বাচ্চার বয়স ৬ মাস+ হলেই তাকে বাড়তি খাবার দিতে হয়। ৬ মাস বয়স পর্যন্ত শুধুমাত্র মায়ের বুকের দুধই যথেষ্ট। নতুন মায়েরা খুব স্বাভাবিকভাবেই একটু চিন্তায় থাকেন যে কীভাবে শিশুকে নতুন খাবারে অভ্যস্ত করাবেন। আজকের ফিচার শিশুর প্রথম সলিড খাবার নিয়েই। কেমন হওয়া উচিত বাচ্চাদের খাদ্যতালিকা, কোন ফল বা খাবার প্রথমে দিতে হবে, সবই আজ আমরা জেনে নিবো।
০-৬ মাস বয়সী শিশুর খাবার
শিশু জন্মের সাথে সাথে এক ঘন্টার মধ্যে শাল দুধ খাওয়াতে হবে। পূর্ণ ৬ মাস বয়স পর্যন্ত শুধুমাত্র মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো উচিত। এমনকি এক ফোঁটা পানিও মুখে দেওয়া যাবে না। সন্তান প্রসব হবার পর মায়ের বুকে প্রথম হালকা হলুদ বর্ণের যে আঠালো দুধ আসে তাকে শাল দুধ বলা হয়। শাল দুধ পরিমাণে কম হয় কিন্তু এর পুষ্টিগুণ অনেক বেশি।
শাল দুধের উপকারিতা দেখে নিন এক নজরে
- শিশুর জীবনের প্রথম টিকা হিসেবে কাজ করে
- নবজাতকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
- শিশুর পেট থেকে কালো বর্জ্য পদার্থ (মিকোনিয়াম) বের হতে সাহায্য করে
- শিশুর জন্ডিসের প্রবণতা কমে আসে
- শাল দুধে শরীর বৃদ্ধিকারক উপাদান থাকে
৬ মাস পর্যন্ত শুধুমাত্র মায়ের বুকের দুধই যথেষ্ট
- মায়ের বুকের দুধ শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশ নিশ্চিত করে
- শিশুর রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়ায়- যেমন ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, অ্যালার্জি, হাঁপানি প্রতিরোধে সাহায্য করে
- বুকের দুধ খেলে শিশুদের পরবর্তীতে ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়
- শিশু ও মায়ের মাঝে গভীর ভালোবাসার বন্ধন গড়ে উঠে
- মায়ের প্রসব পরবর্তী রক্তচাপ অনেকটাই কন্ট্রোলে থাকে
- মায়ের ডায়াবেটিস, স্তন ও জরায়ুর ক্যান্সারের সম্ভাবনা কম থাকে
- পরিবারের অর্থনৈতিক সাশ্রয় হয় (ফর্মুলা মিল্কের খরচ বাঁচে)
শিশুর প্রথম সলিড খাবার
৬ মাস বয়স পর্যন্ত কেবলমাত্র মায়ের বুকের দুধ খাওয়ার পরে যখন দুধ ছাড়া অন্য খাবার শুরু করে সেটাকে বলে উইনিং (Weaning) এবং যে খাবার দিয়ে উইনিং শুরু করা হয় সেগুলোকে বলা হয় উইনিং ফুড (Weaning Foods)। উইনিং ঘরের খাবার দিয়ে শুরু করলেই সবচেয়ে ভালো। প্রথম সলিড ফুড হিসেবে আদর্শ কিছু খাবার হচ্ছে-
- চটকানো পাকা কলা
- মিষ্টি আলুর পিউরি
- ডালের পানি দিয়ে চটকানো নরম ভাত
- ফলের রস (টক জাতীয় ফল বাদে)
- জাউ ভাত, সবজি সেদ্ধ
- আস্তে আস্তে চাল, ডাল ও ২ ধরনের সবজি দিয়ে রান্না করা খিচুড়ি
শিশুর প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় প্রধান ৭ রকমের খাবার থেকে কমপক্ষে ৪ রকমের খাবার অবশ্যই রাখা উচিত।
প্রধান ৭ রকমের খাদ্যতালিকা
- মাছ, মাংস
- ডিম
- রঙিন শাক সবজি
- অন্যান্য শাক সবজি ও ফলমূল
- ভাত, রুটি
- বাদাম, ডাল জাতীয় খাবার
- দুগ্ধজাত খাবার
শিশুর প্রথম সলিড খাবার কীভাবে শুরু করবেন?
১) প্রথম দিন- ১ চামচ, দুপুর বেলা। দ্বিতীয় দিন- ২ চামচ, সকালে ও দুপুরে। তৃতীয় দিন- ৩ চামচ, সকালে, দুপুরে ও রাতে।
২) শিশু রান্না করা খাবার খাওয়া শুরু করলে শিশুর খাবারে ২/৩ চামচ তেল দিয়ে রান্না করতে হবে।
৩) প্রতিদিন ১ পোয়া বাটির হাফ বাটি করে দিনে দু’বার ঘরে তৈরি বাড়তি খাবার এবং ১-২ বার পুষ্টিকর নাস্তা খাওয়াতে হবে।
৪) এই সময়ে সারাদিন শিশু ৩ ঘন্টা পর পর খাবে, যার মধ্যে দু’টি বাড়তি খাবার এবং একটি পুষ্টিকর নাস্তা দিতে হবে। যেমন- কলা, ডাবের পানি, ফলের রস, দুধ ইত্যাদি। সকাল শুরু করতে হবে বুকের দুধ বা ফর্মুলা মিল্ক দিয়ে। ২ বছর পর্যন্ত শিশুকে বুকের দুধ দেওয়া যায়।
শক্ত খাবারে অভ্যস্ত হওয়ার পর ফুড চার্ট কেমন হবে?
১) সকাল ৮টা- নরম খিচুড়ি। (খিচুড়িতে যা যা থাকতে পারে- ১ মুঠ চাল, চালের অর্ধেক পরিমাণে ডাল, দুই রকমের সবজি, ২-৩ চামচ তেল, কাঁটা ছাড়া মাছ, চিকেন অথবা কলিজা)
২) সকাল ১১টা- বুকের দুধ/ফর্মুলা মিল্ক/দুধ দিয়ে রান্না করা সুজি/সেরেলাক/সিজনাল ফল
৩) বেলা ২টা- নরম খিচুড়ি/ডাল দিয়ে নরম ভাত সাথে মাছ বা মাংস এক পিস
৪) বেলা ৫টা- যেকোনো ফল যেমন- পাকা কলা/পাকা পেঁপে/আম অথবা সেদ্ধ ডিমের কুসুম/নরম বিস্কুট/নুডলস
৫) রাত ৮টা- দুপুরের মতো ভাত, সবজি, মাছ
৬) ঘুমানোর আগে- বুকের দুধ/ফর্মুলা মিল্ক
৬ মাসের পর থেকে বাচ্চাকে পানিও দিতে হবে। অনেকে খিচুড়ির বদলে সকালে বাচ্চাকে রোলড ওটস বা সেরেলাক খাওয়ান, এতেও সমস্যা নেই। তবে বাইরের প্যাকেটজাত ফুড না দিয়ে ঘরে তৈরি খাবার দেওয়ার চেষ্টা করবেন। এতে ঘরের খাবারে সে অভ্যস্ত হবে। শিশুর কাছে এই খাবারগুলো নতুন, তাই প্রথমেই সব হজম নাও হতে পারে। তাই সব নতুন খাবার একদিনে দেওয়া শুরু করবেন না। পর্যায়ক্রমে একটা একটা করে আরম্ভ করুন। যদি কোনো খাবার বাচ্চাকে স্যুট না করে বা হজম না হয় অথবা হুট করে অ্যালার্জি হয়, তাহলে সেটা দেওয়া বন্ধ রাখুন।
উইনিং এর শুরুতে যেসব সমস্যা হতে পারে
উইনিং এর সময় নতুন খাবার খেয়ে আপনার শিশুর অ্যালার্জি হতে পারে। বাচ্চার যে যে লক্ষণ দেখে আপনি ফুড অ্যালার্জি বলে চিহ্নিত করতে পারবেন, সেগুলো হলো-
- পেট ব্যথা সাথে কান্না ও পেট মোচড় দেওয়া
- বার বার বমি
- গায়ে র্যাশ ওঠা
- লালচেভাব দেখা দেওয়া
- নাক দিয়ে পানি পড়া ইত্যাদি
এরকম হলে চেষ্টা করুন কোন খাবারে অ্যালার্জি হচ্ছে সেটা বের করতে। সেই খাবারটি দেওয়া সাময়িকভাবে বন্ধ রাখুন। তারপর কিছু দিন পরে সেটা আবারও দিন। যদি দ্বিতীয়বারও শিশুর অ্যালার্জি হয়, তবে নিশ্চিত ধরে নিন সেই খাবারটিই অ্যালার্জির কারণ।
খেয়াল রাখুন কিছু বিষয়ে
শিশুর খাবারে সামান্য ঘি মিশিয়ে খাওয়াতে পারেন। শিশুর প্রথম সলিড খাবার দেওয়া যখন শুরু হয়, তখন অনেক ক্ষেত্রে শিশুর পটি শক্ত হয়ে যায় বা টয়লেট করতে তার কষ্ট হয়। এক্ষেত্রে তার ফুড মেন্যুতে কাঁচা পেঁপে, মিষ্টি কুমড়ো রাখতে হবে। জাউ ভাতের সাথে এই সবজিগুলো দিতে পারেন বা খিচুড়ির সাথে এই সবজি মিক্স করতে পারেন। এতে টয়লেট স্বাভাবিক হবে। হজমের সমস্যা হলে ২ বছরের আগে বিফ বা মাটন না দেওয়াই ভালো। আর ২ বছরের আগে সরাসরি গরুর দুধ খাওয়ানো থেকে বিরত থাকুন।
সব খাবার শিশু শুরুতে পছন্দ নাও করতে পারে। তাকে জোর করে খাওয়াবেন না। তবে গবেষণায় দেখা গেছে যে একবার কোনো খাবার শিশু খেতে না চাইলে যদি সেই খাবারটা তাকে বার বার দেওয়া হয়, আস্তে আস্তে ঐ খাবারের প্রতি তার আগ্রহ হয়। জোর না করে মাকে ধৈর্য রাখতে হবে। খাবারগুলো কালারফুল প্লেটে সার্ভ করলে শিশুর আগ্রহ বাড়বে। সব সময় ব্লেন্ড করে লিকুইড খাবার শিশুকে দিবেন না, এতে সে চিবিয়ে খেতে শিখবে না। শরীরের পুষ্টির চাহিদা পূরণে ঘরে বানানো খাবারে তাকে অভ্যস্ত করে তুলুন, তাকে নিজের হাতে খেতে দিন। খেলতে খেলতেই সে নিজের হাতে খেতে শিখবে! আজ এই পর্যন্তই। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
ছবি- সাটারস্টক