একটুখানি মন খারাপ লাগা, বিরক্ত লাগা বা ক্লান্ত হয়ে যাওয়া আমাদের জীবনেরই একটা অংশ। কিন্ত কখনো কখনো কিছু ঘটনা আমাদের মনকে খুব গভীর ভাবে নাড়া দিয়ে যায়, যখন চারপাশের কোন আনন্দ আর আমাদের ছুঁতে পারে না। দিনের পর দিন আমরা গভীর হতাশায় ডুবে যাই। কারো হয়ত প্রিয়জন দূরে সরে গেছে, কারও হয়ত বহুদিনের লালিত স্বপ্ন ভঙ্গের আঘাত বা কারও হয়ত অন্য কোন ব্যক্তিগত দুঃখ-কষ্ট। দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস কেটে যায় এরকম অবসাদে। সেই সময়েই ডিপ্রেশন ভর করে আমাদের ওপর। তবে ডিপ্রেশন এবং সাধারণ মন খারাপের মধ্যে তফাত রয়েছে। তাই ডিপ্রেশন-কে ডিল করতে হলে আগে বুঝতে হবে ডিপ্রেশন-এর লক্ষণ গুলো কী কী?
- প্রতিদিনের কাজগুলো ঠিক ভাবে করে উঠতে না পারা।
- যেকোনো কাজেই অনেক বেশি ক্লান্তি বোধ করা। এই ক্লান্তি শুধুমাত্র শারিরিক ক্লান্তি নয়, মানসিক ক্লান্তিও।
- যেসব কাজে যেমন বই পড়া, ছবি আঁকা, মুভি দেখা ইত্যাদিতে আগ্রহ পেতেন এখন আর সেরকম আগ্রহ বোধ করেন না।
- ক্রমাগত একটা দমবন্ধ করা অনুভূতি, কাঁদতে ইচ্ছা করা, সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা বা খুবই নিরাশ বোধ করা।
- অস্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধি বা ওজন হ্রাস পাওয়া।
- সবকিছু এলোমেলো লাগা, পরিষ্কারভাবে চিন্তা করতে না পারা, সিধান্তহীনতা।
- খুব বেশি ঘুমান বা একেবারেই ঘুম না হওয়া।
- নিজেকে একেবারে অক্ষম মনে করা, নিজের প্রতি অপরাধবোধ হওয়া।
- সবসময়ই খিটখিটে বা রুক্ষ মেজাজে থাকা।
- ফাইনালি, নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা করা।
এই লক্ষণগুলো যদি নিজের আচরণের মধ্যে খুঁজে পান, তাহলে বুঝবেন এবার আপনাকে একটু সিরিয়াসলি ভাবতে হবে। আমি কোন মানসিক রোগের ডাক্তার নই কিংবা থেরাপি-ও দিচ্ছি না। আমি শুধু মাত্র কিছু উপায়ের পরামর্শ দিতে পারি যেগুলোকে ডিপ্রেশন-এর প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে নেয়া যেতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে এভাবেই ডিপ্রেশন কাটিয়ে ওঠা সম্ভব , আর যদি না হয় তখন দেরি না করে বা এই বিষয়টিকে অবহেলা না করে একজন অভিজ্ঞ মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে বলব আমি।
- আপনজনের সংস্পর্শে থাকুন: জোর করে হলেও নিজেকে সোশ্যালাইজেশন-এর ভেতরে রাখুন। এর মানে ফেসবুক বা সোশ্যাল নেটওয়ার্ক-এ পড়ে থাকার কথা নয়। নিজের পরিবারে সাথে সময় কাটান, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের বাড়ি যান বা তাদের বাড়িতে ডাকুন। নিজেকে একা করে ফেলবেন না।
- এক্সারসাইজ: ডিপ্রেশন কাটাতে এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা দারুণভাবে মুড লিফট করে। শরীরের ঘাম ঝরার পাশাপাশি মনের কষ্ট ঝরাতেও সাহায্য করে। এর জন্যে জিম-এ যেতে হবে বা ওয়েট লিফটিং করতে হবে তা কিন্ত নয়।সকালবেলা উঠেই ৩০ মিনিট হেঁটে আসুন। চাইলে বিকেলেও এটি করতে পারেন। তবে সকালটাই এর জন্য সবচেয়ে উপযোগী। বাইরের বিশুদ্ধ বাতাসে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে হাঁটলে, মনের ভার অনেকটাই কমে যাবে।
- রুটিন: ডিপ্রেশন-এ পড়লে কাজের রুটিন ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এটা একদিনে ঠিক হবার নয়। এসময় ঘুমানোর সময়ের ব্যাঘাত ঘটে বা খাবারটা ঠিকমত খাওয়া হয়, গোসল ঠিক মত করা হয় না ইত্যাদি। প্রথমে এই জিনিসগুলোকে রুটিনে আনুন। যেভাবেই হোক প্রতিদিন ঠিক একই সময়ে ঘুমুতে যাবেন এবং চেষ্টা করবেন একই সময়ে উঠতে। রোজ খাবার এবং গোসলের জন্যে নির্ধারিত সময় রাখবেন এবং চেষ্টা করবেন যেন সেই সময়েই তা করা যায়। পড়াশুনা থাকলে সেটার জন্যে ঘড়ি ধরে সময় রাখবেন, সেই সময়ে হয়ত আপনার মনোযোগ থাকবে না, না থাকলেও পড়ার টেবিল থেকে উঠবেন না। যতবার অন্য কিছু মনে পরবে, আবার নিজেকে বুঝিয়ে নিয়ে কাজ শুরু করবেন।
- লক্ষ্য নির্ধারণ করা: এই সময় নিজেকে খুব অক্ষম মনে হয়, নিজের ওপর বিশ্বাস বা ভরসা কিছুই থাকে না। তাই প্রতিদিনের একটা কাজের তালিকা বানিয়ে সেটা সম্পূর্ণ করার চেষ্টা করুন। শুরুতেই বড় কোন কাজের বোঝা নিয়ে নিজেকে আরও বেশি চাপের মধ্যে ফেলবেন না। অল্প অল্প করে শুরু করুন। তারপরে একটু একটু করে সেটা বাড়ান। একেবারেই কোন কাজ না হবার চেয়ে অল্প করে কাজ হলেও তো ভালো।
- খাবার নিয়ন্ত্রণ: এই সময়ে কেউ হয়ত অনেক বেশি খান। যেমন- যখন তখন চা, সিগারেট, মিষ্টি বা জাঙ্ক ফুড কেউ আবার অ্যালকোহল পর্যন্ত ধরেন। এইগুলো থেকে দূরে থাকতে হবে। অতিরিক্ত চা বা কফি ডিপ্রেশন বাড়ায়। যাই খান নিয়ম করে খাবেন। বিকেলের চায়ের একটা নির্ধারিত সময় রাখবেন, সেই সময়ে আয়োজন করে চা খান। দেখবেন ভালো লাগবে। খুব জাঙ্ক ফুড খেতে ইচ্ছে করলে নিজেকে কোন একটা কাজের দায়িত্ব দিয়ে সেই কাজ পূরণ হলে তবেই সেই খাবারটি খান। অন্যদিকে আবার কেউ হয়ত একেবারেই খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেন। তাদের বলবো, তারা রান্নাকে একটা সখ হিসেবে নিন। নিজে রাঁধলে খেতেও ইচ্ছে করবে।
- নতুন কিছু করা: জীবনে যে কাজগুলো নানান ব্যস্ততায় করা হয়ে ওঠে নি সেগুলো করার চেষ্টা করুন। যেমন আমার খুব খারাপ সময়ে আমি বেশ কিছু ওয়াল হ্যাংইন সেলাই করেছিলাম। এগুলো আপনাকে ব্যস্ত রাখবে এবং আপনার মনোযোগ ধরে রাখতে সাহায্য করবে। এখন ইউটিউব-এ শেখা যায় না এমন কিছু নেই। আমিতো ছবি আঁকা শেখা শুরু করেছিলাম, যেই কাজটি আপনার ভালো লাগে করতে সেটাই করুন।
অনেকে হয়ত এই পর্যায়ে বলবেন, এগুলো করতে পারলে তো আর ডিপ্রেশন-এ ভুগতাম না। কথা সত্যি। ভীষণ ডিপ্রেশন-এ পড়লে সাধারণ কাজও কঠিন লাগে। শুরুটা করুন। এখানে ইচ্ছা শক্তিটাই আসল। আপনি কি হারিয়ে যেতে চান নাকি নিজেকে খুঁজে পেতে চান? সেটা ঠিক করুন। অন্যকে সময় দেয়ার আগে নিজেকে সময় দিন। অন্যকে ভালবাসার আগে নিজেকে ভালবাসুন। সময় লাগলে লাগুক, তবু নিজেকে ফিরে পাওয়ার আগ পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যান।
ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
লিখেছেন- মাহবুবা মিমি
ছবি- সাটারস্টক