমস্যার চাপে জর্জরিত থেকে তাকে সবসময় তার মনমত সবকিছু দিতে পারবেন না। ডেইলি রুটিনে একবার দুবার ছেদ পড়লে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না (নিয়মিত ছেদ পড়লে আপনার ডেইলি রুটিনটা ঠিক আছে কিনা দেখে নিতে হবে)। বাচ্চাকে দু-একবার হতাশ হতে দিন। আপনারই তো সন্তান! আপনাকে বুঝতে ভুল হবে না তার, বরং সত্যি বলতে কি, আপনাকে আরও বেশি ভালো করে বুঝবে।
পুরষ্কারের ধারণাতেও একটু পরিবর্তন আনতে হতে পারে আমাদের। ভালো কাজে পুরষ্কার, মন্দ কাজে তিরস্কার, মোটাদাগে ঠিক আছে। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখুন সব পুরষ্কার অর্থ কিংবা বস্তুতে হয় না। ভালো কাজে আত্মতৃপ্তি পাওয়া একটা বিশেষ অনুভূতি। বাচ্চা একা একটা এই অনুভূতি শিখে নেবে এতটা দূরাশা না করাই ভালো। তাদেরকে এই অনুভূতির শিক্ষা দিতে হবে আপনাকেই। সন্তানকে বোঝান যে ভালো কাজ করা তার নিজের গড়ে ওঠার জন্যই অবশ্য প্রয়োজনীয়। কেউ কিছু দেবে এই আশায় সে যেন কোন ভালো কাজ না করে। সাফল্য ধরা দেয় নিজের তাগিদ এবং চেষ্টা থেকে, পুরষ্কারের আশায় বসে থাকা ব্যক্তি জীবনে কখনো সফল হতে পারবে না।
৩) বিপদ থেকে দ্রুত উদ্ধার করে ফেলা
বাচ্চাকে খুব দ্রুত অযোগ্য বানিয়ে ফেলি আমরা। আমরা ভুলে যাই যে জীবন একটা নিরন্তর শিক্ষাক্ষেত্র। আজ যে শিশু, তাকে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়, জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সব কৌশল শিখতে হবে। আমরা যারা অনেকেই কষ্ট করে বড় হয়েছি, তারা একটা ভুল শপথ নিয়ে ফেলি যে আমি নিজে যেমন কষ্টের মধ্যে দিয়ে গিয়েছি আমার বাচ্চাকে সেই কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে দেব না। আমরা তখন বাচ্চার সব কিছুতে এগিয়ে যাওয়া শুরু করি। ফলাফল, বাচ্চা খুব দ্রুত আমাদের অপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, বড় হয়েও সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য কারো না কারো ওপর তাকে নির্ভর করতে হয়, যেটা শুধু জীবনের জটিলতাই বাড়ায়।
বাচ্চা স্কুলে গিয়ে বুলিং-এর শিকার হয়েছে? তাকে যদি ফিজিকালি হ্যারাস না করা হয়ে থাকে, মুখের জবাব মুখেই দিতে দিন, বাজে কথার বা টিজিং-এর প্রতিবাদ করতে শেখান। ক্লাস টিচারের কাছে কমপ্লেইন করে বুলি-কে শাস্তি দেওয়ালে কাজের কাজ কিছু হবে না। আরেকটা কমন ব্যাপার দেখি ছোট বাচ্চাদের ঝগড়া বা হালকা রেষারেষির মধ্যে বাবা মায়েরা খুব দ্রুত নাক গলান এবং অন্য বাবা মায়ের সাথে তুচ্ছ বাগবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়েন। ভেবে দেখেছেন কি, বাচ্চা জিনিসটাকে কেমনভাবে নিচ্ছে? এক, তাকে যৌক্তিকভাবে কোন বিরোধে জিততে হবে না, একটু ভ্যাঁ করে কেঁদে দিলেই হবে, বাবা মা এসে আদর করে বিচার করে দেবে। দুই, আপনি যাদের সাথে সামাজিকভাবে মিশছেন, তাদের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস বা সদ্ভাব নেই, আপনারা বাচ্চা কাঁদলেই একে অন্যের সাথে মন কষাকষি করেন।
আপনি চিরকাল থাকবেন না। জীবন বাচ্চাকে তার কঠিন চেহারা দেখাবেই। তাকে ছোটবেলার ছোট বিপদ থেকে না বাঁচিয়ে বড়বেলার বড় সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করুন। দুজনেই শান্তি পাবেন।
৪) কোন ঝুঁকি নিতে না দেয়া
আজকের দুনিয়ায় বেঁচে থাকাই একটা আশ্চর্য ব্যাপার। এত এত বিপদ চারদিকে ওঁৎ পেতে আছে, মুহুর্তের ভুলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে, কখনো কখনো প্রাণহানির মত দুর্ঘটনা ঘটে যেতেও সময় লাগে না। শিশু জিয়াদের কথা মনে আছে? খেলতে গিয়ে ওয়াসার গভীর একটা পাইপে পড়ে গেল, জীবিতও ছিল অনেকক্ষণ। শুধু যদি আমরা আরেকটু দক্ষ হতাম, বেঁচে যেতে পারত একটা প্রাণ।
আজকালকার বাবামায়েরা যে শিশুদের ব্যাপারে অতিরিক্ত সাবধানী এটা কোন বিলাস নয়, প্রয়োজন। সমস্যা হয় তখনই, যখন এই সাবধানতা বাচ্চার মানসিক বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
অস্ট্রেলিয়ান চিকিৎসক ডঃ ক্যাথলিন বার্শেলম্যান জানাচ্ছেন, যেসব বাচ্চারা নিয়মিত বাইরে খেলতে যায় না কিংবা বাবা-মায়ের সার্বক্ষণিক নজরদারিতে থাকে, তাদের মধ্যে অ্যাংজাইটি, স্ট্রেস, ডিপ্রেশন অনেক বেশি। অন্যদিকে যেসব বাবামা বাচ্চাদেরকে মোটামুটি ছেড়ে দিয়েছেন তারা অনেক হাসিখুশি। অনেকক্ষণ ধরে ডাক্তারের আসার জন্য অপেক্ষা করতে হলেও তারা হাত পা ছুঁড়ে অভিযোগ করতে শুরু করে না।
বাবা-মায়েরা ক্রমাগতভাবে বাচ্চাদের বন্ধুবান্ধব নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে থাকেন। খারাপ ছেলেদের সাথে মিশলে খারাপ হয়ে যাবে, এটা তাদের জীবনের বৃহত্তম ভীতিগুলোর একটি। অথচ স্কুল কলেজের কোন শিশুরা ভালো আর কারা ভালো সেজে থাকে, এটা ধরা মোটামুটি অসম্ভব যদি আপনি তাদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা না করেন। অমুকের সাথে মেলামেশা করো না বলার চাইতে, অমুকের মধ্যে এই অভ্যাসটা দেখলে সেটা নিয়ে তার সাথে কথা বলো, এটা শেখানো আমার কাছে বেশি জরুরী বলে মনে হয়। বাচ্চাদের ভালো আর মন্দের মধ্যে পার্থক্য শেখান। তারপর তাদেরকেই ঠিক করতে দিন তারা কি চায়। ভুল কিছু বেছে নিলে আপনি সেটা নিয়ে তাদের বোঝাতে থাকুন, জোর খাটাবেন না। জোর খাটিয়ে সাময়িকভাবে কাউকে বিরত রাখা যায়, কিন্তু চোখের আড়াল হলেই তারা তাদের পছন্দমত কাজ করবে। প্রচুর বই পড়তে দিন, একটা সুন্দর মানসিকতা আপনা থেকেই তৈরি হবে, আপনাকে শুধুশুধু পেছনে লেগে থাকতে হবে না।
৫) নিজের ভুল স্বীকার না করা
আপনি মহামানব নন, নন জগদ্বিখ্যাত দার্শনিক কিংবা মহাজ্ঞানী অ্যারিস্টটল। হতেও পারেন, কেউ কেউ অবশ্যই নন। আপনার ভুল হতেই পারে। অথবা আপনার বাচ্চা অযথাই আপনার ভুল ধরা শুরু করতে পারে। আমি নিজে খুব রেগে গিয়েছিলাম যখন আমার ছেলে বলছিলো যে আমার পর্যাপ্ত প্যারেন্টিং ট্রেনিং নেই। ঘটনাটা খুলে বলি। চিড়িয়াখানায় গেছি। সিংহের খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে ছেলেমেয়ের একটা ছবি তুলব। মেয়ে পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ছেলে আসবে না। সিংহের একটা মূর্তি আছে, ওটার কোথায় স্পিকার লাগানো, সেই শব্দে সে ভয় পাচ্ছে। আমি দুটো ভুল করলাম। বললাম দেখো আর কোন বাচ্চা ভয় পাচ্ছে না, তুমি কেন ভয় পাবে শুধুশুধু? সে বলল আমি এমনই, আমি ভয় পাই। যাই হোক, সে এলোই না। একটা ছোট ধমক দিলাম। বললাম অন্য বাচ্চারা খুবই চমৎকার করে তাদের বাবা মায়ের কথা শোনে, তুমি অবাধ্য কেন? ছেলে ফস করে বলে বসল, কারণ তোমরা কথা শোনাতে জানো না, তোমাদের প্যারেন্টিং ট্রেনিং নেই। আমি এমনিই একটু নাখোশ ছিলাম, এবার বিস্ফোরিত হলাম। স্ত্রী বললেন, মাথা ঠান্ডা করো।
ভুলগুলি দেখতে পাচ্ছেন? বাচ্চারা অন্যের সাথে তুলনা করা পছন্দ করে না। অমুকে তোমার চেয়ে ভালো, অমুক এই কাজটা পারে, তুমি কেন পারছ না? এইসব কথাবার্তা পুরোপুরি ধ্বংসাত্মক। বাচ্চার আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে দেয়। তখন বিগড়ে যাওয়া হচ্ছে তাদের ডিফেন্স। দ্বিতীয় ভুল হয়েছে আমার দিকে অভিযোগের আঙুল আসাতে রেগে যাওয়া। প্রথমেই আমার চিন্তা করা প্রয়োজন ছিলো আমার নিজের বাচ্চা আমাকে নিয়ে অভিযোগ করছে কেন? এটা কি শুধু আজকের ক্ষোভ নাকি অতীতের আরও কোন ক্ষোভ জমে থাকার ফসল?
যাই হোক, ঘন্টাখানেক পরে মাথা ঠাণ্ডা হলে ছেলেকে বললাম, তোমাকে জোর করা আমার ঠিক হয়নি। সরি। সে হেসে বলল, ইটস ওকে। পরিস্থিতি আরও একটু সহজ হয়ে এলে জিজ্ঞেস করলাম, “বাবা তোমার কেন মনে হলো বাবামা প্যারেন্টিং জানে না?” সে বলল, “বাসায় তো কোন প্যারেন্টিং বুক দেখি না।” আমি বললাম, “আমার কম্পিউটারে যদি ইবুক দেখাই তাহলে কি তোমার বিশ্বাস হবে?” সে বলল, “হ্যাঁ”। হোটেলে গিয়ে দেখালাম। সে খুব খুশি। গোলমাল মিটে গেল।
ভুল স্বীকারে কেউ ছোট হয় না। আপনজনের কাছে আরও না। আপনার সন্তানের চেয়ে আপন কি আপনার কেউ আছে?
৬) আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাও
বেশি ব্যাখ্যা করতে হবে না আশা করি। আমরা সবাই রাম শ্যাম যদু মধু কিন্তু নিজের সন্তানের বেলায় একেবারে মহামতি ঈশপ। সারাক্ষণ জ্ঞানী জ্ঞানী উপদেশ, এই করবে না সেই করবে না, এটা করা ঠিক নয়, ওটা ভুল করলে কেন? চিন্তা করে দেখুন। আপনি যা যা উপদেশ দিচ্ছেন সব নিজে করেন তো? যদি না করেন তাহলে কিভাবে আশা করেন শুধু মুখের কথায় শিশুরা বদলে যাবে?
বাচ্চাকে শুধু উপদেশ দিয়েই ক্ষ্যান্ত হবেন না, নিজেও সেটা করে দেখানোর চেষ্টা করুন। ছোটবেলার কথা মনে আছে, আমাকে চা খেতে না দিয়ে বড়রা যখন খেতো, তখন রাগে পিত্তি জ্বলে যেত। হোমওয়ার্ক করি নি বলে যখন ম্যাকগাইভার দেখা বন্ধ থাকত, তখনকার অক্ষম আক্রোশ ভাষায় ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। বাচ্চাকে কার্টুন দেখতে নিষেধ করে নিজে নাটক দেখতে যাবার আগে ভাবুন এটা তার ওপর কতখানি ঋনাত্মক প্রভাব ফেলছে। গ্রামের বাড়ির একটা স্মৃতি মনে পড়ে। আমার সমসাময়িক ছোট বাচ্চারা নিজেদের মাঝে এলাকার মুরুব্বিদের নাম ধরে ডাকত। সেই মুরুব্বিরা কেউ সামনে পড়ে গেলে চাচা-টাচা ডেকে সালাম দিয়ে একসার। এখন বুঝি, তারা এই শিক্ষা বাসার বড়দের কাছ থেকেই পেয়েছিলো।
আমার এক স্টুডেন্ট-এর বাসায় আমি সপ্তাহে তিন দিন পড়াতে যেতাম। যাবার সময় খুব স্ট্রিক্টলি মেইনটেন করতে হতো। একবার দেরি করে পৌঁছালাম। সেদিন ড্রয়িং রুমে বসবার বদলে স্টুডেন্ট-এর রুমে বসতে হলো। কারণ বাতাসে রিফাইন্ড ইথাইল অ্যালকোহলের ভারী গন্ধ। কথায় কথায় জানা গেলো, বিদ্যার্থী নিজেও এই জিনিস কয়েকবার চেখে দেখেছে। আমি শুধালাম, বাসায় জানে? বলল জানলে মার দেবে, তাই লুকিয়ে খেয়েছি। ওরা খেলে আমার দোষ হবে কেন? সুতরাং সাধু সাবধান।
ছবি- সংগৃহীত: ইমেজেসবাজার.কম