রিবনডিং করে চুলের স্বাস্থ্যের বারোটা বাজিয়েছেন… !
এখন কি করবেন??
বাংলাদেশের মানুষের মাথায় কীভাবে যেন ঢুকে গেছে যে সোজা, মাথার সাথে লেপটে থাকা চুল হলেই মনে হয় অনেক সুন্দর লাগে দেখতে!! এবং এই আইডিয়া মাথায় আসার পর পরই আগে পিছে কিছু চিন্তা না করে, নিজের লুক, চুলের সাস্থ্য আর সবচেয়ে বড় কথা- কোথায় এত বড় কেমিক্যাল ট্রিটমেনট’টা হচ্ছে, কার হাতে হচ্ছে? সেকি কাজ জানে? ভালো প্রোডাক্ট ইউজ করছে? নাকি কোয়ালিটি এতই খারাপ যে আপনি ১ মাসের মধ্যে পুরো টাক হয়ে যাবেন চুল পড়ে?? এসব কিছু এক সেকেন্ডের জন্য চিন্তা না করে সবাই পার্লারে ‘ চুল সোজা’করতে চলে যায়। দুঃখের ব্যাপার অনেকে এটাও জানে না যে, সে আসলে রিবনডিং করছে? নাকি পারম!! (সত্যি!!) ফলাফল যা হবার তাই হয়, এবং- আপু, চুল রিবনডিং করার পর সব চুল পড়ে যাচ্ছে!! রিবনডিং এর পর কীভাবে যত্ন নেব আপু??- টাইপ প্রশ্ন মানুষের দ্বারে দ্বারে জিজ্ঞাসা করা এবং নিজেকে হাসির পাত্র বানানো ছাড়া কোন উপায় থাকে না!!
এখানে আমার প্রশ্ন !
‘ আপনি কি রিবনডিং করার আগেই জেনে নেননি, আপনার চুলের যত্নে কী করা দরকার?
কিছু না জেনে এত বড় একটা ট্রিটমেনট নেয়ার সাহস আপনার হল কি করে?
নাকি ‘২ হাজারে রিবনডিং’ সাইন বোর্ড দেখে খুশিতে স্বাভাবিক জ্ঞান বুদ্ধি লোপ পেয়েছিল? ‘
এসবের উত্তর আমি পাব না। কিন্তু ঈদের সিজনে আবারো ২ হাজার/৪ হাজার টাকায় রিবনডিং করে অমূল্য চুল হারানো জ্ঞান বুদ্ধিহীন কিছু মানুষের খোঁজ ঠিকই মিলবে!!
আর আজকের লম্বা লেখাটি সেই মানুষদের উদ্দেশেই-
১। জি না, আপনার যতই সখ থাকুক না কেন,
আপনি রিবনডিং এর ১ সপ্তাহ পর চুল রঙ করতে পারবেন না-
আসলে বলা উচিৎ, পারবেন, কিন্তু মাথার চুলকে এখনি বিদায় জানিয়ে নিন। কারণ এরপর যতই চিৎকার করুন না কেন! আর ক্যাস্টর অয়েল, অলিভ অয়েল , হ্যান অয়েল- ত্যান অয়েল মাখুন না কেন, চুল আর ফেরত আসবে না!! এবং একটু মাথা খাটিয়ে আপনার স্যালন এর মেয়েদের জিজ্ঞেস করুন, কতদিন পর চুলে হিট দিতে পারবেন, শ্যাম্পু করতে পারবেন?? সোজা চুল দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে বুদ্ধির মাথা খাবেন না প্লিজ।
যা করবেন না- কেমিক্যাল ডাই- পার্লারেও না, নিজে নিজে বাড়িতে তো নাই!!
(৬ মাসে মাথাতে চিন্তাও আনবেন না!)
-হেয়ার ব্লিচ
-হিট ট্রিটমেন্ট
– একবার সস্তায়রিবনডিং করে তিনঅবস্থা দেখার পরেও খায়েস মেটেনি! আপনার যদি মনে হয় নষ্ট রিবনডিং এর উপর আবার রিবনডিং করলেই সব মুশকিল আসান!! তবে আপনি ভুল ভাবছেন!! ৬ মাসের আগে নতুন করে রিবনডিং করে নিজের সর্বনাশ করবেন না।
২। চুল এখন খুব নাজুক, সুতরাং সচেতন হন!
অনেকে মনে করে রিবনডিং এর আগেও চুল যেভাবে হ্যান্ডল করত , পরেও সেভাবেই করা যাবে!! তারপর চুল যখন মাঝখান থেকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়বে, এরা তখন হতবুদ্ধি হয়ে যাবে!!
যা করবেন না-
– শ্যাম্পু করার সময় চুলের বডিতে হাত দেবেন না, শুধু মাথার তালুতে আঙ্গুল দিয়ে ম্যাসাজ করে ছেড়ে দিন।
– ভেজা চুল তাওয়াল দিয়ে বাধবেন না। হাত দিয়ে চেপে পানি ফেলে ফ্যানের বাতাসে শুকাবেন।
– সপ্তাহে ১-২ বারের বেশি শ্যাম্পু করবেন না।
– চুলে কোন ধরনের হিট ইউজ করতে হলে সবচেয়ে লো সেটিং ইউজকরুন। বেশি হিট দিলেই স্টাইল বেশি টিকবে না! এটা কমন সেন্স!!
– চুলে প্লাস্টিকের চিরুনি ইউজ করা বন্ধ করুন। হেয়ার ব্রাশ ইউজ করুন। আলতো ভাবে চুলে ব্রাশ ইউজ করে জটা ছাড়ান। মনের ভুলেও ভেজা চুল আঁচড়াবেন না!! চুল মাঝ থেকে ছিঁড়ে চলে আসবে!
– শক্ত বেনি,পনিটেল, অনেক কমপ্লিকেটেড খোঁপা করতে যাবেন না।
৩। চুল খুব ভালো ভাবে কন্ডিশন করুন-
যদি শ্যাম্পু ইউজ নাও করেন, চুল ড্রাই লাগলে চুল ভিজিয়ে কন্ডিশনার লাগিয়ে ২-৩ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন। ড্রাই , রুক্ষ ভাব কমবে। ন্যাচারাল কন্ডিশনার ব্যবহার করতে পারেন, যেমন, চায়ের লিকার, মেয়নেজ, অলিভ অয়েল, বাদাম তেল ইত্যাদি।
২ সপ্তাহে একবার অবশ্যই ডিপ কনডিশনিং করুন, এর বেশি করার দরকার নেই। বাজার থেকে মাস্ক কিনেও করতে পারেন। আবার ঘরে ডিম, অলিভ অয়েল, মেয়োনেজ মিলিয়েও ডিপ কন্ডিশনার তৈরি করে ১১ ঘণ্টা চুলে রেখে ধুয়ে ফেলতে পারেন।
৪। ঘরে তৈরি মাস্ক ব্যবহার করুন-
চুল রুক্ষ শুষ্ক, প্রাণহীন হওয়াটা রিবনডেড চুলে স্বাভাবিক। এসময় ঘরে নিজেই মাস্ক বানিয়ে নিন-
ড্রাই চুলের জন্য- ৪-৫ টেবিল চামচ নারকেলের দুধ , হ্যা, জাস্ট এটাই যথেষ্ট
ডাল চুলের জন্য- একটা ডিম, এক টেবিল চামচ মধু
ফ্রিজি চুলের জন্য- একটা কলা, এক টেবিল চামচ মধু
৫। খাওয়া দাওয়া ঠিক রাখুন।
ভেতর থেকে পুষ্টি না দিলে সারা জীবন চুলে মাস্ক, তেল মাখলেও চুল ঠিক হবে না!!
প্রচুর পরিমানে ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড , প্রোটিন , খনিজ ( আয়রন, জিঙ্ক, ইত্যাদি) যুক্ত খাবার খান। চুলের গায়ে মাস্ক আর তেল দিলে চুল গজায় না। চুলের বিল্ডিং ব্লক আসে ভেতর থেকে। সো, খাওয়া দাওয়ার খবর না নিয়ে, ২ দিন ক্যাস্টর অয়েল মেখে, আর মাসে একদিন রান্নাঘরের সব খাবার মাথায় মাখিয়ে শ্যাম্পু কমার্শিয়ালের চুল আপনি পাবেন না!
৬। রেগুলার চুল কাটুন!
বিভিন্ন শাম্পুর অ্যাড যাই বলুক না কেন! সত্যিটা জেনে রাখুন। আপনার ড্যামেজড, আগা ফাটা চুল জোড়া লাগানো সম্ভব নয়। চুল মৃত কোষ। সো একবার ফেটে গেলে ওটা কেটেই ফেলতে হবে। অন্য কিছু করতে পারবেন না। প্রতি ৬ সপ্তাহ পর পর আগা থেকে ১ সেমি. ট্রিম করুন। ফাটা আগা দেখাও যাবে না, আর নষ্ট চুল ধীরে ধীরে পড়ে যাবে। এটাই একমাত্র সলিউশন ড্যামেজড চুল থেকে মুক্তি পাবার।
– গোসলের পর তোয়ালে দিয়ে চুল পেঁচাবেন না! (অনেকের আবার চুল ঝাড়ার অভ্যাস আছে। আজ থেকে ভুলে যান এসবের কথা)। দরকার পড়লে খুবই পাতলা সুতির কাপড় অথবা গেঞ্জি কাপড় দিয়ে চেপে অতিরিক্ত পানি বের করে নিন।
– প্রতিবার গোসলের আগে তেল মেখে ১-২ ঘণ্টা রাখুন।
– ভুলেও গোসলের সময় চুলে উষ্ণ না গরম পানি ইউজ করবেন না!! স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানি ব্যবহার করুন।
এবং পরিশেষে, যারা এখনও রিবনডিংএর ফাঁদে পড়েননি। কিন্তু রাস্তা ঘাটে লোভনীয় অফার দেখে লোভ সামলাতে পারছেন না। তারা, একটু কষ্ট করে পার্লারে আগে একদিন যান। জিজ্ঞাসা করুন তারা কী ইউজ করে। কীভাবে নিজের চুলের যত্ন নেবেন!! ইত্যাদি! জানি, এটুকু কষ্টের চেয়ে নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপানোই অনেকের কাছে অনেক সহজ লাগে, কারণ-
‘আমি না জেনে শুনে নিজের চুল গুল নষ্ট করে ফেললাম!!’– এটা বলার চেয়ে,
‘পার্লারে গিয়েছিলাম!! ওরা চুলগুলো গুলো একদম নষ্ট করে ফেলল!!!’ – এটা বললে অপরাধ বোধও কম হয় আর মানুষের হাসির পাত্রও হতে হয় না!! তাই না?
কিন্তু at the end of the day চুলটা কার?? পার্লারের?? যাকে বলছেন তার?? নাকি আপনার??
মায়ের চেয়ে কি মাসির দরদ বেশি হয়……..??
লিখেছেন – তাবাসসুম মুস্তারি মীম
ছবি – Serdaruysalphotography