করোনাভাইরাস হানা দেওয়ার পর সবচেয়ে বেশি যে সিস্টেমকে মানুষ উন্নত করার চেষ্টা করেছে সেটা হলো ইমিউন সিস্টেম। আমাদের শরীরে বেশ কিছু সিস্টেম বা তন্ত্র আছে। কয়েকটি অঙ্গ মিলে একটি তন্ত্র হয়। সেসব তন্ত্রের মধ্যে পরিপাক, সংবহন, প্রজনন, প্রতিরক্ষা ইত্যাদি আরো বেশ কিছু তন্ত্র রয়েছে। প্রতিরক্ষা তন্ত্র বা ইমিউন সিস্টেম আমাদের শরীরে যত রোগজীবাণু প্রবেশ করে এদের সবাইকে হিরোর মতো ফাইট করে হারিয়ে দেয়, যার জন্য আমরা হুট করেই অসুস্থ হয়ে যাই না। কিন্তু অনেক সময় আমাদের নিজেদের ভুলে বা শারীরিক অন্যান্য সমস্যার জন্য এই ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হয়ে যায়। যে নিজেই দুর্বল সে আর কীভাবে লড়াই করে আমাদের শরীরের অন্য সব তন্ত্রকে সুরক্ষা দিবে? আজকে জানাবো ডায়েট ও লাইফস্টাইলের মাধ্যমে ন্যাচারালি ইমিউনিটি বাড়াতে কী কী করা যায় তার উপায় সম্পর্কে।
কীভাবে কাজ করে আমাদের ইমিউন সিস্টেম?
ইমিউনিটি বাড়াতে কী কী করা দরকার সেগুলো তো জানা হবেই, তার আগে চলুন একটু ছোট করে জেনে আসি কীভাবে আমাদের ইমিউন সিস্টেম কাজ করে। চারটি অঙ্গ নিয়ে আমাদের ইমিউন সিস্টেম গঠিত। এগুলো হলো-
- থাইমাস ও বোন ম্যারো
- লিম্ফ নোডস ও ভেসেলস
- স্প্লিন বা প্লীহা
- স্কিন বা চামড়া
মজার কথা হলো, আমাদের সারাদেহের সব অঙ্গের বাহ্যিক আবরণী বা কভারিং এর কাজ করে একটি মাত্র অঙ্গ, চামড়া। অর্থাৎ সারাদেহের চামড়া একসাথে একটি অঙ্গের মতো কাজ করে। বাইরের যে কোনো শত্রুর বিরুদ্ধে সবার আগে তাই সুরক্ষা দেয় এই স্কিন বা চামড়া।
আমাদের ইমিউন সিস্টেমের কোষগুলোর প্রায় ৭০-৮০ ভাগ কোষেরই অবস্থান হলো আমাদের অন্ত্র বা গাটসে। তাই যদি ক্ষুদ্রান্ত্র ও বৃহদান্ত্র তাদের কাজ ঠিকমতো করে, বলা যেতে পারে এতেই দেহের সুরক্ষার সিংহভাগ কাজ হয়ে যায়। কীভাবে এই তন্ত্র আমাদের সুরক্ষা দেয়? আমাদের ইমিউন সিস্টেমে ডেনড্রাইট, টি সেল ও ম্যাক্রোফেজ নামে তিন ধরনের কোষ আছে। দেহে যখনই ক্ষতিকর কোনো জীবাণু প্রবেশ করে তখনই ডেনড্রাইট সক্রিয় হয়ে টি সেলকে বার্তা পাঠিয়ে সতর্ক করে দেয়। টি সেল তখন সৈনিকের মতো ঢাল তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধ করে সেই বিদেশি শত্রুর বিরুদ্ধে- যাকে আমরা ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, মাইক্রোবস ইত্যাদি নামে ডাকি। টি সেল একাই বেশিরভাগ সময় যুদ্ধ করে এদেরকে হারিয়ে দেয়। তবে যদি সেটা না হয়, তখন ব্যাক আপ হিসেবে ম্যাক্রোফেজ কোষগুলো সেই শত্রুকে ভ্যানিশ করে ফেলে। এভাবেই কোষগুলোর ইউনিটির মাধ্যমে আমাদের দেহের ইমিউনিটি রক্ষা পায়।
ন্যাচারালি ইমিউনিটি বাড়ানোর উপায়গুলো কী কী?
শুধু যে নির্দিষ্ট কিছু খাবার ইমিউনিটি বাড়াতে সাহায্য করে এমনটা কিন্তু নয়, বরং স্বাস্থ্যকর ডায়েটের সাথে যখন স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা যোগ হয় তখন কোনো বাইরের শত্রুর ক্ষমতা নেই আমাদের শরীরে ঢুকে রোগ বাসা বাঁধাবে। তাই বেশ কিছু অভ্যাস আমাদের জীবনে গড়ে তোলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন-
১) হালকা ব্যায়াম করা
আপনাকে জিমে যেয়ে মাসে মাসে পার্সোনাল ট্রেইনার রেখে কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করতে হবে এমন নয়, বরং বাসায় বসেই প্রতিদিন হালকা কিছু এক্সারসাইজ বা ইয়োগা করে নিতে পারেন। গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে, যারা ব্যায়াম করে তাদের দেহে অন্যান্যদের তুলনায় টি সেল বেশি তৈরি হয়। তাই ফিট থাকা মানে সুস্থ থাকাও বটে।
২) পর্যাপ্ত ঘুমানো
জি হ্যাঁ, ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও সুস্থ থাকা যায়! তবে সেই ঘুমটা অবশ্যই হতে হবে পরিমিত ও নিয়মিত। আমরা যখন ঘুমাই তখন আমাদের ব্রেইন অ্যাড্রিনালিন ও প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন হরমোন ক্ষরণ কমিয়ে দেয়, এর ফলে টি সেলগুলো নিজের কাজ সুন্দরভাবে করতে পারে। টি সেলের কাজ ঠিকমতো হওয়া মানেই ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধে জয়ী হওয়া। তাই প্রতিদিন কমপক্ষে ৬-৮ ঘন্টা ঘুমের অভ্যাস থাকা জরুরি। আর কোনোভাবেই লেট নাইট জাগা শরীরের জন্য ভালো না, এতে হরমোনের ইমব্যালেন্স হয়।
৩) শারীরিক পরিশ্রম করা
আমাদের জীবন এখন অফিসের কাজ আর বাসায় টিভির সামনে বসে থাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আমরাও অলস হয়েছি আর ইমিউন সিস্টেমও অলস হয়ে যাচ্ছে। এই বিপদ থেকে বাঁচতে প্রতিদিন কিছু হলেও শারীরিক পরিশ্রম করুন। সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করা, হেঁটে যেয়ে বাজার করা, কিছুক্ষণ বাগানে সময় দেয়া এরকম সহজ কিছু কাজের মাধ্যমেই আপনার দেহের রক্ত সঞ্চালন বেড়ে যাবে এবং শরীরের দূরতম কোষ পর্যন্ত পৌঁছে যাবে অক্সিজেন। তখন আমাদের কোষগুলো সজীব থাকবে এবং ন্যাচারালি ইমিউনিটি বাড়াতে সক্রিয়ভাবে কাজ করবে।
৪) ভিটামিন ডি যুক্ত খাবার তালিকায় রাখা
ভিটামিন ডি আমাদের দেহের ক্রনিক বা দীর্ঘস্থায়ী রোগগুলোকে দূরে রাখতে সাহায্য করে। শরীরে ভিটামিন ডি কম থাকা মানে টাইপ ১ ও ২ ডায়াবেটিস, আলঝেইমার, হার্টের ও কিডনির অসুখের সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়া। তাই যদি এগুলোকে দূরে রাখতে চান প্রতিদিন অন্তত ১৫-২০ মিনিটের জন্য সূর্যের আলোতে যান এবং বেশি করে ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার খান।
৫) স্ট্রেসকে দূরে রাখা
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে এটা শুনতে অসম্ভব লাগলেও এই ছোট কাজটিই আপনার শরীরের জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতি করে দিতে পারে। আপনি খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করলেন, ঠিকঠাক সময়ে ঘুমালেন কিন্তু আপনার দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা একেবারেই কমলো না। এতে করে কী হবে? আপনার ব্রেইন কর্টিসল হরমোন বের করবে, যেটা কিনা টি সেলের কাজ কমিয়ে দেয়। ফলে কী হবে? ইমিউনিটি আস্তে আস্তে কমে যাবে। তাই রোগ দূরে রাখতে চাইলে, দূরে রাখুন স্ট্রেসটাও।
সুস্থ থাকতে কে না চায়? কিন্তু তারপরও নিজেদের ছোট ছোট অভ্যাসের ভুলেই আমরা নিজেদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে ফেলি। ন্যাচারালি ইমিউনিটি বাড়াতে এই পদ্ধতিগুলো ফলো করলে সুস্থ থাকা সম্ভব। নিজেকে যদি ভালোবেসে থাকেন তাহলে এখন থেকেই সতর্ক হোন ইমিউনিটি নিয়ে! সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।
ছবিঃ সাটারস্টক