আমার কোন কন্যা সন্তান নেই। তবু কল্পনা করতে পারি, কন্যা সন্তানের অভিভাবকেরা বর্তমানে কী প্রবল মানসিক চাপের মধ্যে আছেন শুধু মাত্র এই ধর্ষণ এর জন্য ! যে দেশে স্কুলের ভেতরে ক্লাস ওয়ানের ছাত্রী নিরাপদ নয়, সে দেশে রাস্তায় ইভ-টিজিং নিয়ে চমকে ওঠার অবকাশ থাকে না। পত্রিকায় ধর্ষণ এর খবর পাওয়া যায় প্রায় প্রতিদিন। রাস্তায় মেয়েদেরকে উত্যক্ত করার ঘটনা নতুন নয়, যুগ যুগ ধরে ঘটে আসছে। যৌন হয়রানির খবরগুলো মিডিয়াতে গত কয়েক বছর ধরে আগের তুলনায় গুরুত্ব পাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু পরিবর্তন কতটুকু এসেছে? এসব কাজ যারা করে, তাদের বাসায় মা তো আছেনই, বোনও হয়তো আছে। তবু তারা করছে। কেন করছে? এবার ধর্ষণ ঘটনা থামাতে পরিবারের সচেতনতার সাথে সাথে রাষ্ট্রের আইনের ভূমিকা হতে হবে আরও জোরালো।
ধর্ষণ প্রতিরোধে করণীয়
১) পরিবার
আগেই বলেছি, আমার কোন মেয়ে নেই। ছেলের বাবা হয়ে আমি কি তবে নিশ্চিন্তে থাকব? যত দুশ্চিন্তা কি তবে শুধু মেয়ের বাবা-মায়ের? না। আমার দায়িত্ব বরং আরো বেড়ে গেল। আমার ছেলে যেন মেয়েদেরকে সম্মান করতে শেখে সেটা শেখানো আমার দায়িত্ব। আমার মনে হয়, আমাদের সমাজে এই বিষয়টা গত কয়েক দশক ধরে ঠিক মতো গুরুত্ব পাচ্ছে না। পরিবার থেকে একজন কিশোর শিখছে না, বাইরের একজন মেয়েকে কীভাবে সম্মান করতে হয়।
পরিবার থেকে মানুষ তার প্রথম শিক্ষাটি গ্রহণ করে। কাজেই সন্তান যদি দেখে, তার বাবার কাছে মা তাঁর প্রাপ্য সম্মান পাচ্ছেন এবং একে অপরের কাজে সাহায্য করছেন, সেই সন্তানটির ভেতরও সেই বীজ রোপিত হয়। পরিবারে ছেলে-মেয়ে উভয়েই থাকলে বাবা-মায়ের উচিত নয় পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে সন্তানকে বড় করা। আমাদের সমাজের একটা বড় অংশ মেয়ের তুলনায় ছেলেকে প্রাধান্য দেয়। এতে মেয়েটি হীনমন্যতায় ভোগে, আর ছেলেটি মনে মনে অহংকারি হয়ে ওঠে।
২) শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান
শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে (বিশেষ করে যেখানে ছেলে-মেয়ে এক সাথে পড়ে) শিক্ষকদের বিশাল ভূমিকা রয়েছে মেয়েদের প্রতি ছেলেদেরকে শ্রদ্ধাশীল করার। খোলামেলা আলোচনা হওয়া উচিত ইভ-টিজিং নিয়ে। এর ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে পাঠ্যবইতে নতুন কিছু অধ্যায় রাখা প্রয়োজন।
৩) মিডিয়া
ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার ভূমিকা যথেষ্ট নেতিবাচক। এখনকার যৌন-উত্তেজক দৃশ্য সম্বলিত দেশি-বিদেশি চলচ্চিত্র আর ভিডিও গান দেখে তারা নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে ভাবতে শিখছে (বিজ্ঞাপনগুলোও বা কম যায় কিসে?)। হাতের মুঠোয় এখন ইন্টারনেট। পর্ণোগ্রাফী এখন অতি সহজলভ্য। প্রতিকার কী? আমি কি আমার সন্তানকে ইন্টারনেট থেকে দূরে সরিয়ে রাখব? সম্ভব নয়। তবে ওর ভেতর মূল্যবোধের শিক্ষা দেওয়াটা জরুরি। সেটা ধর্মীয় অনুশাসন দিয়ে করা যায়, গল্প বলার ছলে করা যায়, পত্রিকায় প্রকাশিত খবর বা প্রবন্ধ নিয়ে সহজভাবে আলোচনা করেও করা যায়। মোট কথা, ছেলের সাথে বাবা-মায়ের যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, সেটাকে কাজে লাগিয়েই ওকে বোঝাতে হবে যে মেয়েদেরকে কোন চোখে দেখা উচিত, কোন চোখে দেখা উচিত নয়। যে মেয়ের সাথে অন্যায়টি করা হচ্ছে, তার মনোস্তাত্বিক বিশ্লেষণটা বিষদভাবে করা দরকার। আমার মনে হয় এটা একটা উপযুক্ত সমাধান।
৪) ছেলেদের বয়:সন্ধিকালে পরিবারের কিছু পদক্ষেপ
ভারতীয় চলচ্চিত্রের গড়পরতা অবস্থা বর্তমানে জঘন্য, তবু ভালো কিছু চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, হচ্ছে। “ফড়িং” নামে একটা চলচ্চিত্র দেখলাম। একজন কিশোর কীভাবে বিকৃত যৌনাচারের দিকে ধাবিত হয়, তার খুব স্বাভাবিক চিত্রায়ন করা হয়েছে সেখানে। আমাদের এই উপমহাদেশে কিশোররা এভাবেই ভ্রান্তপথে চালিত হয়। আমার নিজের কৈশোরের অভিজ্ঞতাও খুব শোভন নয়। কৈশোরের শুরুতেই খারাপ ধরনের কিছু সঙ্গী-সাথীর পাল্লায় পড়েছিলাম।
সেখান থেকে বেরোতে পেরেছিলাম কয়েক বছর পর এবং সেটা আমার ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত হবার কারণে। তাছাড়া আমার মায়ের সাথে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তিনিও আমার ভুলগুলো শুধরে নিতে যথাসাধ্য সাহায্য করেছিলেন। “ফড়িং” বা এই জাতীয় সিনেমা সব বাবা-মায়ের দেখা উচিত। কারণ, ছেলে বয়:সন্ধিতে পৌঁছবার সাথে সাথে বাবা-মায়ের (বিশেষ করে বাবার) দায়িত্ব বেড়ে যায়।
আমার মনে হয়, সমাজের প্রতিটা বাবা বা বড় ভাই যদি একজন কিশোরকে বোঝাতে পারে, যে একজন মেয়েকে উত্যক্ত করা বা যৌন হয়রানি করাটা কত বড় মাপের অপরাধ এবং সেই মেয়েটির স্থানে নিজের মা, বোন বা প্রিয় বন্ধুকে বসিয়ে যদি তাকে বিষয়টির ভয়াবহতা অনুধাবন করানো যায়, সামনের দিনগুলি হয়তো আজকের মতো বিভীষিকাময় হবে না।
ছবি- সংগৃহীত: সাজগোজ; ইমেজেসবাজার.কম