হাসির মাধ্যমে প্রকাশ পায় সৌন্দর্য। আর প্রাণ খুলে হাসার মূলমন্ত্র হলো সুন্দর ও স্বাস্থ্যোজ্জ্বল দাঁত। কিন্তু সঠিক যত্নের অভাবে এবং খাদ্যাভ্যাস সঠিক না হওয়ায় আমাদের অজান্তেই ধীরে ধীরে দাঁতের ক্ষতি হতে থাকে। মুখের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে নিয়মিত কিছু অভ্যাস তৈরি করা উচিত। যেমন- নিয়মিত ব্রাশ করা, ফ্লসিং করা, মাউথওয়াশ ব্যবহার করা এবং ৬ মাস পর পর ডেন্টিস্টের কাছে দাঁতের চেকআপ করাতে যাওয়া ইত্যাদি। দাঁতের ক্ষতি হয়ে গেলে সেটা ঠিক করা বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই প্রতিরোধ করতে হবে আগে থেকেই। দাঁতের সুস্থতার জন্য বিভিন্ন অভ্যাস রপ্ত করার সাথে সাথে পরিবর্তন আনতে হবে খাদ্যাভ্যাসেও। জানতে হবে, কোন খাবারগুলো দাঁতের জন্য উপকারী এবং কোন খাবারগুলো দাঁতের ক্ষতি করে।
দাঁতের সুস্থতার জন্য খাদ্যতালিকা মেনে চলা কেন জরুরি?
আপনার সুস্থতা অনেকাংশেই মুখের সুস্থতার উপর নির্ভর করে। মুখের ভেতরের যদি নিয়মিত যত্ন না নেওয়া হয় তাহলে নানা সমস্যা হতে পারে। যেমন- মাড়িতে ব্যথা, দাঁত ক্ষয়, দাঁতে পাথর জমা, মুখের ক্যানসার, দাঁতের সৌন্দর্য নষ্ট হওয়া ইত্যাদি। যদি দাঁত সুস্থ থাকে তাহলে সুন্দর করে ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে হাসা সম্ভব। বলা হয়, দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা আমরা অনেকেই বুঝি না। যার কারণে অকালে হারাতে হয় দাঁত। তাই দাঁতের সুস্থতার জন্য নিয়মিত ব্রাশ করা এবং ডেন্টিস্টের কাছে দাঁত চেক আপ করানোর পাশাপাশি ঠিক করতে হবে খাদ্যের তালিকাও। কারণ সব ধরনের খাবার দাঁতের জন্য উপকারী নয়। কিছু খাবার দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকে, আবার কিছু খাবারে চিনি বেশি থাকে যার কারণে দাঁতে ব্যাকটেরিয়া জন্মে। তাই এই খাবারগুলো সম্পর্কে জানা জরুরি।
দাঁত ভালো রাখে যে খাবারগুলো
দাঁত ভালো রাখতে বেশ কিছু খাবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যেমন-
- ক্যালসিয়াম ও অন্যান্য নিউট্রিয়েন্টস যুক্ত লো-ফ্যাট চিজ, দুধ, দই, সবুজ শাক সবজি ইত্যাদি
- প্রোটিনযুক্ত খাবার ডিম, মাছ, মাংস ইত্যাদি খাবারগুলো দাঁতের এনামেলের সুরক্ষা করে
- ফলমূল ও শাকসবজিতে আছে পানি ও ফাইবার, যা মুখের লালা বা স্যালাইভা (Saliva) উৎপাদনে সাহায্য করে
- এনামেলের ক্ষয় হওয়া, দাঁতের ফাঁক থেকে খাদ্যকণা ধুয়ে যাওয়া এবং মুখে স্যালাইভা প্রোডাকশন প্রমোট করতে হেল্প করে পানি। তাই প্রচুর পরিমাণে পানি করা উচিত।
যে খাবারগুলোর কারণে দাঁতের ক্ষতি হয়
দাঁত সুস্থ রাখার ক্ষেত্রে বিভিন্ন কাজের পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাসও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সব খাবারই দাঁতের জন্য ভালো নয়। তাই জেনে নিতে হবে কোন কোন খাদ্য গ্রহণের কারণে দাঁতের ক্ষতি হতে পারে। চলুন জেনে নেই সে খাদ্যগুলো সম্পর্কে-
১) কোমল পানীয়
কোমল পানীয়তে প্রচুর পরিমাণে চিনি থাকে। এই চিনি শুধু শরীরের জন্যই নয়, দাঁতের জন্যও সমানভাবে ক্ষতিকর। বাজারে ডায়েট কোক নামে কিছু ড্রিংকস আছে। অনেকেই চিনি নেই ভেবে সেগুলো পান করেন। কিন্তু এই ড্রিংকসগুলোতে চিনির পরিবর্তে এর সাবস্টিটিউট ফসফোরিক ও সাইট্রিক অ্যাসিড থাকে। এই উপাদানগুলো দাঁতের এনামেল নষ্ট করে দেয়। তাই দাঁতের সুস্থতায় যে কোনো ধরনের কোমল পানীয় খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে।
২) স্টার্চি ফুড
পাউরুটি বেশ সহজলভ্য একটি খাবার। অনেকের বাড়িতেই সকালে নাস্তার টেবিলে পাউরুটি থাকে, আবার বাসায় কোনো খাবার না থাকলে পাউরুটি দিয়ে অল্প সময়ে নাস্তা করা হয়। কিন্তু আপনি কি জানেন অতিরিক্ত পরিমাণে পাউরুটি খাওয়া দাঁতের জন্য ক্ষতিকর? শুধু পাউরুটিই নয়, স্টার্চ আছে এমন যে কোনো খাবার, পাস্তা, আলু, ভাত সবই দাঁতের জন্য ক্ষতিকর। অনেকেই এই খাবারগুলো মিষ্টি না ভেবে রেগুলার ডায়েটে অ্যাড করেন। এই ভুলটাই আমরা করি। স্টার্চি ফুড দাঁতে স্টিকি হয়ে থাকে এবং এগুলো ব্যাকটেরিয়ার খুব ভালো সোর্স। ধীরে ধীরে এই ব্যাকটেরিয়াই দাঁতের জন্য ক্ষতিকারক হয়ে ওঠে। তাই স্টার্চি ফুড যখনই খাবেন, অবশ্যই পরিমাণমতো খাবেন এবং খাওয়া শেষে দাঁত ব্রাশ করবেন।
স্টার্চি ফুড খাওয়ার ফলে লালা বা স্যালাইভা স্টার্চকে ভেঙে চিনিতে পরিণত করে। পরে এই স্টার্চ মুখের মধ্যে একটি আঠালো পেস্টের মতো পদার্থে পরিণত হয়, তখন এটি দাঁতের মধ্যে আটকে যায়। এতে ধীরে ধীরে দাঁতের ফাঁকে ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ হয়। দেখা দেয় ক্যাভিটি। তাই দাঁত সুস্থ রাখতে হলে এ ধরনের খাবার খাওয়ার পরিমাণও কমাতে হবে।
৩) চকলেট ও স্টিকি ফুড
বাচ্চাদের কাছে ক্যান্ডি ও চকলেট মানেই পছন্দের একটি খাবার। শুধু বাচ্চারাই নয়, বড়দের অনেকের কাছেও চকলেট বেশ প্রিয়। এই চকলেট ও ক্যান্ডিতে চিনির পরিমাণ বেশি থাকার কারণে দাঁতে দেখা দিতে পারে ক্যাভিটি। ফলাফল, দিনে দিনে দাঁত ক্ষয়ে যাওয়া। চকলেট খাওয়া শেষে সাথে সাথে দাঁত ব্রাশ বা কুলি করে ফেললে এই রিস্ক কিছুটা কমে যায়। কিন্তু ক্যান্ডি দাঁতের সাথে স্টিকি হয়ে থাকে বলে সেটাই ক্ষতি করে বেশি। এসবের পরিবর্তে চিনি ছাড়া চুইংগাম চিবিয়ে খেলে দাঁত ভালো থাকে। এছাড়া আরও কিছু স্টিকি ফুড যেমন- পিনাট বাটার, পটেটো চিপস দাঁতের ফাঁকে আটকে থেকে ব্যাকটেরিয়ার সৃষ্টি করে।
৪) অ্যালকোহল
অ্যালকোহল যে শরীরের জন্য বেনিফিসিয়াল নয়, সেটা আমরা কমবেশি সবাই জানলেও মানি কয়জন? শরীরের ক্ষতির সাথে সাথে দাঁতেরও ক্ষতি করে এই পানীয়টি। কারণ বেশি পরিমাণে অ্যালকোহল পান করার কারণে মুখ শুকিয়ে যায়। মুখ শুষ্ক থাকা মানে লালার পরিমাণ কমে যাওয়া। অথচ দাঁত ভালো রাখতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। লালা দাঁতে খাবার লেগে থাকতে দেয় না এবং খাবারের কণাকে ধুয়ে ফেলে। এমনকি দাঁতের ক্ষয়, মাড়ির রোগ এবং ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের অন্যান্য প্রাথমিক লক্ষণগুলোকেও সারিয়ে তুলতে হেল্প করে লালা। তাই মুখ সব সময় হাইড্রেটেড রাখা প্রয়োজন। আর এজন্য প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে। সেই সাথে ওরাল হাইড্রেশন সল্যুশনও ব্যবহার করা জরুরি।
৫) কফি
মুখের ভেতরের স্যালাইভা প্রোডাকশনকে কমিয়ে দেয় কফি। আর স্যালাইভার অভাবে মুখের ভেতর শুকিয়ে যায়। এছাড়া কফি ব্যাকটেরিয়া গ্রো করতে হেল্প করে, সেই সাথে কমে যায় দাঁতের এনামেল। ধীরে ধীরে দাঁতে তৈরি হয় ক্যাভিটি, সেনসিভিটি এবং শুরু হয় দাঁতের ক্ষয়।
এই তো জেনে নিলেন, কোন খাবারগুলো আমাদের দাঁতের সুস্থতার জন্য এড়িয়ে চলতে হবে। যে খাবারটাই খাচ্ছেন, সেটি দাঁতের জন্য ভালো কিনা একটু ভেবে নিলে ভালো। সুন্দর দাঁত ও সুন্দর হাসি আমরা সবাই চাই। এই চাওয়ার সাথে সাথে দাঁতের সঠিক পরিচর্যা করতে হবে এবং নির্ধারণ করতে হবে সঠিক খাদ্যতালিকা। তাই ক্ষতিকর খাবার এড়িয়ে চলুন, দাঁতের যত্ন নিন এবং সুস্থ থাকুন।
ছবিঃ সাজগোজ, সাটারস্টক