প্রতি বছর প্রায় ১১ হাজারের বেশি বাংলাদেশি নারী মারা যান জরায়ুমুখ ক্যান্সার বা সার্ভিক্যাল ক্যান্সারের কারণে। মৃত্যুর সংখ্যা শুনে এটাকে খুব দুরারোগ্য ব্যাধি মনে হচ্ছে, তাই না? অথচ সত্যিটা হলো প্রাথমিকভাবে ধরা পড়লে এই ক্যান্সার সম্পূর্ণরূপে সেরে যেতে পারে! তবুও কেনো এত মানুষ মারা যায়? আফসোস এটাই যে, আমাদের নারীদের মধ্যে পরিবারের সবার খেয়াল রাখার সময় থাকলেও নিজের খেয়াল রাখার বেলায় তারা কোথায় যেন আটকে যান। যার ফলশ্রুতিতে দেশে প্রতি বছর এত বড় সংখ্যক নারী সার্ভিক্যাল বা জরায়ুমুখের ক্যান্সার এ মারা যান। চলুন জেনে নেই এ রোগটি সম্পর্কে বিস্তারিত।
সার্ভিক্যাল বা জরায়ুমুখের ক্যান্সার কী এবং কেন হয়?
আমাদের নারীদের শরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ হলো জরায়ু। জরায়ুর কয়েকটি অংশ থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে নিচের অংশটির নাম সার্ভিক্স। এই সার্ভিক্সের ভেতরের কোষগুলো যখন অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে তখন সেই অবস্থাকে আমরা জরায়ুমুখ ক্যান্সার বা সার্ভিক্যাল ক্যান্সার বলি। বাংলাদেশে সার্ভিক্যাল ক্যান্সারের জন্য প্রতিদিন গড়ে ১৮ জন নারী মারা যাচ্ছে। সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপার হলো এই রোগটি যখন আপনার শরীরে ধীরে ধীরে দানা বাঁধে তখন এর লক্ষণগুলো ঠিক সহজে বোঝা যায় না। যার ফলে চিকিৎসাও নেওয়া হয় না আর অকালে ঝরে যায় বহু প্রাণ।
‘হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস’ বা এইচপিভি (HPV) নামক একধরনের ভাইরাসের জন্য এই ক্যান্সার হয় বলে ধারণা করেন বিজ্ঞানীরা। তবে যৌন সঙ্গমের ফলে এর সংক্রমণ ঘটে। সংক্রমণের পর এক বছর বা তার বেশি সময় পর্যন্ত অনেক সময় জরায়ুর কোষগুলো অপরিবর্তিত থাকে, পরে আস্তে আস্তে এটি ক্যান্সারে রূপ নেয়। এখন পর্যন্ত ১০০ ধরনেরও বেশি প্যাপিলোমা ভাইরাস পাওয়া গেছে। তবে এর মধ্যে সবগুলো জরায়ুর জন্য ক্ষতিকর নয়। এইচপিভি-১৬, এইচপিভি-১৮, এইচপিভি-৬, এইচপিভি-১১ এই স্ট্রেইনগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
লক্ষণ
জরায়ুমুখ ক্যান্সারে এত বেশি নারী মৃত্যুবরণের অন্যতম কারণ হলো এই রোগের লক্ষণগুলো অনেক ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়। প্রায় সময় দেখা যায়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে প্রায় ১৮-২৪ মাস পরে গিয়ে সার্ভিক্যাল ক্যান্সারের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া শুরু করে। সাধারণত দেখা যায় অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের নারীদের মধ্যে এই ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি। প্রাথমিকভাবে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায় না। যত রোগ প্রকট হয়, তত ধীরে ধীরে লক্ষণ প্রকাশ পায়। জরায়ুমুখের ক্যান্সারের লক্ষণগুলো হচ্ছে-
১) প্রথমেই সার্ভিক্যাল ক্যান্সারের যে লক্ষণটি চোখে পড়ে সেটি হলো যোনিতে অতিরিক্ত রক্তপাত হওয়া। সাধারণত অনেক দিন ধরে পিরিয়ড হলে বা অতিরিক্ত পিরিয়ড হলে এই লক্ষণ দেখা যায়।
২) টিস্যু ও প্রজনন অঙ্গগুলোর আশেপাশে যখন টিউমার বেড়ে যায়, তখন যৌন সঙ্গমের সময় মহিলারা ব্যথা অনুভব করেন। তাই এই লক্ষণটিকে কিছুটা অ্যাডভান্সড লক্ষণ হিসেবে ধরা হয়।
৩) কোমরে অবিরাম ব্যথা হওয়া সার্ভিক্যাল ক্যান্সারের অন্যতম একটি লক্ষণ।
৪) দুর্গন্ধযুক্ত যোনি স্রাব বের হওয়া আরেকটি প্রাথমিক লক্ষণ। এ সময় যোনি স্রাবের রঙ কিছুটা ফ্যাকাশে, সাদা বা স্রাবের সাথে রক্তও যেতে পারে।
৫) এ সময় মহিলাদের ক্ষুধা পাওয়ার প্রবণতা কমে যায়।
৬) ওজন কমতে থাকে।
৭) অতিরিক্ত পায়ে ব্যথা হয় এবং পায়ে ফোলা ভাব থাকে।
৮) মূত্রাশয়ের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে, যার কারণে প্রস্রাবের সময় ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
৯) সার্ভিক্যাল ক্যান্সার আস্তে আস্তে শরীরের হাড়গুলোতেও প্রভাব ফেলে, যার ফলে হাড় দুর্বল হয় এবং আস্তে আস্তে ভঙ্গুর হয়ে যায়।
১০) সঙ্গমের সময় রক্তপাত হতে পারে।
১১) দুই মাসিকের মধ্যে আবারও রক্তপাত হতে পারে।
কীভাবে জরায়ুমুখের ক্যান্সার নির্ণয় করা হয়?
জরায়ুমুখ ক্যান্সারের লক্ষণগুলো বেশ পরে প্রকাশ পাওয়ায় এটি সঠিকভাবে নির্ণয় করতে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পরীক্ষাটি হলো ‘পেপার স্মিয়ার টেস্ট’। ‘পেপার স্মিয়ার’ বা ‘প্যাপ স্মিয়ার’ টেস্ট নামে পরিচিত এই পদ্ধতিতে জরায়ুমুখ থেকে কোষরস সংগ্রহ করা হয় এবং সেটিকে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হয়। সাধারণত বিবাহিত নারীদের ২১ বছরের পর থেকেই এই টেস্ট করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়। প্রতি দুই বছরে টেস্টটি একবার করতে বলা হয়। তবে ৩০ থেকে ৬৪ বছর বয়সীদের মধ্যে যাদের পর পর তিনবার রেজাল্ট স্বাভাবিক আসে তাদের জন্য তিন বছর অন্তর একবার টেস্ট করে নিলেও হবে।
এই রোগের প্রতিষেধক আছে কী?
এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা চারটি এইচপিভি ভ্যারিয়েন্টের টিকা আবিষ্কার করেছেন। সাধারণত ১০ বছর বয়সের পর থেকেই এই টিকা নেওয়া যায়, সব মিলিয়ে তিন ডোজে টিকা নিতে হয়। প্রথম ডোজের এক মাস পর দ্বিতীয় ডোজ, প্রথম ডোজের ছয় মাস পর তৃতীয় ডোজ। তবে গর্ভাবস্থায় এই টিকা কোনোভাবেই নেওয়া যাবে না। আর একবার ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার পর এই টিকা নিলে সেটি প্রতিষেধকের কাজ করবে না।
সার্ভিক্যাল বা জরায়ুমুখের ক্যান্সার প্রতিরোধের জন্য করণীয়
আমাদের রোগবালাইয়ের বেশিরভাগই আমাদের জীবনযাত্রার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা যায়। তাই এত মারাত্মক একটি ক্যান্সার আপনার আশেপাশে আসার আগেই বরং সতর্ক হয়ে নিন। বিজ্ঞানীরাও ঔষধি প্রতিষেধকের চেয়ে জীবনযাত্রার প্রতিরোধকে বেশি গুরুত্ব দেন। কী করবেন তাহলে সার্ভিক্যাল ক্যান্সারকে আপনার ত্রিসীমানার বাইরে রাখতে?
- সুষম খাবার গ্রহণ করা
- ধূমপান না করা
- পরোক্ষ ধূমপান থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখা
- পানের সাথে জর্দা বা সাদা পাতা না খাওয়া
- দাঁতের গোড়ায় গুল দিয়ে না রাখা
- সঙ্গমের সময় কনডম ব্যবহার করা
- একাধিক সঙ্গীর সাথে সঙ্গম পরিহার করা
- নিয়মিত প্যাপ স্মিয়ার টেস্ট করা
জরায়ু একজন নারীর নারীসুলভ বৈশিষ্ট্য প্রকাশের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। প্যাপিলোমা ভাইরাসের কারণে এই অঙ্গটিই যদি ঝুঁকিতে পড়ে তার ফলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাই জীবনযাত্রার দিকে মনোযোগ দেওয়া জরায়ুর যত্নের জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ! সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।
ছবিঃ ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউট, সাটারস্টক