গত কয়েকদিন ধরে ৫৫ বছর বয়সী রফিক সাহেবের পায়ের আঙুলের জয়েন্টে বেশ ব্যথা হয়। কখনো কখনো ব্যথা এতটাই বেড়ে যায় যে হাঁটতে কষ্ট হয়। ঠিক একই সমস্যায় অল্প কিছুদিন ধরে ভুগছে ৩৫ বছর বয়সী রাকিব। আজকাল ঘুম থেকে উঠলেই হাতের ও পায়ের একটি আঙুল সে নাড়াতে পারে না। কয়েক সেকেন্ড পর নাড়াতে পারলেও ব্যথা সহজে কমে না। দুই বয়সের দুজন মানুষ, অথচ তারা একই সমস্যায় ভুগছেন। চিকিৎসকের কাছে গিয়ে তারা জানতে পারলেন, তাদের দুজনের শরীরেই ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছে, যার কারণে তারা এই প্রবলেমগুলো ফেইস করছেন। আজ আপনাদের জানাবো ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে গেলে কী কী প্রবলেম হতে পারে, কীভাবে বুঝবেন এটি বেড়ে গিয়েছে কিনা এবং এর চিকিৎসা সম্পর্কে বিস্তারিত।
ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে গেলে কী হয়?
পরিবারের মুরুব্বিরা অনেক সময় শরীরের বিভিন্ন জয়েন্ট চেপে ধরে ব্যথার অভিযোগ করেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ব্যথা গাউট বা গেঁটে বাতের কারণে হয়। শরীরের গিঁট বা জয়েন্টে ব্যথা হয় বলে একে এই নামে ডাকা হয়। গাউট হলো এক ধরনের আর্থ্রাইটিস যা জয়েন্টগুলোতে ইউরিক অ্যাসিড ক্রিস্টাল জমা হওয়ার কারণে হয়। এটি একটি বেদনাদায়ক এবং দীর্ঘস্থায়ী অবস্থা। ঠিকমতো চিকিৎসা না হলে এর ফলে জয়েন্টের ক্ষতি বা বিকৃতিও হতে পারে।
যে লক্ষণে বুঝবেন ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে গিয়েছে
গেঁটে বাত বা গাউটের লক্ষণ ও উপসর্গ প্রায় সবসময়ই হঠাৎ করে দেখা যায়। সাধারণত রাতের বেলা এই ব্যথা বেশি হয়। যে লক্ষণে বুঝবেন ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে গিয়েছে-
জয়েন্টে তীব্র ব্যথা
গাউটের সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ হলো যে কোনো একটি জয়েন্টে, বিশেষ করে হাত ও পায়ের বুড়ো আঙুলে হঠাৎ এবং তীব্র ব্যথা। গেঁটে বাত সাধারণত বুড়ো আঙুলকে বেশি প্রভাবিত করে, তবে এটি যেকোনো জয়েন্টেই হতে পারে। সাধারণভাবে আক্রান্ত অন্যান্য জয়েন্টগুলোর মধ্যে রয়েছে গোড়ালি, হাঁটু, কনুই, কব্জি ও আঙুল।
দীর্ঘস্থায়ী অস্বস্তি
ব্যথা শুরু হওয়ার পরে প্রথম ৪ থেকে ১২ ঘন্টার মধ্যে সবচেয়ে তীব্র হতে পারে। তীব্রতম ব্যথার রেশ কমে যাওয়ার পরও কিছু জয়েন্টের অস্বস্তি কয়েকদিন থেকে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। পরবর্তীতে ব্যথা হলে সেটা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে এবং অন্যান্য জয়েন্টগুলোকেও প্রভাবিত করতে পারে।
লালচে ভাব
আক্রান্ত জয়েন্ট বা জয়েন্টগুলো ফুলে যায়, ব্যথা থাকে এবং লালচে হয়ে যায়। সাথে জ্বরও থাকতে পারে।
নড়াচড়ার সীমাবদ্ধতা
বাতের ব্যথা যত বাড়তে থাকে জয়েন্ট এর মুভমেন্ট তত কমতে থাকে। সেই সাথে আক্রান্ত জয়েন্ট শক্ত হয়ে যেতে পারে।
এছাড়া গাউটে আক্রান্ত কিছু লোকের অন্যান্য জটিলতা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি হয়- বিশেষ করে হার্ট ও কিডনিতে। যেমন- উচ্চ রক্তচাপ, স্থুলতা, ডায়াবেটিস, কিডনিতে পাথর, হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেইলর ইত্যাদি। সময়ের সাথে সাথে গাউট আক্রমণগুলো আরও ঘন ঘন এবং দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
কেন এই অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে যায়?
রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা অনেক কারণেই বাড়তে পারে। শরীরে অতিরিক্ত মাত্রায় এই অ্যাসিড তৈরির ফলে অথবা প্রয়োজনীয় মাত্রায় দেহ থেকে নিঃসরণ না হলে অথবা উভয় কারণেই এটি বেড়ে যেতে পারে।
রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের উচ্চমাত্রার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে-
১) ডাই-ইউরেটিকস জাতীয় ঔষধ সাধারণত শরীর থেকে লবণ ও পানি বের করে প্রেশার কমাতে সাহায্য করে। এটি প্রস্রাব বাড়ায় যা শরীরে তরলের পরিমাণ হ্রাস করে, তবে অবশিষ্ট তরল আরও ঘনীভূত করে, যার ফলে ইউরিক অ্যাসিডের ক্রিস্টাল জমে ব্যথা বাড়ায়।
২) অতিমাত্রায় সোডা এবং ফ্রুক্টোজ বা চিনি জাতীয় খাবার খেলে।
৩) অতিরিক্ত ওজনের কারণে শরীর বেশি ইউরিক অ্যাসিড তৈরি করে এবং কিডনির মাধ্যমে এর নিষ্কাশন কঠিন হয়ে পড়ে। তখন রক্তে এই অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে যায়।
৪) লাল মাংস, সামুদ্রিক খাবার এবং অ্যালকোহলের মতো পিউরিন সমৃদ্ধ খাবার খেলে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়তে পারে।
কাদের ঝুঁকি বেশি?
সাধারণত ৪০ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে গাউট বেশি দেখা যায়। তবে বর্তমানে ৪০ এর কম বয়সীরাও এতে আক্রান্ত হচ্ছেন। মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের গাউট হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, যদিও মেনোপজের পরে মহিলাদেরও ঝুঁকি বেড়ে যায়। কারও পরিবারে যদি এই সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছেন এমন ব্যক্তি থাকেন, তবে বংশগতভাবে তিনিও আক্রান্ত হতে পারেন। এছাড়া কিছু মেডিকেল কন্ডিশন যেমন- উচ্চ রক্তচাপ, কিডনির সমস্যা, ডায়াবেটিস গাউটের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
গাউট নির্ণয় করার উপায়
গাউট নির্ণয়ের জন্য শারীরিক পরীক্ষার পাশাপাশি রক্ত পরীক্ষার মতো বিভিন্ন ইমেজিং পরীক্ষা যেমন- এক্স-রে বা আল্ট্রাসাউন্ড করানো হয়। চিকিৎসক একটি জয়েন্ট অ্যাসপিরেশনও করাতে পারেন। এ ক্ষেত্রে আক্রান্ত জয়েন্ট থেকে একটি সুঁই দিয়ে তরল বের করে নিয়ে তা পরীক্ষা করা হয়। সেই তরল পরীক্ষা করে দেখা হয় যে তাতে ইউরিক অ্যাসিডের ক্রিস্টাল আছে কি না।
চিকিৎসা
গাউট চিকিৎসার উদ্দেশ্য হল ব্যথা উপশম করা, ইনফ্ল্যামেশন কমানো এবং ভবিষ্যতে গাউট আক্রমণ প্রতিরোধ করা। সেক্ষেত্রে নিচের কিছু উপদেশ মেনে চলা যাতে পারে-
১) ব্যথা ও প্রদাহ কমাতে সাধারণত (NSAID) বা স্টেরয়েডবিহীন ব্যথানাশক ব্যবহার করা হয়।
২) লাইফস্টাইল মোডিফিকেশন যেমন- ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, মদ্যপানে বিরত থাকা। উচ্চ পিউরিন যুক্ত খাবার যেমন- ইলিশ মাছ, চিংড়ি মাছ, কিশমিশ, বিভিন্ন রকম ডাল ইত্যাদি পরিহার করা।
৩) কিছু ক্ষেত্রে আক্রান্ত জয়েন্ট থেকে ইউরেট ক্রিস্টাল অপসারণের জন্য অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হতে পারে।
৪) প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা। এতে বডি থেকে ইউরেট বিল্ডআপ ফ্ল্যাশ আউট হয়ে যায়। এই ইউরেটই ইউরিক অ্যাসিড ক্রিস্টাল তৈরি করে, যা পরে জয়েন্টে ব্যথা ও ইনফ্ল্যামেশনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
গেঁটে বাত একটি বেদনাদায়ক এবং দীর্ঘস্থায়ী অবস্থা। যদিও গাউটের কোনো প্রতিকার নেই, তবে চিকিৎসার মাধ্যমে ব্যথা কমাতে এবং ভবিষ্যতে গাউট আক্রমণ প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে। লাইফস্টাইল পরিবর্তন করে এবং নির্ধারিত ওষুধ সেবন করে এই রোগের লক্ষণগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সবাই সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।
ছবিঃ সাটারস্টক