হঠাৎ করেই ওজনটা কি খুব বেড়ে যাচ্ছে? শরীর ফুলে যাচ্ছে? ডায়েট কন্ট্রোল করছেন নিয়ম মেনে, কিন্তু তাও মোটা হয়ে যাচ্ছেন? নাহলে হয়তো ঠিক মতই খাওয়া-দাওয়া করছেন, কিন্তু তাও রোগা হয়ে যাচ্ছেন? আবার হয়তো দেখা যাচ্ছে ছোটখাটো বিষয়ে অতিরিক্ত উদ্বেগ বা সবসময়ই বিষণ্ণতা কাজ করছে মনের ভেতর। কিংবা হয়তো ঋতু পরিবর্তন ছাড়াই শরীরে তাপমাত্রার তারতম্য হয়ে যাচ্ছে। এই শীত লাগছে তো আবার এই গরমে ঘেমে চুপচুপে। তাহলে আর দেড়ি না করে এক্ষুণি একবার আপনার থাইরয়েড টেস্ট করিয়ে ফেলুন। কেন করাবেন থাইরয়েড টেস্ট? আসুন জেনে নেই এ বিষয়ে বিস্তারিত।
থাইরয়েড কী?
থাইরয়েড গ্ল্যান্ড হলো একটি অন্তক্ষরা গ্রন্থি। যেটা থেকেই নিঃসৃত হয় থাইরয়েড হরমোন। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা হরমোন। কারণ এটি থেকে শরীরের অন্যান্য প্রয়োজনীয় হরমোন উৎপাদন হয়। এই গ্ল্যান্ড দেখতে অনেকটা প্রজাপতির মতো। যেটি গলার একটি অংশে অবস্থিত।
এই থাইরয়েডের ক্ষরণ কিন্তু একটা সঠিক পরিমাণে হয়। মানে শরীরের যতটুকু দরকার ততটুকু। কিন্তু শরীরের এই প্রয়োজনের থেকে যখন বেশী বা কম ক্ষরণ হয়, তখনই সমস্যা হয়। এটি একদিনেই হয় না। ধীরে ধীরে হয়। তাই সমস্যাও ধীরে ধীরে দেখা যায়। এটি যেহেতু শরীরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে, তাই শরীরের ভেতরে ক্ষতিও ধীরে ধীরে হয়। যেহেতু এটা খুব ধীরে হয়, তাই বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগি বুঝতেই পারেন না তাঁদের এই সমস্যার কথা। শরীরে থাইরয়েড হরমোনের তারতম্য দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে, কমে গেলে তাকে বলা হয় হাইপোথাইরয়েডিজম এবং বেড়ে গেলে তাকে বলা হয় হাইপারথাইরয়েডিজম। এই দুই ধরনের সমস্যা নিয়েই আজকে আলোচনা করবো।
হাইপোথাইরয়েডিজম
যখন শরীরের প্রয়োজনের চেয়ে কম থাইরয়েড হরমোন নিঃসৃত হয়, তখন কিছু কিছু উপসর্গ আছে যা দেখে আপনি সন্দেহ করতে পারবেন যে, আপনি হয়তো হাইপোথাইরয়েডিজমে ভুগছেন। তবে উপসর্গের আগে এর কারণ সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে। হাসিমটো ডিজিজ, থাইরয়েডাইটিস বা থাইরয়েড গ্ল্যান্ড-এর প্রদাহ, জন্মগত হাইপোথাইরয়েডিজম কিংবা কোন কারণে অপারেশন করে থাইরয়েড গ্ল্যান্ড অপসারণ করলে হাইপোথাইরয়েডিজম দেখা দেয়। পুরুষের চেয়ে ৫০% ক্ষেত্রে নারীরা এই সমস্যায় বেশি ভোগেন। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে বলে এর লক্ষণ অনেক ক্ষেত্রে নজরে আসে না। কিছু সাধারণ লক্ষণ হচ্ছে- ক্লান্তি, ওজন বৃদ্ধি, মুখ ফুলে যাওয়া, ঠাণ্ডা সহ্য করতে না পারা, পেশি ব্যথা, কোষ্ঠকাঠিন্য, ত্বকের শুষ্কতা, চুল ভেঙে যাওয়া ও পড়ে যাওয়া, অতিরিক্ত ঘাম, ভারী বা অনিয়মিত ঋতুস্রাব বা মাসিক, বিষন্নতা ও হৃৎস্পন্দন কমে যাওয়া।
চিকিৎসা
হাইপোথাইরয়েডিজমের রুগীদের চিকিৎসকগণ লেভোথাইরক্সিন সোডিয়াম বা থাইরক্সিন সোডিয়াম ঔষধ হিসেবে খেতে বলেন, যা আজীবন খেতে হয়। এছাড়াও এইসব রুগীদের বিভিন্ন খাবার যেমন- ব্রেড, পাস্তা, সিরিয়াল জাতীয় খাবার, ব্রকলি, পালং শাক, বাঁধাকপি, ফুলকপি, সয়াসস, সিম, কফি, দুধ ও চিনিযুক্ত খাবার ইত্যাদি এড়িয়ে যেতে চিকিৎসকগণ উপদেশ দিয়ে থাকেন।
হাইপারথাইরয়েডিজম
হাইপারথাইরয়েডিজম (অত্যধিক থাইরয়েড) এমন একটি রোগ যেখানে আপনার থাইরয়েড গ্রন্থিটি হতে থাইরক্সিন হরমোন অনেক বেশি উৎপাদন করে। সাধারণত গ্রেভস ডিজিজ (এক ধরনের ইমিউন সিস্টেম ডিজঅর্ডার), অতিরিক্ত থাইরয়েড হরমোন সেবন, অতিরিক্ত আয়োডিন সেবন, থাইরয়েডাইটিস ইত্যাদি কারণে থাইরয়েড হরমোন বেশি উৎপাদন হয়। যাদের হাইপার থাইরয়েডের সমস্যা হয়, তাদের ওজন কমে যায়, বিরক্তবোধ থাকে, ডায়রিয়ার প্রবণতা থাকে, রাগ থাকে, মেজাজ খারাপ থাকে। তারা অনেক খায়, তবে ওজন বাড়ে না, গরম সহ্য করতে না পারা, ঘাম হয় অতিরিক্ত, বুক ধরফর করা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়।
চিকিৎসা
হাইপারথাইরয়েডিজমের চিকিৎসা হচ্ছে অ্যান্টিথাইরয়েড ওষুধ, যেটি থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যকারিতাকে কমিয়ে দিবে। ওষুধের পাশাপাশি সার্জারি করা যেতে পারে। যেহেতু গ্রন্থিটি বেশি কাজ করছে, তাই কিছু অংশ কেটে কার্যকারিতা কমিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
গর্ভাবস্থায় থাইরয়েড
গর্ভধারণের প্রথম ১২ সপ্তাহে ভ্রুণের বৃদ্ধি নির্ভর করে মায়ের থাইরয়েড হরমোনের উপর। তাই মায়ের পর্যাপ্ত পরিমাণে থাইরয়েড হরমোন নিঃসরণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এ হরমোন গর্ভের শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, হাইপোথাইরয়েডিজমের কারণে বাচ্চার ক্ষতি হতে পারে। এ সমস্যার ফলে গর্ভের বাচ্চার শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্থ হয় যার ফলে বাচ্চা কম আইকিউ (IQ- Intelligence Quotient) নিয়ে জন্মাতে পারে। হাইপোথাইরয়েডিজমের সঠিক প্রতিকার না হলে আরও কিছু সমস্যা, যেমন- গর্ভপাত, সময়ের আগেই প্রসব, গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ, মৃত সন্তান প্রসব ইত্যাদি হতে পারে। এছাড়াও আয়োডিনের অভাবেও এ সমস্যা হতে পারে। বংশগত কারণেও গর্ভাবস্থায় হাইপোথাইরয়েডিজমের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। তবে এ সমস্যাগুলো উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে রোধ করা যেতে পারে।
এতো গেলো কমে যাওয়ার প্রভাব, এবার আসি বেড়ে গেলে কী হয় সে দিকে। গর্ভাবস্থায় মায়েদের শরীরে থাইরয়েড হরমোনের চাহিদা বেড়ে যায়। গরভকালীন এইচসিজি (Human Chorionic Gonadotropin) নামক হরমোন এবং ইস্ট্রোজেন থাইরয়েড গ্রন্থিকে উদ্দীপিত করে যাতে থাইরয়েড গ্রন্থি অতিরিক্ত থাইরয়েড হরমোন উৎপন্ন করে। এই সমস্যা সাধারণত গর্ভাবস্থার প্রথম ট্রাইমেস্টার বা প্রথম তিন মাসে দেখা যায়, দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টার এর দিকে এটি আবার নিজে নিজেই ঠিক হয়ে যেতে পারে। এ সমস্ত সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে যেসব গর্ভবতী মায়েদের নিকট আত্মীয় কারও থাইরয়েডের সমস্যা আছে (মা বা বোন) তাদের গর্ভধারণের আগেই বা গর্ভধারণের পরপরই থাইরয়েড-এর পরীক্ষা করে দেখা উচিত।
থাইরয়েড গ্ল্যান্ড সুস্থ রাখার ৬টি উপায়
১) উচ্চ মানের টাইরোসিন আমিষযুক্ত খাবার খান। টাইরোসিন দরকার হয় থাইরয়েড হরমোন তৈরিতে। এটি পেতে খেতে হবে লাল মাংস, মাছ, মুরগির ডিম ও মাংস, কলা ও মিষ্টি কুমড়ার বিচি।
২) গয়ট্রোজেনাস খাবার যেমন বাঁধাকপি, ফুলকপি, শিম, চিনাবাদাম, সয়াসস, ইত্যাদি অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া যাবে না। রান্না করে খাবেন, কাঁচা খাবেন না। থাইরয়েডে সমস্যা থাকলে এসব খাবার খাওয়া উচিত নয়।
৩) গ্লুটেন প্রোটিনযুক্ত খাবার খাবেন, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ঠিক রাখে। এইজন্য গম, শস্যদানা, যব, বার্লি খেতে হবে।
৪) থাইরয়েড ঠিক রাখার জন্য লিভারের সুস্থতা দরকার। লিভারের সুস্থতার জন্য ফ্যাটি অ্যাসিডযুক্ত খাবার খেতে হবে। বিভিন্ন তেলযুক্ত মাছ, কাঁচা বাদাম, অলিভ অয়েল-এ এটা পাওয়া যাবে।
৫) আয়োডিনযুক্ত লবণ খাবেন।
৬) কীটনাশক ও হেভিমেটাল যেমন মারকারি, ক্যাডমিয়াম, দস্তা ব্যবহারে সতর্ক হবেন।
আমেরিকান থাইরয়েড অ্যাসোসিয়েশন-এর মতে, বয়স ৩৫ হলে, প্রতি পাঁচ বছর পরপর প্রত্যেকের থাইরয়েড পরীক্ষা করানো উচিত। যাদের উপসর্গ বা ঝুঁকি রয়েছে, এদের বারবার পরীক্ষা করানো উচিত। ৬০ উর্দ্ধ মহিলাদের বেশি হয় হাইপোথাইরয়েডিজম। হাইপারথাইরয়েডিজম-ও ৬০ উর্দ্ধ পুরুষ ও মহিলাদের হতে পারে। পারিবারিক ইতিহাস থাকলে ঝুঁকি বাড়ে। তাই এ সম্পর্কে সবার সচেতন থাকতে হবে।
ছবি – সংগৃহীতঃ টুইটার.কম, পিন্টারেস্ট.কম, স্লাইডপ্লেয়ার.কম, হেলথলাইন.কম