”আমার সন্তান যেন থাকে দুধ-ভাতে!” প্রতিটি বাবা-মা এরই শখ থাকে তাদের সন্তান সকল গুণে পরিপূর্ণ হয়ে বেড়ে উঠবে। আর এই বেড়ে উঠার এক পর্যায়ে যেয়ে বাঁধে সংঘর্ষ। শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা দেয়ার সময়টা যেমন দুঃসহ ছেলে-মেয়েদের জন্য, তেমনি বাবা-মা এর জন্য উৎকণ্ঠার।
১৩-১৯ বছর বয়সের সময়কে টিনএজ বয়স বলা হয়ে থাকে। এ সময় শারীরিক, মানসিক ও অভ্যাসগত অনেক পরিবর্তন দেখা যায় যার অধিকাংশই বাবা-মা সহজভাবে নিতে পারেন না, অপরদিকে ছেলে-মেয়েরাও ভয় বা সংকোচে বলতে পারেনা। ফলে সূচনা হয় পারস্পারিক দূরত্বের। একসময় দূরত্ব ও ভুল বুঝাবুঝি থেকেই অনেক ছেলে-মেয়ে পা বাড়ায় ভুল পথে, অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয় অসংখ্য পুষ্প কলি। চলুন জেনে নেয়া যাক কিভাবে এসব সমস্যা সমাধান করা সম্ভব …
১। বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করুন
প্রথমেই বাবা-মা এর চিরাচরিত জায়গা থেকে একটু সরে এসে সন্তানের সাথে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করুন। তার প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। সঠিক জায়গায় উত্তর দিন এবং আলোচনা করুন।আগে থেকেই শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন সম্পর্কে ধারণা দিন। ফলে এসব ব্যাপারে আপনার সাথে আলোচনা করতে অস্বস্তিবোধ করবে না। জেনে নিতে পারেন প্রতিদিন স্কুল বা কলেজে কি কি হয়েছে, রাস্তায় নতুন বা ব্যাতিক্রমী কিছু হয়েছে কিনা ইত্যাদি।
[picture]
২। সন্দেহপ্রবণতা দূর করুন
মোবাইলে কথা বলার সময় আপনাকে দেখে কল কেটে দিলে বা কিছুক্ষণ দরজা বন্ধ করে রাখলেই সন্দেহ না করে কারণ বোঝার চেষ্টা করুন। সন্দেহ থেকেই ভুল বুঝাবুঝির শুরু। কৌশলে জেনে নিতে পারেন আপনার সন্তান ঠিক কাদের সাথে মিশছে। মাঝে মাঝে তার বন্ধুদের বাসায় দাওয়াত দিতে পারেন। এতে আপনার সন্তান ও খুশি হবে এবং আপনিও তার সঙ্গিদের ব্যাপারে সচেতন থাকবেন।
৩। সন্তানকে উৎসাহ দিন
মাঝে মাঝে ছেলে-মেয়েকে ছোট ছোট দায়িত্ব দিন। হতে পারে, আশে পাশের সুপারশপ থেকে কিছু কেনাকাটা করা বা কোনো দাওয়াতে আমন্ত্রিত দের তালিকা করা ইত্যাদি। সঠিকভাবে কাজ করলে তাকে ধন্যবাদ জানান। পড়ালেখা ও অন্যান্য কাজের জন্য ছোট উপহারও দিতে পারেন। এতে পরবর্তীতে আরও ভালো কাজ করার উৎসাহ পাবে।
৪। মতামতের গুরুত্ব দিন
সবসময় নিজেদের ইচ্ছা জোর করে চাপিয়ে দিবেন না। পারিবারিক বিষয় গুলোতে সন্তানের মতামত নিন। ফলে সে নিজেকে পরিবারে গুরুত্বপূর্ণ মনে করবে। তার কোনো মত গ্রহণযোগ্য না হলে না রেগে গিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় সহজ যুক্তি ও বাস্তব উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে বলুন। সন্তানের মতামতের পিছনে তার যুক্তিটাও জানার চেষ্টা করুন। তার চিন্তাধারা সম্পর্কেও আপনি ধারণা পেয়ে যাবেন।
৫। তুলনা করা পরিহার করুন
অল্পবয়সী ছেলে-মেয়েদের বাবা-মা এর প্রতি বিরক্তির অন্যতম কারণ তুলনা। প্রতিটি ছেলে-মেয়ের নিজস্বতা আছে। তাদেরকে সহপাঠী, বন্ধু বা প্রতিবেশীর সাথে তুলনা করলে তারা নিজেকে ছোট মনে করে এবং আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। ফলশ্রুতিতে তাদের মানসিক বিকাশ বাঁধাগ্রস্ত হয়।
৬। শাসন হোক পরিমিত
অনেক বাবা-মা মনে করেন, বকা-ঝকা বা মারলেই হয়ত সন্তানকে মানুষ করা সম্ভব। কিন্তু, আসলেই কি তাই? যেহেতু টিনএজ বয়সে আবেগ খুব বেশি কাজ করে, ফলে অতিরিক্ত শাসনের প্রভাব অধিকাংশ ক্ষেত্রে নেতিবাচক হয়। তাই সন্তান ভুল করলে তাকে বুঝিয়ে বলুন। পরিবারে একাধিক সন্তান থাকলে, একজনকে অপরজনের সামনে শাসন করবেন না। এতে ছেলে-মেয়েরা হীনমন্যতায় ভোগে।
৭। মেধা বিকাশে সহায়তা করুন
সকল মানুষের চিন্তাশক্তি, পছন্দ-অপছন্দ ভিন্ন। সবাই গতানুগতিক ধারায় শুধুমাত্র পড়ালেখায় আগ্রহী হবে এমন কোনো কথা নেই। কেউ হয়ত গান গাইতে ভালোবাসে, কেউ হয়ত ভালো ছবি আঁকে, কেউ আবার খেলাধুলায় খুব পারদর্শী। এক্ষেত্রে ছেলে-মেয়েকে জোর না করে তার মেধা বিকাশে সহায়তা করুন। আপনার সন্তানের ভালো লাগা ও পারদর্শিতার ক্ষেত্র অনুযায়ী তাকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ দিন।
৮। মাথা ঠাণ্ডা রাখুন
একান্তই যদি সন্তান ঔদ্ধত্য হয়ে থাকে, তাহলে মাথা গরম না করে তাকে শুধরানোর সময় ও সুযোগ দিন। এসময় ছেলে-মেয়েরা নিজেদের খুব অসহায় মনে করে, তাকে আশ্বাস দিন যে তার আস্থা ও সম্পূর্ণ নির্ভরতার জায়গায় আপনারা আছেন। প্রয়োজনে ছুটির দিনে কোথাও বেড়াতে যেতে পারেন অথবা পছন্দের কোনো খাবার রান্না করতে পারেন।
নতুন কুঁড়িগুলোর বিকাশে বাবা-মা এর দায়িত্ব অনেক বেশি। সামান্য কিছু প্রয়াস আর সচেতনতা আপনার সন্তানকে সঠিক পথে পরিচালিত হতে সাহায্য করবে। সম্পর্কের বাঁধনগুলো হবে আরও দৃঢ় এবং অটুট।
লিখেছেন- অনিন্দিতা আঁখি
মডেল- ফারিন ও শাপলা