চোখ ওঠা বা কনজাংটিভাইটিস নামের সমস্যার সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। চোখের পর্দা বা কনজাংটিভায় প্রদাহের কারণে এটি হয়। এটি একটি ভাইরাস জনিত সমস্যা। জীবনে কখনো চোখ ওঠেনি এমন মানুষ হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। আবার পরিবারে একজনের চোখ উঠেছে কিন্তু বাকিরা কেউ আক্রান্ত হয়নি, এমনও সচরাচর দেখা যায় না। কারণ এটি সংক্রামক রোগ। শীতকালীন আবহাওয়ায় এবং বসন্তের শুরুর দিকে চোখ ওঠা খুবই পরিচিত অসুখ। এ সময় প্রকৃতিতে আসে নানা পরিবর্তন। যেমন- বাতাসে ভেসে বেড়ায় ফুলের রেণু, ধূলিকণা, পাখির পালক ইত্যাদি। বাতাসের মাধ্যমে এগুলো আমাদের নাক, চোখ ও ফুসফুসে প্রবেশ করে। চোখে প্রবেশ করলে অ্যালার্জি, চোখ ওঠার মতো সমস্যা দেখা দেয়। কেন চোখ ওঠে এবং এ রোগটি হলে কোন কোন বিষয়ে সাবধান থাকা উচিত এসব বিষয়েই বিস্তারিত জানাবো আজকের আর্টিকেলে।
চোখ ওঠার লক্ষণগুলো কী কী?
- বেশিরভাগ সময় দুই চোখ লাল হলেও অনেক সময় এক চোখও লাল হতে পারে
- চোখে পুঁজের মতো জমা হয় এবং ঘুম থেকে ওঠার পর চোখের দুই পাতা জোড়া লেগে থাকে
- চোখে ব্যথা হয় এবং চোখ থেকে অনবরত পানি ঝরে
- অস্বস্তি হয় বা চোখ খচ খচ করে
- চোখের নিচের অংশ ফুলে লাল হয়ে যেতে পারে
- চোখে জ্বালাপোড়া ও চুলকানি হতে পারে
- চোখের মণির চারপাশে হালকা লাল হয়ে থাকে
- ফটোফোবিয়া বা রোদে তাকাতে অসুবিধা হতে পারে
কেন চোখ ওঠে?
কুসংস্কার প্রচলিত আছে, চোখ ওঠা রোগীর চোখের দিকে তাকালেই চোখ ওঠে বা অন্যরাও আক্রান্ত হয়। এ তথ্য ঠিক নয়। তবে চোখ ওঠা অতিমাত্রায় ছোঁয়াচে ও সংক্রামক। এ রোগটি হয় মূলত ভাইরাস ছড়ানোর মাধ্যমে। চলুন জেনে নেই কীভাবে এ রোগের ভাইরাস ছড়ায়-
১) চোখে ভাইরাসের কারণে প্রদাহ হলে চোখের পানিতে ভাইরাস ভেসে বেড়ায়। সরাসরি হাত দিয়ে চোখ স্পর্শ করলে বা এই পানি মুছলে ভাইরাস হাতে চলে আসে। সেই হাতে কোনো কিছু স্পর্শ করলে ভাইরাস সেখানেও সংক্রমিত হয়।
২) আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত তোয়ালে, রুমাল, টিস্যু, সানগ্লাস বা কাপড় ব্যবহারের মাধ্যমে ভাইরাস ছড়ায়।
৩) আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলে, টিভি বা এসির রিমোট, বিছানার চাদর, বালিশ, মোবাইল ইত্যাদির মাধ্যমে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে।
৪) চোখ ওঠা বা কনজাংটিভাইটিস বায়ুবাহিত রোগ বলে ভাইরাস বাতাসের মাধ্যমেও ছড়ায়।
চিকিৎসা
চোখ উঠলে আতংকের কিছু নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে চোখ ওঠা সম্পূর্ণ নিরাময় হয়ে যায়। অন্যান্য লক্ষণের পাশাপাশি ঠান্ডা বা সর্দিজনিত উপসর্গ থাকলে অ্যান্টিহিস্টামিন খাওয়াই যথেষ্ট। বেশি সমস্যা হলে চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিভাইরাল ড্রপ ডোজ মেনে ব্যবহার করা যেতে পারে। এ সমস্যা হলে ডাক্তারের পরামর্শমতো সঠিকভাবে সঠিক সময় ওষুধ নেয়া জরুরি। অনেকে চোখ উঠলে বারবার পানি দিয়ে পরিষ্কার করেন বা চোখে পানির ঝাপটা দেন। এমনটি না করে চোখ পরিষ্কার রাখার জন্য দিনে কয়েকবার কুসুম গরম পানি দিয়ে হালকাভাবে চোখ ধুয়ে নিতে পারেন।
চোখ ওঠা বা কনজাংটিভাইটিস হলে যে সব বিষয়ে সাবধান থাকতে হবে
১) চোখে কোনোভাবেই হাত দেয়া যাবে না।
২) কালো চশমা ব্যবহার করুন। এতে বাইরের ধুলাবালি ও বাহ্যিক আঘাত থেকে চোখকে রক্ষা করা যায়। এছাড়াও কালো চশমা ব্যবহারে রোদ ও আলোতে চোখে আরাম হয়।
৩) চোখের পানি ও ময়লা মোছার জন্য হাতের বদলে আলাদা তোয়ালে বা রুমাল ব্যবহার করুন।
৪) চোখে পিচুটি জমলে হালকা বা নরম পরিষ্কার কাপড় দিয়ে বা হালকাভাবে পানির ঝাপটা দিয়ে চোখ পরিষ্কার করতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে, কোনোভাবেই চোখ রগড়ানো যাবে না।
৫) হাত সব সময় সাবান বা স্যানিটাইজার দিয়ে পরিষ্কার রাখতে হবে।
৬) চোখের পাতা অতিরিক্ত ফুলে গেলে সেক্ষেত্রে বরফ দেওয়া যেতে পারে।
৭) নিজের ব্যবহার করা প্রসাধনী সামগ্রী ও কাপড় অন্যকে ব্যবহার করতে দেয়া যাবে না এবং নিজেও অন্যেরটা ব্যবহার করা যাবে না।
৮) অন্যের ব্যবহৃত আই ড্রপ বা অয়েন্টমেন্ট ব্যবহার করা যাবে না।
৯) শিশুর চোখ উঠলে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
১০) অসুস্থ চোখে কন্টাক্ট লেন্স ব্যবহার করা যাবে না।
১১) সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। অপরিষ্কার কাপড় দিয়ে চোখ মোছা যাবে না।
১২) জনসমাগম, অনুষ্ঠান, ক্লাস ইত্যাদি পরিহার করে চলাই ভালো। শিক্ষার্থীদের চোখ ওঠা সমস্যা নিয়ে ক্লাসে না যেয়ে বাসাতেই বিশ্রাম নেয়া উচিত। যদি পরীক্ষা বা জরুরি কাজ থাকে তাহলে সব ধরনের নিয়ম মেনে স্কুলে যাওয়া যেতে পারে। তবে অবশ্যই কালো চশমা পরে থাকতে হবে।
চোখের যে কোনো রোগই হোক, অবহেলা করবেন না। কারণ সামান্য ভুলের জন্য সারাজীবন আফসোস করতে হতে পারে। চোখ ওঠা মারাত্মক কোনো সমস্যা নয়। তবে কর্নিয়ার প্রদাহ হলে এবং সময়মত চিকিৎসা না নিলে এটি মারাত্মক রূপ ধারণ করতে পারে। স্থায়ীভাবে দৃষ্টিশক্তি কমে যেতে পারে। তৈরি হতে পারে কর্নিয়া সংযোজনের মতো অবস্থা। করোনার এ সময়ে চোখ ওঠা নিয়ে আরো সতর্ক হতে হবে। প্রয়োজন হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ছবিঃ সাটারস্টক