আপনার ছোট বাচ্চাটাকে নিয়ে সমস্যা? কারণে বা অকারণে মিথ্যা বলতে শুরু করেছে? শাসন অবশ্যই করবেন, তবে তার আগে ভালো করে তাকান নিজের আয়নাটির দিকে। আপনার বাচ্চা শিখছে কার কাছ থেকে? হয়ত আপনার থেকেই। কীভাবে শোধরাবেন? কাকে আগে শোধরাবেন? আসুন দেখি নিচের ঘটনা গুলো:
ঘটনা ১ – আহনাফই তুলেছিল ফোনটা। মাহমুদ নামে কে যেন চাচ্ছে বাবাকে। একটু লাইনে থাকেন বলেই ফোনটা রেখে আহনাফ এক দৌড়ে বাবার ঘরে। বাবা তখন অফিসে যাওয়ার তোড়জোড় করছেন, বের হবেন বলে। আট বছরের ছেলের মুখে মাহমুদ নামটা শুনেই প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন- ওরেব্বাবা! মাহমুদের সাথে কথা বলতে গেলে ১ ঘণ্টার আগে ছাড়তে চাইবেনা! এতো বক বক করতে পারে লোকটা!
আহনাফ কে কাছে ডেকে গাল টিপে একটু আদর করে দিলেন। কিচ্ছু করার নেই। ইনভেস্টমেন্ট বলা চলে একে। কাউকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে চাইলে এটুকু করতেই হয়। তারপর একটু আহ্লাদ মাখা গলায় ছেলেকে বললেন যাও বাবা উনাকে গিয়ে বোলো আমি বাড়িতে নেই, কেমন? কিন্তু বাবা তুমি তো বাড়িতেই আছো। আছি কিন্তু আমি এতো ব্যস্ত, প্লিজ বাবা উনাকে গিয়ে বলো বাবা বাসায় নেই আপনি পরে কল করেন, ঠিক আছে? অতএব আহনাফ চলল বাবার শেখান কথাটা বলতে।
[picture]
ঘটনা ২ – এই বছর নয় পেরিয়ে দশে পরল শ্রেয়া। স্কুলে তার বেস্ট ফ্রেন্ড হল তিতলি। দুজনের মায়ের মধ্যেও ভালোই আলাপ পরিচয় আছে। স্কুল থেকে যার যার মেয়েকে আনতে গিয়ে দুজনে নানারকম গল সল্প করেন। সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল বলে শ্রেয়ার মা বললেন চলুন আমার গাড়িতেই আপনাদের নামিয়ে দেই, বাসা তো একই পথে। গাড়িতে শ্রেয়া আর তিতলি দুই বান্ধবী গল্প জুড়ে দিয়েছিল আপন মনে। হঠাৎ শ্রেয়ার কানে এল তিতলির মা তার মাকে বলছেন, আপনি সেদিন শাড়িটা এমব্রয়ডারি করিয়ে আনলেন, তার ডিজাইনটা একটু দেবেন ভাবি? উত্তরে তার মা যা বলল তাতে অবাক হল শ্রেয়া। ঐ ডিজাইনটা তো একজনের থেকে আনিয়েছিলাম ভাবি, কোথাও তো আলাদা করে আঁকা নেই। অথচ শ্রেয়া জানে তার ছোট খালার কাছ থেকে ডিজাইনটা এনেছিলেন আম্মু।
তিতলির মা এবার বললেন তাহলে একটু শাড়ী টাই দিন না ১ দিনের জন্য। ডিজাইনটা তুলে নিতাম আমি। এবার শ্রেয়া আগের থেকেও বেশি অবাক হল। সে দেখল তার মা অম্লানবদনে বলছেন- শাড়িটা তো নেই ভাবি, আমার ননদের জন্য বানিয়েছিলাম, ও নিয়ে গেছে ঢাকার বাইরে এক বিয়েতে পরবে বলে। এবার শ্রেয়ার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। শাড়িটা তো কালকেও একটা পার্টিতে পরলেন আম্মু! বাসাতেই আছে ওটা। তিতলি আর ওর মাকে নামিয়ে দিয়েই এতক্ষণের হজম না হওয়া প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করে মাকে। তুমি তিতলির আম্মুকে ওসব কী বললে? কেন বললে? উত্তরে মা শীতল গলায় বললেন তুমি চুপ করো, যা বোঝো না, তা নিয়ে কথা বলনা। আরও কিছু জানতে গেলে পাছে আম্মু বকা দেয়; তাই আর কোন কিছু জিজ্ঞেস করল না শ্রেয়া।
ঘটনা ৩ – মৌদের বাড়িতে একটা নতুন জিনিস কেনা হয়েছে সম্প্রতি। লালা টুকটুকে আর নরম তুলতুলে একটা বিনব্যাগ। ইচ্ছামতো শেপে বাঁকিয়ে ইউজ করায় এটাকে। ইচ্ছা হল বসতে, ওমনি বানিয়ে ফেলা হল আরামদায়ক সোফা। ওটাতে গড়িয়ে পড়লে হয়ে যাবে গা ডোবানো আদুরে ডিভান। বসে, শুয়ে, গড়িয়ে আরাম যেন আর শেষ হয়না। এমন মজার একটা জিনিস পেয়ে ৭ বছরের মৌ আর ওর ৫ বছরের ভাইয়ের খুশির সীমা নেই। পাশের ফ্ল্যাটের মাহিনের মাও সেদিন এসে জিনিসটা দেখে খুব মজা পেলেন বোধ হয় তারও মনে হয়েছিল – এরকম একটা কিনলে হয়। মৌয়ের মাকে জিজ্ঞেস করেন বিনব্যাগটার দাম। মা বললেন হাজার দশেক। খানিকটা হতবাক হয়ে গেলো মৌ। সে নিজের কানে শুনেছে তার বাবা কিনে নিয়ে এসে মাকে বলছিল পুরো ছয় হাজার পড়ল! তাহলে? কিছু বুঝতে না পেরে মাকে এই ব্যাপারে বলতে গেছে, উল্টো ধমক খেয়ে চুপ করে গেছে সে।
কী? অবাক হলেন তো? নিজের জীবনের সঙ্গে হয়ত বা মিলে যাচ্ছে অনেকেরই। এমন কত কিছুই ঘটে চলে আমাদের প্রতিদিনকার জীবনে। আমরা খেয়াল করিনা। আমরা এটাও খেয়াল করিনা আমরা এভাবে প্রতিনিয়ত বাচ্চাদের কতটা ক্ষতি করে চলছি। মুখে তাদের আমরা সর্বদা বলি- সত্যি কথা বলবে। বলা উচিত, ইত্যাদি। তাদের মিথ্যা আমাদের কাছে ধরা পড়লে আমরা তাদের চোখও রাঙাই। কিন্তু আমরা অনেকেই জানিনা যে বাচ্চারা মুখে বলা উপদেশ শুনে শিখেনা। তারা চেতন মনে বা অবচেতন মনে আমাদেরই অনুকরণ করে চলে। আর সেজন্যই বড়দের চলনে বলনে আচরণে খুব সতর্ক হওয়া উচিত। যেন তাদের কোন ভুল ব্যবহার বা আচরণ ছোটদের সামনে ভুল দৃষ্টান্ত দাঁড় করিয়ে না দেয় সেটা বড়দেরই খেয়াল রাখতে হবে।
বিপদের এখানেই শেষ নয় কিন্তু! আরও বেশ খানিক বড় হলে মানে কৈশোর এর মাঝামাঝি যখন আপনার সন্তান এই হুট হাট মিথ্যা বলার পেছনের কার্যকারণ বুঝতে শেখে, অভিজ্ঞতাকে বিচারের পাল্লায় রেখে নিজেরাই ঘটনা গুলোকে পর পর সাজিয়ে উল্টে পাল্টে বিশ্লেষণ করতে শিখে যায়, তখন তারা বড়দের মধ্যে থাকা এই ত্রুটি গুলোকে ঘৃণা করতে শুরু করে। অথচ সন্তান এই সময়েই চায় বাবা মাকে অনুকরণ যোগ্য দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে, তাদের শ্রদ্ধা করতে। আর সেখানে অসঙ্গতি থেকে গেলে স্বাভাবিক ভাবেই তারা বাবা মায়ের সান্নিধ্য থেকে নিজেদেরকে বঞ্চিত মনে করতে শুরু করে। এর ফল হয়ে উঠতে পারে মারাত্মক। আমরা নিজের মনের অজান্তে এই ভুলগুলো করি আর মিথ্যা বলার জন্য সন্তানকে দুষতে থাকি। একবার ভেবে দেখিনা যে আমাদের সন্তানে রয়েছে আমাদেরই আচরণের প্রতিফলন। “ও তো ছোট ও কী বুঝবে” জাতীয় কিছু ভেবে নেই। মানুষের মন বোঝার ক্ষমতা যে কম বেশি তারও আছে সেইটা একবারও ভাবিনা। ভুলটা হয় সেখানেই। তাই সবার আগে প্রয়োজন নিজেকে শোধরানোর। আচার স্বভাবে রাতারাতি নিখুঁত হয়ে যাওয়া হয়ত কারো পক্ষেই সম্ভব না। তবে নিজেদের ভুলত্রুটি গুলোকে খুঁজে বের করে ধীরে ধীরে সেগুলোকে সচেতন হয়ে সংশোধন করার চেষ্টা নেওয়াটা তো সম্ভব। মনে রাখবেন, আপনার প্রজন্ম কিন্তু আপনাকে লক্ষ করেই সামনের দিকে এগিয়ে চলছে, এগিয়ে চলবে। শুভকামনা রইল সবার জন্য।
লিখেছেন – চৌধুরী তাহাসিন জামান
ছবি – সিএনএন ডট কম