একটা জিনিস আজকাল প্রায়ই দেখা যায় যে, প্রতিটা জিনিসেই আমরা নিজেদের একটা মতামত দিতে পছন্দ করি। কাজটা যে খুব কনশাস-ভাবে করা হয় তাও কিন্তু না। এটা কেমন যেন একটা অভ্যাসে পরিনত হয়েছে আমাদের। হয়ত অনেক সময় সেটা কাজে লাগে, আবার অনেক সময় হয়ত কারও জন্য বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কখনো বা আবার এতে অনেকে কষ্টও পেয়ে থাকেন। অথচ এটাও কিন্ত সত্যি যে কষ্টও দেয়ার উদ্দেশ্য হয়ত থাকে না কারোরই। কিন্তু এই অভ্যেসটা যে আসলে খুব একটা ভালো অভ্যেস নয়, সেটা কিন্ত আমাদের বুঝতে হবে। সবার আগে যে জিনিসটা বোঝা দরকারটা হল কোন একটা বিষয়ে নিজের জাজমেন্ট দেয়া আর জাজমেন্টাল আচরণ কিন্ত এক নয়। কোন একটা বিষয়ে আপনার মতামত আপনি তখনই দিতে পারেন, যখন সেটা আপনার কাছে চাওয়া হয় অথবা যার বিষয়ে মতামত দেয়ার অধিকার আপনার আছে। কিন্তু অনেক সময় আমরা পুরো বিষয়টি না জেনেই সেটা জাজ করা শুরু করি, এই বিষয়টি থেকে অনেক সময় আপনি হয়ত নিজের সাথে অন্যদের সম্পর্ক খারাপ করা থেকে শুরু করে অন্যদের মধ্যেও সমস্যা তৈরি করে ফেলতে পারেন। তাই পরেরবার কোন বিষয়ে জাজমেন্টাল হবার আগে নিচের বিষয়গুলো একটু মাথায় রাখবেন, দেখবেন আস্তে আস্তে এই অভ্যাসটাই আপনার ভেতর থেকে চলে গেছে।
পজিটিভ দিক দেখার চেষ্টা করুন: যেকোনো বিষয়ে নিজের মধ্যে মতামত তৈরির সময় সেটার নেগেটিভ দিক না ভেবে পজিটিভ দিক ভাবুন। রেস্তোরাঁয় একদল ছেলেমেয়ে হইচই করছে, সেটা দেখে বাবা-মা কিছু শেখায় নি, এই মন্তব্য করার আগে ভাবুন, ছেলেমেয়ে গুলো কী নিশ্চিন্তেই না জীবনটাকে উপভোগ করছে। বা কাউকে দেখলেন খুব রংচঙা কাপড় পরেছে, চট করেই তার ফ্যাশন সেন্স নেই না ভেবে, ভাবুন না সে কতটা কনফিডেন্স-এর সাথে সেই পোশাকটাকে ক্যারি করতে পারছে।
কমপ্লিমেন্ট খুঁজুন: নিজের মনে মনেই একটা টার্গেট তৈরি করে নিন। রোজ অন্তত দশটা ভালো গুণ খুঁজে সেই জিনিসটাকে আপনি কমপ্লিমেন্ট দেবেন। এতে করে অন্যদের মনে আপনার একটা ভালো ইমেজ তৈরি হবে এবং নিজেও অনেক বেশি ভালো অনুভব করবেন।
নিজেকে তাদের যায়গায় বসান: কাওকে জাজ করার আগে নিজেকে সেই অবস্থানে বসান। একবার ভাবুন, সেই একই আচরণ আপনার সাথে অন্য কেউ আপনার সাথে করলে আপনার কেমন ফিল হবে? বেশিরভাগ সময়ই দেখবেন ভালো লাগছে না। তাহলে? অন্যদের সেটা কিভাবে ভালো লাগবে?
ভিন্নভাবে ভেবে দেখুন: পাশের বাসার বাবুটা কেঁদেই যাচ্ছে। তাদের বাবা-মা বাবুর কান্না থামাতে পারছে না এটা না ভেবে, ভাবুন হয়তো বাবুটা সারারাত কোন কারণে ভালো করে ঘুমোতে পারে নি। কারো একটা কাজ করে দিলেন, সে চট করে একটা থ্যাংকস দিয়ে দুম করে চলে গেলো। তাকে অকৃতজ্ঞ না ভেবে, ভেবে নিন তার হয়তো বস-এর কাছে রিপোর্ট করার তাড়া আছে বা হয়তো জরুরী কোথাও যেতে হচ্ছে। হয়তো এগুলো অযৌক্তিক মনে হতে পারে। কিন্ত মূল কথা হছে, অন্যের বিষয়ে নেগেটিভ ভেবে তার চেয়ে বেশি ক্ষতি কিন্ত আপনার হচ্ছে, আপনার নিজের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। এরচাইতে, থাকুন না একটা ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে!
ইনসিকিউরিটি দূর করুন: শুনতে খারাপ লাগলেও এটা সত্যি যে, অনেক সময়ই আমরা অন্যকে জাজ করি নিজেদের মতামত প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে। সেই সাথে নিজের যদি কোন ত্রুটি থাকে সেটা যেন কার চোখে না পড়ে সেই চেষ্টাও হয়তো খানিকটা থেকে থাকে। পৃথিবীতে কেউই একশত ভাগ পারফেক্ট না। আমিও না, আপনিও না। দোষ-ত্রুটি নিয়েই আমরা সবাই। এটা যেমন নিজের মানতে হবে, তেমনি অন্যদের বেলায়ও তেমন ভাবাটাই কিন্ত শ্রেয়।
গসিপ-এর মোড় ঘুরিয়ে দিন: বান্ধবীদের আড্ডায় গসিপ জিনিসটা খুব কমন। শত চাইলেও এটা এড়িয়ে যাওয়া অনেক সময় খুবই কষ্টকর। আর গসিপ মানেই এর-ওর ব্যাপারে নানান ধরনের মন্তব্য করা। তাই বলে আড্ডা দেয়াও বাদ দেয়া যায়না না, সেখানে গিয়ে কাওকে জাজ কেন করা হচ্ছে সেই নিয়ে কটাক্ষ করাও ভালো দেখায় না। সবচেয়ে ভালো কাজ হচ্ছে, খুব ইজি-ভাবে অন্য একটা বিষয়ে আড্ডার মোড় ঘুরিয়ে নিয়ে যাওয়া।
কাজে ভুল খুঁজুন, ব্যক্তির মাঝে না: ভুল যে কারো হতে পারে। সেক্ষেত্রে ঐ ভুলটাকে একটা ভুল কাজ বা ভুল ডিসিশন হিসেবে দেখুন, ঐ ভুলকে একটা মানুষের সম্পূর্ণ আচরণের প্রতিচ্ছবি দেখা ঠিক না। কেননা, হয়তো ঐ ব্যক্তি ইতিমধ্যেই তার ভুলের ব্যাপারে অনুশোচনায় ভুগছেন, সেখানে আরও চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখালে হয়তো তিনি আরও বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যাবেন। এমনও তো হতেই পারে যে তার হয়তো আরও অনেকগুলো ভালো দিক রয়েছে যেগুলো আমরা জানিই না!
মনের স্পিকার-এর ভলিউম বাড়িয়ে দিন: একটা খুব সহজ কাজ হচ্ছে, যখনই কারো বিষয়ে কোন মতামত মনে চলে আসবে, একবার ভাবুন তো, এই মতামতগুলো জোরে জোরে বলা হলে ঠিক কী কী রিঅ্যাকশন হতে পারে। কেউ মনে মনে কষ্টও পাবে? কারো সাথে আপনার সম্পর্কের অবনতি হবে? অথবা কেউ শুধু শুধু একটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যাবে? সেটার কি খুব প্রয়োজন আছে? নেই তো? তাহলে আর বলবেন কেন?
নিজের দিকটা ভাবুন: আপনার বা আমার নিজের এমন অনেক রকম অভ্যেস আছে, যা হয়তো অনুদের ঠিক পছন্দ হয় না, তাদের মুখ থেকে যদি আপনি কোন জাজমেন্টাল মন্তব্য শোনেন। তাহলে আপনার কেমন লাগবে? যেমন আমি সব সময় একটু ঢিলেঢালা সালওয়ার কামিজে স্বাছন্দ বোধ করি, কেউ যদি আমাকে এই সাজেশন দেয় যে তুমি আরেকটু ফিটিংস-সহ ড্রেস পড়লে তোমাকে ভালো দেখাবে। আমার কিন্ত তাতে বিরক্তি লাগবে। তাহলে একই রকম ব্যাপার অন্যদের ক্ষেত্রেও হয়।
সব শেষ কথা হচ্ছে, কিছু কিছু আচরণ আছে, যাতে হয়তো কারো প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতি হচ্ছে না। কিন্ত পরোক্ষভাবে হয়ত হচ্ছে। তার চেয়ে বড় কথা, আমরা কেন নিজের আত্মউন্নয়ন করবো না? প্রতিটা মানুষেরই এই মনোভাব থাকা উচিত যে, প্রতিদিন একটু একটু করে নিজেকে আরেকটু বেটার হিউম্যান বিং-এ পরিণত করা। তাহলে দেখবেন, নিজেও ভালো থাকছেন, অন্যদের ভালো রাখতে পারছেন।
ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন।
লিখেছেন- মাহবুবা মিমি
ছবি- টাইনিবুডঢা.কম