লামিসা কলেজ পেরিয়ে কেবল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। চোখের দিকে তাকালেই দেখা যায় তার ভবিষ্য জীবনের অনেক স্বপ্ন ঝলমল করছে। কিন্তু লামিসা কী নিজেকে সামলে নিতে পারবে ওর ব্রেস্ট ক্যান্সারের কথা শুনলে? স্তন ক্যান্সার হয়েছে জানলে জীবনের বড় একটা ধাক্কা পাবে মেয়েটা। অথচ জানাতে তো হবেই। ডাক্তার হয়ে এমন কঠিন কাজ আমাদের প্রতিদিনই করতে হয়। তবে লামিসা আশা করি ব্রেস্ট ক্যান্সার সচেতনতায় অন্যদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে। ব্রেস্ট ক্যান্সার নিয়ে আমাদের দেশের মেয়েরা খুবই অজ্ঞ। তাই মানসিক ও শারীরিকভাবে লামিসাদের প্রস্তুত করার সময় এখনি! চলুন ব্রেস্ট ক্যান্সার বিভ্রান্তি সম্পর্কে জেনে নিই।
ব্রেস্ট ক্যান্সার বিভ্রান্তি
১) বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ালে স্তন ঝুলে পড়ে, ফিগার নষ্ট হয়ে যায়
সম্পুর্ণ ভুল ধারণা এই যে বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ালে স্তন ঝুলে পড়ে। ১৫-২০ বছর আগে মানুষ এসব বিশ্বাস করতো। স্তন ঝুলে পড়ার সাথে বা ফিগার নষ্ট হবার সাথে বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর কোন সম্পর্ক নেই। স্তন ঝুলে পড়ার জন্য দায়ী কারণগুলো হলো-
১) বয়স
২) স্তনের সাইজ-আকার-আকৃতি
৩) স্তনে কোন ধরনের টিস্যু বেশি (ফাইব্রাস, গ্রান্ডুলার, নাকি ফ্যাটি)
৪) শারীরিক গঠন, মাতৃত্ব, বংশগতি বা জেনেটিক ফ্যাক্টর (মা-খালাদের যেরকম)
৫) হরমোন, সঠিক ব্রা এর ব্যবহার ইত্যাদি।
বাচ্চাকে স্তন দান করা ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছা এবং আরও হাজারো ফ্যাক্টরের উপর নির্ভরশীল। প্রাসঙ্গিকভাবে বলতে গেলে, যদি সম্ভব হয় বাচ্চাকে জন্মের প্রথম ৬ মাস শুধু বুকের দুধ খাওয়ালেই হয়। বিশ্বজুড়ে শিশু বিশেষজ্ঞরা অন্তত এক বছর পর্যন্ত খাওয়ানোর কথা বলেন (৬ মাসের পর পর্যাপ্ত অন্য খাবারের সাথে)। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দুই বছর পর্যন্ত খাওয়ানোর জন্য রেকমেন্ড করে। এখানে ব্রেস্ট ফিডিং এর কথা কেন আসলো? কারণ, বুকের দুধ যে সন্তানকে সারা জীবনের হাজারো শারীরিক-মানসিক সমস্যা থেকে সুরক্ষা দেয় শুধু তাই না, মাকেও দেয় সুরক্ষা। কিভাবে? ব্রেস্ট ক্যান্সারের রিস্ক ফ্যাক্টর কমানোর একটা বড় অস্ত্র এই ব্রেস্ট ফিডিং। মায়ের শরীরে অন্যান্য হাজারো সুফলের কথা বাদই দিলাম। নিয়মিত ব্রেস্ট ফিডিং যেসব দেশে করানো হয় (যেমন আমাদের দেশে) সেসব দেশে বয়স্কদের স্তন ক্যান্সারের হার উন্নত বিশ্বের চেয়ে একটু কম হবার অন্যতম একটি কারণ এই ব্রেস্ট ফিডিং।
২) ব্রা পরলে ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়
একটা গবেষণা এরকম দাবী করেছিল এবং অনেক বিশেষজ্ঞ এটা বিশ্বাস করেন। কিন্তু এখনও এর পক্ষে কোন জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায় নি। তবে দিনের অনেক সময় ধরে প্রচণ্ড টাইট ব্রা না পরাই উত্তম। কারণ টাইট ব্রা বা পুশআপ ব্রা অতিরিক্ত সময় ব্যবহার করলে তা মেরুদণ্ড এবং রক্ত-লসিকা (রোগ প্রতিরোধকারী রস, লিম্ফ) সার্কুলেশন সিস্টেমের উপর চাপ তৈরি করে। যেটা লং টার্মে নানা রকম সমস্যার জন্ম দেয় (কেউ কেউ বিশ্বাস করেন ক্যান্সারও!) । সঠিক সাইজের ব্রা সিলেক্ট করা এবং পরা তাই গুরুত্বপূর্ণ। তবে কেউ কেউ কিছু সময় বা ঘুমের সময় ফ্রি থাকতে বলেন।
৩) ব্রেস্টে শক্ত কিছু/লাম্প/পিন্ড মানেই ক্যান্সার
প্রায় ৮০-৯০% লাম্পই বিনাইন টিউমার মাত্র, ক্ষতিকর না (একটু পরেই আসছি এগুলো নিয়ে)। তবে এগুলো অবশ্যই নিয়মিত অবজারভেশনে রাখতে হবে। কারণ বিনাইন টিউমারও ম্যালিগন্যান্ট ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে বা ম্যালিগনেন্সিকে লুকিয়ে রাখতে পারে। আরেক ধরনের সমস্যা হয় মহিলাদের বাচ্চা হবার পর, বুকের দুধ জমে গিয়ে স্তন অনেক শক্ত হওয়ে যায়। একে বলা হয় “মাস্টাইটিস”- এটা টিউমার না, ভয়ের কিছুই নেই।
৪) ব্রেস্ট ক্যান্সার বুকে শক্ত পিণ্ডের মত মনে হয়
শক্ত পিণ্ড মানেই যেমন ব্রেস্ট ক্যান্সার নয়, তেমনি ক্যান্সার সাধারণত পিণ্ডের আকারে থাকতেও পারে নাও পারে। সাধারণত বিনাইন (ক্ষতিকর না) টিউমারগুলো শক্ত পিণ্ডের আকার নেয়, ম্যালিগন্যান্ট (ক্যান্সার) যেকোন আকার, আকৃতি, নরম, শক্ত, যেকোন যায়গায় হতে পারে।
৫) ডিওডোরেন্ট ব্যবহারে ক্যান্সার হয়
আরেকটি সূত্র (ইন্টারনেট) থেকে প্রাপ্ত হোক্স/মিথ্যা প্রচারণা এই যে ডিওডোরেন্ট ব্যবহারে ক্যান্সার হয়। এরকম কোন কিছুর প্রমাণ এখনও পাওয়া যায় নি গবেষণাতে। তাই ডিওডোরেন্ট ব্যবহারে বাধার কিছু নেই।
৬) ব্রেস্ট ছোট হলে ক্যান্সার রিস্ক কম
ব্রেস্ট ক্যান্সার ব্রেস্টের সাইজের সাথে কোনভাবেই সম্পর্কিত নয়। ছোট ব্রেস্টে অনেক সময় ক্যান্সার ধরা সহজ হয়। কিন্তু সেটাও ব্যক্তির স্তনের অন্যান্য অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। তাই স্তন বড় মানেই ক্যান্সারের রিস্ক বেশি তা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।
৭) ফ্যামিলিতে কারো না থাকলে আমার ব্রেস্ট ক্যান্সার হবে না
যাদের ফ্যামিলিতে ব্রেস্ট ক্যান্সার আছে তাদের এটা হবার চান্স অনেক বেশি এটা যেমন সত্য তেমনি প্রায় ৭০% ক্যান্সার রোগীর কোন ফ্যামিলি হিস্ট্রি পাওয়া যায় না। বিভ্রান্তি দূর করুন।
৮) ব্রেস্ট বড় করলে (সিলিকন ইমপ্লান্টেশন) ক্যান্সার হয়
ইমপ্লান্টেশন নিয়ে এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। তবে সিলিকন ইমপ্লান্ট করলে ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়ে, ম্যামোগ্রাম এ ঢেকে যায় বলে তাদের প্রায়ই আল্ট্রাসাউন্ডও করাতে হয় ম্যামোগ্রামের সাথে সাথে।
আজকের পড়ে আশা করি আপনাদের মাঝে তৈরি হওয়া ব্রেস্ট ক্যান্সার বিভ্রান্তি দূর হবে। সবাই সচেতন হন, সুস্থ থাকুন।
(চলবে…)
লিখেছেন – শান্তনু বণিক, পি,এইচ,ডি (প্রাক্তন)
স্তন ক্যান্সার গবেষক, ক্যালগেরি
বিশেষজ্ঞের দৃষ্টিকোণ থেকে স্তন ক্যান্সার: কেন হয়? রকমফের এবং নির্ণয়ের উপায় (পর্ব ০২)