আজকাল অনেককেই যখন বলি চুলে রেগুলার তেল দেয়ার উপকারিতা তখন তারা জবাব দেন,
‘কই আপু, আপনি তো বললেন রেগুলার তেল দিলে চুল সুন্দর হবে, হেলদি হবে, চুল পড়াটা একটু কমে আসবে… কিন্তু আমি তো চুলে রেগুলার তেল দিচ্ছি…!! কিন্তু আপনি যেমন বলছেন তেমন রেজাল্ট তো পাচ্ছি না…’
আমি তখন সরাসরি জিজ্ঞেস করি, আপনি কি পিওর ন্যাচারাল তেল ব্যবহার করেছেন? নাকি মার্কেট থেকে মিনারেল অয়েলযুক্ত তেল কিনে ইউজ করছেন? তখন জবাব আসে-
‘পিওর ঘানি ভাঙ্গা তেল কোথায় পাব?? মার্কেট এর কেনা নারিকেল তেলে মেথি, আমলকী, জবা, মেহেদি দিয়ে হারবাল তেল তৈরি করেছি… কিন্তু কোন রেজাল্ট নেই।’
এখন আসি কাজের কথায়, দেখুন আমরা যখনি আমাদের পেজে স্কিন ও হেয়ার কেয়ারের জন্য কোন হোম রেমেডি অথবা রেসিপি দেই এবং তাতে কোন তেলের ব্যবহার উল্লেখ করি তখন আমরা সব সময় মিন করি একদম ১০০% পিওর অর্গানিক এবং যতটুকু সম্ভব ভার্জিন তেল যেন ব্যবহার করা হয়। কারণ কিছু বিখ্যাত ব্র্যান্ড বাজারে নারকেল তেল অথবা আমনড অয়েলের নামে যা বিক্রি করে তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয় প্রায় ৪০%-৫০% মিনারেল অয়েল মেশানো। আর এই পিওর মিনারেল অয়েলের সাথে আপনি যতই মেথি, আমলকী মেশান না কেন… কখনই কোন রেজাল্ট আপনি পাবেন না।
[picture]
তাহলে এখন আপনাদের শেখাই যে পিওর, অর্গানিক এবং ভার্জিন/ এক্সট্রা ভার্জিন তেল বলতে আমরা আসলে কী বুঝি। আজকাল দিন কাল এমন এসেছে, কেউ আসল তেল চেনেনই না… অথবা কী কী গুনাগুন থাকলে সেটা আসলেই আপনার স্বাস্থ্য, স্কিন ও হেয়ারের আসলেই কিছু উপকার করতে পারবে তাও বুঝতে পারেন না। অজথাই অনেকগুলো টাকা দিয়ে মার্কেট থেকে প্রসেস করা মিনারেল অয়েল মেশানো রিফাইন্ড তেল কিনে এনে সেটা দিয়ে কিছু রূপচর্চা করে কোন রেজাল্ট না পেয়ে হতাশ হয়ে যান।
অর্গানিক
যখন আপনার প্রোডাক্টটি সম্পূর্ণ ন্যাচারাল ওয়েতে কালেক্ট করা হয়, এবং চাষ করা হয়। এবং চাষের সময় ও কোন রাসায়নিক কীটনাশক অথবা সার ব্যবহার না করে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে গাছ লাগান থেকে শুরু করে ফল তোলা পর্যন্ত প্রত্যেকটি পর্যায়ের কাজ করা হয় তখন সেই উপাদানটিকে অর্গানিক উপাদান বলা যায়। আর এমন অর্গানিকউপাদান দিয়ে প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি প্রোডাক্ট টিকে অর্গানিকবলা যায়।
ভার্জিন/ এক্সট্রা ভার্জিন-
এই ট্যাগটি সাধারনত কোন তেলের প্রস্তুতপ্রক্রিয়াকে বোঝায়। তেল তৈরি করার কাজে যত বেশি তাপ ব্যবহার করা হয় তেলের গুনাগুন ততই নষ্ট হয়।ভার্জিন তেল বলতে বোঝানো হয় এই তেল তৈরিতে মিনিমাম তাপ ব্যবহার করা হয়েছে, আর এক্সট্রা ভার্জিন মানে- হয়ত কোন তাপ ব্যবহার করা হয়ইনি। তাপ বিহীন পদ্ধতিতে/ কোল্ড প্রেস করে তেল বের করা হয়েছে। আর এটাই বেস্ট কোয়ালিটির তেল!!!
অনেককেই দেখি বাজার থেকে খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে স্কিনে মাখার তেল কিনে নিয়ে আসেন। যাতে স্পষ্ট করে লেখা থাকে ‘refined / contains mineral oils’ যেটা তারা পড়েই দেখেন না। এমন পাঠকদের আমরা বলি – আচ্ছা আপনার কষ্ট করে পড়ার দরকার নেই। এরপর থেকে শুধু বাজারে যে ভার্জিন/ এক্সট্রা ভার্জিন লেখা খাওয়ার তেল পাওয়া যায় সেটা কিনবেন, অ্যাট লিস্ট আপনার টাকাগুলো বাঁচবে!! ‘
তখন খুব অদ্ভুত একটা জবাব পাই-
খাওয়ার জিনিস কী স্কিনে, চুলে দেয়া যায়??
আপনাদের জন্য একটাই কথা- সবচেয়ে ভালো রূপচর্চা সেটা দিয়েই করা যায় যেটা আপনি নির্দ্বিধায় খেয়ে ফেলতে পারবেন। আর এই নকল আর ভেজালের দুনিয়ায় স্কিনের তেল, চুলের তেল এসব ভেজালে না গিয়ে একবারে খাওয়ার জন্য তৈরি ভার্জিন তেলটাই কিনে নিয়ে আসবেন।
বাংলাদেশে ঘানি ভাঙ্গা ভার্জিন এবং আনরিফাইনড তেল যোগার করাটা খুব মুশকিল। স্পেসালি নারিকেল তেল, যেটা আমরা সবাই এত ব্যবহার করি। আজকে আপনাদের আমার অভিজ্ঞতা থেকে অপরিশোধিত, অর্গানিক, ঘানি ভাঙ্গা নারিকেল তেল চেনার উপায়, এর গুনাগুন এবং বাবহারের কয়েকটি উপায় জানাবো।
কীভাবে চিনবেন? অরগানিক, ভার্জিন ১০০% ন্যাচারাল ঘানি ভাঙ্গা নারিকেল তেল?
– ব্যাক্তিগত এক্সপেরিএন্স থেকে বলছি, আমি আজ পর্যন্ত বাজারের কোন শপ থেকে কেনা নারিকেল তেল থেকে আসল ঘানি ভাঙ্গা তেলের মত কড়া নারিকেলের ঘ্রান পাইনি… বাজারের সব তেল থেকেই কেমন যেন পেট্রোলিয়াম জেলির মত ঘ্রান আসে… আসল তেল যখন প্রথম ঘানি থেকে নামান হয়, এটা থেকে একদম নারিকেলের বরফির মত একটা ঘ্রান বের হয়। অনেক দিন ধরে বোতলে ভরে রাখতে রাখতে এই ঘ্রান তা একটু মিইয়ে যায়।
– রঙের কথা বলতে গেলে বলতে হয়, বোতলে রাখা অবস্থায় নারিকেলের রঙ হয় একদম সোনালি। আর বড় ঘানিতে নারিকেলের খলাসহ পিষে ফেলে তেল বের করা হয়। এবং যেহেতু কোন রাসায়নিক পদ্ধতিতে ফিল্টার না করে একদম ন্যাচারালভাবে ছেকে তেল তৈরি করা হয় তাই তেলের ভিতরে নারিকেলের খোলার হালকা কিছু গুড়ো থাকে।
সংরক্ষণ
অর্গানিক তাজা নারিকেল থেকে তৈরি ঘানি ভাঙ্গা তেল কৃত্রিম উপায়ে পরিশোধন করা হয় না বলে এতে হালকা পরিমান পানি রয়ে যায়। সম্পূর্ণ তাপবিহীনভাবে এই তেল তৈরি হয় বলে তেল ফুটিয়ে পানি দূর করার প্রশ্নই ওঠে না। এতে তেলের গুনাগুন একেবারেই নষ্ট হওয়ার চান্স থাকে।
একটু পানি থাকার কারণে এই তেল ব্যবহার শুরু করার এক বছরের মধ্যেই শেষ করে ফেলাটা ভালো। কারণ তাজা তেলের গুনাগুন এর মধ্যেই অনেকটা শেষ হয়ে যায়। আর আমি মাঝে মাঝেই আমার ঘানি ভাঙ্গা তেলের বোতলগুলো একটু রোদে দেই। ঘরে বানান আচার যেমন রোদে দিলে তাজা থাকে, গন্ধ হয় না। ঠিক তেমন।
এটুকু পড়েই আপনি নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন, আপনার কেনা তেলটার সাথে ঘানি ভাঙ্গা ভার্জিন তেলের তফাৎ আসলে কতটুকু। সুতরাং চিন্তা করে দেখুন, আপনি কতো কষ্ট করেই না টিপস পড়ে পড়ে তেল দিয়ে চুল আর স্কিনের কেয়ার করার চেষ্টা করেন। কিন্তু গোড়াতেই যখন গলদ থাকে তখন আসলেই কি কোন ফল পাবেন?
খাঁটি নারিকেল তেল দিয়ে যা যা করতে পারবেন –
আচ্ছা, এবারে আপনাদের বলি খাঁটি নারিকেল তেল দিয়ে আপনারা কী কী করতে পারবেন-
– চুলের যত্নে নারিকেল তেলের কথা কে না জানে? গোসলের আগে আর পড়ে তো বটেই, যেকোনো মাস্কে এবং হারবাল অয়েল রেসিপিতে এই তেল ব্যবহারে আপনি নিজেই তফাৎ দেখতে পাবেন। মিলিয়ে দেখবেন তো, যারা মাঝে মাঝেই বাজারের রিফাইন্ড তেল দিয়ে হারবাল অয়েল তৈরি করার চেষ্টা করেন তারা, খাঁটি তেলের সাথে কতো তফাৎ!!
– এছাড়া আমি আর আমার মা খাঁটি নারিকেল তেলের বোতলে মাঝে মাঝে এক মুঠ মেথি আর কালোজিরা একটু ভেঙ্গে দিয়ে তেলের মধ্যে ঢেলে রেখে দেই। এর পর ১ সপ্তাহ প্রতিদিন তেলের বোতলটা রোদে রাখি। এতে তেলে মেথি আর কালজিরার এসেন্সিয়াল অয়েল মিশে যায়। এভাবে খাঁটি তেল ইউজ করলে খুশকি কমে যায় আর চুলের গোঁড়া শক্ত হয়।
– গোসলের পর নারিকেল তেল আমি রেগুলারই সারা গায়ে মাখি। বলাই বাহুল্য, মিনারেল অয়েল মেশানো কেনা তেল যেমন ভারি হয় আর চিটচিটে হয় ঘানির তেল তার ৩ ভাগের একভাগ চিটচিটেও হয় না। এবং তেলটা কিছুক্ষনের মধ্যেই স্কিনে অ্যাবজরব হয়ে যায়।
– বাচ্চাদের শরীর মালিশের জন্য আমার দাদি এবং আমার মা সবসময়ই ঘানি থেকে নারিকেল তেল নিয়ে এসে সেটা ব্যবহার করতেন। আজকাল তো বাচ্চাদের গায়েও আমরা বাজার থেকে চোখ বুজে যা পাই তাই কিনে নিয়ে এসে মাখা শুরু করি।
– রেগুলার স্কিনেঅর্গানিক ভার্জিন নারিকেল তেলের মালিশ বয়সের ছাপ কমায়। শরীরের দাগ ছোপদূর করে। যেকোনো ধরণের স্কিনের রোগ দূরে রাখে। সুতরাং, যাদের বয়সের জন্যশরীরের স্কিন ঝুলে যাচ্ছে, অথবাসবসময় স্কিন থেকে চামড়া উঠছে তারা গোসলের আগে সারা শরীরে একটু নারিকেল তেল ম্যাসাজ করে নেবেন। স্কিন অতিরিক্ত ড্রাই হলে গোসলের পর বডি একটু ভেজা থাকতে থাকতেই ম্যাসাজ করবেন। আশা করি যেকোনো বডি লোশন থেকে ভালো ফল পাবেন। আর কোন এক্সট্রা কেমিক্যাল ও আপনার স্কিন টাচ করতে পারবে না।
– জানেন? আমরা যখন কোন কেমিক্যাল বডি লোশন মাখি তখন ২৮ তার ও বেশি অপরিচিত কেমিক্যাল আমাদের বডিতে প্রবেশ করে? আমি যদি এই লোশনের থেকেও ভালো রেজাল্ট ন্যাচারাল প্রোডাক্ট থেকে পাই তবেশুধু শুধু এসব কেনার কি দরকার??
(পার্সোনাল মতামত)
সবশেষে বলতে চাই, এটা খুবই দুর্ভাগ্যেরকথা যে আমি অনেকদিন ধরেই দেখছি আমাদের পাঠকরা ঘানি ভাঙ্গা তেল যোগার করতে না পেড়ে মিনারেল তেল মেশানো বাজে রিফাইন্ড তেল ব্যবহার করার চেষ্টা করেন এবং ফল তো পানই না বরং উলটো স্কিন আর হেয়ারের অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। আর তারচেয়েও বড় কথা কোথা থেকে তারা ভার্জিন অর্গানিক তেল যোগার করতে পারবেন সেটাও তারা জানেন না। এবং খাঁটি তেল তারা চেনেনও না। তাই আজ শেষ করছি আমি যেসব অর্গানিক ব্র্যান্ডের খাঁটি তেল ব্যবহার করি সেগুলোর একটা ছোট লিস্ট দিয়ে-
১। দি বডি শপ রেইনফরেস্ট ফেয়ার ট্রেড ভার্জিন কোকোনাট ওয়েল-
২০০ মিলির বোতলের দাম পড়বে প্রায় ১০০০ টাকা।
২। ভিভা অর্গানিক এক্সট্রা ভার্জিন কোকোনাট ওয়েল-
এক জার ভিভা নারিকেল তেলের দাম পড়বে ১৭৬০ টাকার মত।
৩। স্কিনক্যাফে অর্গানিকভার্জিন কোকোনাট ওয়েল-
২৫০ মিলির বোতলের দাম পড়বে ৬০০ টাকা।
আমি পার্সোনালি যখন ঘানি থেকে তেল কালেক্ট করতে পারি না তখন এই ব্র্যান্ডগুলো ব্যবহার করি। সুতরাং যারা ঘানির তেল ইউজ করতে চান কিন্তু কোথায় কীভাবে পাওয়া যাবে কিছুই জানেন না তারা এই ব্র্যান্ডগুলো ইউজ করতে পারেন চুল এবং ত্বকের বিভিন্ন প্রয়োজনে এবং হোম রেমেডির জন্য। রিফাইন্ড গুনাগুন বিহীন তেলের সাথে আসল তেলের পার্থক্য দেখে নিশ্চয়ই অবাক হবেন।
লিখেছেন – জান্নাত