ঘুম থেকে উঠে মুখে হাত দিতেই অনুভব করলেন কেমন যেন তেল চিটচিটে ভাব৷ নাক ও নাকের আশেপাশে জমে আছে তেল৷ সামার সিজনে এই সমস্যা বেশি হলেও অনেকের তো সারা বছরই স্কিন এমন তেলতেলে থাকে৷ মনে প্রশ্ন আসতেই পারে কোথা থেকে আসে এই তেল? কীভাবেই বা একে কন্ট্রোল করা যায়? স্কিনের এক্সেস সেবাম প্রোডাকশন কেন হয় এবং কীভাবে এটি কন্ট্রোল করা যায় সে বিষয় নিয়েই আলোচনা করবো আজকে।
স্কিন কেন অয়েলি হয়?
আমাদের স্কিনে সেবাসিয়াস গ্ল্যান্ড নামে ক্ষুদ্র গ্রন্থি আছে। এখান থেকেই ন্যাচারালি সেবাম প্রোডিউস হয়। স্কিনকে ময়েশ্চারাইজড ও প্রোটেক্টেড রাখাই সেবামের প্রধান কাজ। অ্যান্ড্রোজেন হরমোন এই গ্ল্যান্ডকে স্টিমুলেট করে। অর্থাৎ সেবাম প্রোডিউস করার জন্য সিগন্যাল পাঠায়। এই গ্ল্যান্ডগুলো টি-জোন (ফোরহেড, নোজ ও চিন এরিয়া) এ বেশি অ্যাকটিভ থাকে, যার কারণে অন্যান্য এরিয়ার চেয়ে এই এরিয়াগুলোতে অয়েল বেশি প্রোডিউস হয়।
ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও অন্যান্য ক্ষতিকর জীবাণু থেকে স্কিনকে সুরক্ষিত রাখার জন্য একটি প্রোটেক্টিভ ব্যারিয়ার তৈরি করে সেবাম। সেবামের এই উপকারিতা ততক্ষণ পর্যন্তই যতক্ষণ এটি নরমালি প্রোডিউস হয়। কিন্তু যখনই স্কিনে এক্সেস সেবাম প্রোডাকশন হয় তখনই স্কিন হয়ে ওঠে অয়েলি, দেখা দেয় ক্লগড পোরস, একনে ব্রেকআউটের মতো সমস্যা।
অতিরিক্ত সেবাম প্রোডিউস কেন হয়?
অয়েলি স্কিনে অতিরিক্ত সেবাম প্রোডিউস হওয়ার কিছু কারণ রয়েছে। যেমন-
১) জেনেটিক্সঃ সেবাসিয়াস গ্ল্যান্ডের অ্যাকটিভিটি কেমন হবে সেটার অনেকটাই নির্ভর করে জেনেটিক্সের উপর। যদি পরিবারের কারও অয়েলি স্কিন হয়ে থাকে, তবে স্কিনে এক্সেস সেবাম প্রোডাকশন হতে পারে।
২) হরমোনাল ফ্যাক্টরঃ সেবাম প্রোডাকশনকে ট্রিগার করে হরমোনাল ইমব্যালেন্স। আরও অয়েল প্রোডিউস করার জন্য সেবাসিয়াস গ্ল্যান্ডকে স্টিমুলেট করে অ্যান্ড্রোজেন নামক হরমোন। পিউবার্টি, মেন্সট্রুয়েশন, প্রেগনেন্সি অথবা মেনোপজের সময় হরমোনাল চেঞ্জ বেশি হয়। আর এ সময়গুলোতে স্কিন বেশ অয়েলি হয়ে যায়। স্ট্রেসের কারণেও হরমোন লেভেল ইনফ্লুয়েন্সড হয়ে স্কিন অয়েলি হয়।
৩) এনভায়রনমেন্টাল ফ্যাক্টরঃ সেবাম প্রোডাকশনের জন্য দায়ী হতে পারে এই কন্ডিশনও। গরম ও আর্দ্র আবহাওয়া অয়েলিনেস বাড়ানোর জন্য সেবাসিয়াস গ্ল্যান্ডকে স্টিমুলেট করতে পারে। অন্যদিকে, শুষ্ক আবহাওয়া প্রোটেক্টিভ মেকানিজম হিসেবে স্কিনে আরও অয়েল প্রোডিউস করায়।
৪) ভুল প্রোডাক্ট বাছাইঃ অনেকেই ত্বকের ধরন না বুঝে প্রোডাক্ট বেছে নেন। প্রোডাক্ট যদি স্কিনের জন্য বেশি হেভি হয়ে যায় তাহলে সেবাম প্রোডিউস বেশি হতে পারে। এছাড়া অয়েল বেইজড ও কমেডোজেনিক প্রোডাক্ট ব্যবহারের কারণেও পোরস ক্লগড হয়ে যায় এবং স্কিন অয়েলি হতে থাকে। সেই সাথে স্কিন বারবার ওয়াশ করলেও ন্যাচারাল সেবাম ধুয়ে যায়। তখন সেবাসিয়াস গ্ল্যান্ড আরও অয়েল প্রোডিউস করতে থাকে।
৫) আনহেলদি ফুডঃ হাই গ্লাইসেমিক ডায়েট অর্থাৎ যে ডায়েটে সুগারি ও রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট যুক্ত খাবার বেশি থাকে, সেই ডায়েট ফলো করলে স্কিনে এক্সেস সেবাম প্রোডাকশন হতে পারে।
আপনার ত্বক তৈলাক্ত কিনা কীভাবে বুঝবেন?
ত্বক তৈলাক্ত কিনা সেটা বোঝার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে ঘুম থেকে ওঠার পর আয়নার দিকে তাকিয়ে ফেইসের স্কিনে হাত দিয়ে ফিল করা। যদি ফেইসে গ্রিজিনেস ফিল হয় তাহলে বুঝতে হবে স্কিন টাইপ অয়েলি। এছাড়া-
- ফেইস ওয়াশ করার কিছুক্ষণ পরই আবার অয়েলি হয়ে যাওয়া
- এনলার্জ পোরস বোঝা যাওয়া
- গ্রিজিনেস
- ব্রণ ওঠার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি অয়েলি স্কিনের বৈশিষ্ট্য
স্কিনের এক্সেস সেবাম প্রোডাকশন কন্ট্রোলের উপায়
১) ক্লেনজিং
ত্বকের ধরন যেমনই হোক না কেন, হেলদি স্কিন পাওয়ার জন্য নিয়মিত ক্লেনজিং করা জরুরি। অয়েলি স্কিনের জন্য এমন ক্লেনজার চুজ করতে হবে যেটি অয়েল কন্ট্রোল করবে, একনে প্রিভেন্ট করবে এবং পোরস ডিপলি ক্লিন করবে। এই ধরনের ত্বকের যত্নে স্কিন কেয়ার রুটিনে একটি স্যালিসাইলিক অ্যাসিডযুক্ত এবং মাইল্ড ফেইস ওয়াশ ইনক্লুড করুন। অয়েলি স্কিনের এক্সেস অয়েলিনেস, একনে, বাম্পস বা র্যাশ প্রিভেন্ট করার জন্য সপ্তাহে ৩/৪ বার স্যালিসাইলিক অ্যাসিডযুক্ত ক্লেনজার ব্যবহার করুন। কারণ অতিরিক্ত অ্যাকটিভ ইনগ্রেডিয়েন্ট যুক্ত ক্লেনজার ব্যবহার করলে স্কিনের আপার লেয়ারের লিপিড স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। মাইল্ড ফেইস ওয়াশ রেগুলার ব্যবহার করতে পারেন।
এছাড়া এ ধরনের স্কিনের জন্য মাইসেলার ওয়াটারও খুব ভালো অপশন। এতে আছে পিওরিফাইড ওয়াটার ও মাইল্ড সারফেকট্যান্ট। অয়েল বেইজড ক্লেনজার যদি ব্যবহার করতে না চান, তাহলে এটি চুজ করতে পারেন। ডাবল ক্লেনজিং এর ফার্স্ট স্টেপে এটি ব্যবহার করতে হয়।
২) টোনিং
অয়েলি স্কিনের জন্য এমন টোনার চুজ করতে হবে যেটা এক্সেস সেবাম প্রোডাকশন কন্ট্রোল করে এবং স্কিন ম্যাটিফাই করে। অ্যালকোহল যুক্ত টোনার অ্যাভয়েড করতে হবে, কেননা এটি সেবাম প্রোডাকশন বাড়িয়ে দিতে পারে। অয়েল কন্ট্রোলিং ইনগ্রেডিয়েন্ট যেমন- স্যালিসাইলিক অ্যাসিড, টি ট্রি অয়েল, নিয়াসিনামাইড ও গ্লাইকোলিক অ্যাসিড আছে এমন টোনার চুজ করতে হবে। এই ইনগ্রেডিয়েন্টগুলো অয়েলিনেস কমাবে, পোরস মিনিমাইজ করবে এবং একনে ব্রেকআউট প্রিভেন্ট করবে। অয়েলি স্কিনে সেনসিটিভিটি ও ইনফ্ল্যামেশনের প্রবলেম হতে পারে। তাই মেন্থল, ফ্রেগ্রেন্স, এক্সেসিভ অ্যামাউন্টে সাইট্রাস এক্সট্র্যাক্ট আছে এমন টোনার চুজ করা যাবে না। এতে স্কিনে ইরিটেশন ফিল হতে পারে।
৩) সিরাম
গ্লোয়ি ও হেলদি স্কিন পাওয়ার জন্য স্কিন কেয়ার রুটিনে অ্যাড করতে হবে সিরাম। অয়েলি স্কিনের জন্য সিরাম চুজ করার আগে জেনে নিন এতে কোন অ্যাকটিভ ইনগ্রেডিয়েন্টগুলো থাকা উচিত-
স্যালিসাইলিক অ্যাসিড- ডেড সেলস দূর করে। একনে ব্রেকআউট, ব্ল্যাকহেডস, এক্সেস অয়েলিনেস প্রিভেন্ট করে।
হায়ালুরোনিক অ্যাসিড- হাইড্রেশন ধরে রেখে স্কিনকে রাখে সফট। সেবাম প্রোডাকশন কমিয়ে আনতে হেল্প করে।
নিয়াসিনামাইড- ভিটামিন বি৩ এর একটি ফর্ম এই নিয়াসিনামাইড। এটি স্কিনের ময়েশ্চার রিটেইন করে এক্সেস সিবাম প্রোডাকশন কন্ট্রোল করতে হেল্প করে।
৪) ময়েশ্চারাইজিং
অনেকের ধারণা অয়েলি স্কিনে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। অথচ এই ধারণাটি মোটেও সঠিক নয়। স্কিন অয়েলি হলেও অনেক সময় ডিহাইড্রেটেড হয়ে যায়। তাই ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখার জন্য ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা জরুরি। এমন ত্বকের জন্য বেছে নিতে হবে ওয়াটার বেইজড প্রোডাক্ট। লাইট ওয়েট হবে এবং হেভি ফিল দিবে না, সেই সাথে স্কিনে ডিপলি নারিশমেন্ট প্রোভাইড করবে এমন ময়েশ্চারাইজার অয়েলি স্কিনের জন্য বেস্ট অপশন।
৫) এক্সফোলিয়েশন
সপ্তাহে ১/২ বার স্কিন কেয়ার রুটিনে এক্সফোলিয়েশন অ্যাড করুন। এতে ডেড স্কিন সেলস রিমুভ হবে এবং ক্লগড পোরস আনক্লগ হবে। স্যালিসাইলিক অ্যাসিড ও গ্লাইকোলিক অ্যাসিড যুক্ত কেমিক্যাল এক্সফোলিয়েন্ট চুজ করুন।
৬) অয়েল ফ্রি মেকআপ
অয়েলি স্কিনের এক্সেস অয়েল প্রোডাকশন কন্ট্রোল করতে এবং ক্লগড পোরস ও একনে ব্রেকআউটের প্রবলেম কমাতে অয়েল ফ্রি মেকআপ ব্যবহার করতে হবে। কারণ এগুলো লাইট টেক্সচারের হয় এবং স্কিনে অ্যাডিশনাল অয়েল অ্যাড করে না। এগুলোতে এক্সেস অয়েল অ্যাবজর্ব করার ইনগ্রেডিয়েন্ট থাকে এবং ম্যাট ফিনিশ দেয়। এই প্রোডাক্টগুলো স্কিনে বাতাস প্রবেশ করতে দেয় এবং কমেডোনস হওয়ার চান্স কমায়।
৭) সানস্ক্রিন
সান এক্সপোজার সেবাম প্রোডাকশনকে ট্রিগার করতে পারে, যার কারণে স্কিন আরও অয়েলি হয়ে ব্রেকআউটের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। সানস্ক্রিন ব্যবহারে সেবাম প্রোডাকশন অনেকটাই মিনিমাইজ করা যায়। কিছু সানস্ক্রিনে অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটরি প্রোপারটিজ আছে, যা স্কিনে সুদিং ফিল দেয়, রেডনেস এবং একনে ইরিটেশন কমায়। এছাড়া সূর্যরশ্মির কারণে হওয়া হাইপারপিগমেন্টেশন ও ডার্ক স্পটসও অয়েলি স্কিনের জন্য অনেক বড় একটি কনসার্ন। রেগুলার সানস্ক্রিন ব্যবহারে এই সমস্যাও অনেকখানি কমে আসে। অয়েলি স্কিনের জন্য সানস্ক্রিন চুজ করার ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে সেটি যেন নন-কমেডোজেনিক হয়। প্রোপার প্রোটেকশন পাওয়ার জন্য অন্তত SPF 30 যুক্ত সানস্ক্রিন চুজ করতে হবে। দিনের বেলা ঘরে বা বাইরে যেখানেই থাকুন না কেন অবশ্যই ২/৩ ঘন্টা পরপর সানস্ক্রিন রি অ্যাপ্লাই করতে হবে।
৮) হেলদি লাইফস্টাইল
একটি ব্যালেন্সড ডায়েট স্কিনে বেশ পজিটিভ ইমপ্যাক্ট ফেলতে পারে। মিষ্টি জাতীয় খাবার, ফাস্ট ফুড যতটা সম্ভব কম খেতে হবে। ডায়েটে অ্যাড করতে হবে ফলমূল, শাক সবজি, প্রোটিন। স্কিন হাইড্রেটেড রাখতে এবং অয়েল প্রোডাকশন রেগুলেট করতে পান করতে হবে পর্যাপ্ত পানি। স্ট্রেসের কারণে হরমোনাল ইমব্যালেন্স হয়, আর এ থেকে স্কিনে এক্সেস সেবাম প্রোডাকশন হতে পারে। এক্সারসাইজ, মেডিটেশন, ডিপ ব্রিথিং এর মতো স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট টেকনিক প্র্যাকটিস করে কমাতে হবে স্ট্রেস। রেগুলার এক্সারসাইজ করলে ব্লাড সার্কুলেশন বাড়ে, যার কারণে স্কিন হয়ে ওঠে হেলদি। ব্যায়াম করার সময় আমাদের শরীরে যে ঘাম হয় সেটি কিন্তু পোরস আনক্লগ করতে হেল্প করে। তবে হ্যাঁ, ঘাম হলে অবশ্যই ফেইস ও বডি ভালোভাবে ক্লিন করতে হবে।
স্কিনের এক্সেস সেবাম প্রোডাকশন কেন হয় এবং কীভাবে এটি কন্ট্রোল করা যায় সে সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য জানিয়ে দিলাম। প্রোপার স্কিন কেয়ার রুটিন ফলো করার পরও যদি স্কিন ইস্যু দেখা যায়, তবে ডার্মাটোলজিস্ট এর পরামর্শ নেয়া উচিত। অথেনটিক স্কিন কেয়ার, হেয়ার কেয়ার ও মেকআপ প্রোডাক্ট কিনতে পারেন সাজগোজ থেকে। সাজগোজের কয়েকটি ফিজিক্যাল শপ রয়েছে। শপগুলো যমুনা ফিউচার পার্ক, সীমান্ত সম্ভার, বেইলি রোডের ক্যাপিটাল সিরাজ সেন্টার, ইস্টার্ন মল্লিকা, ওয়ারীর র্যাংকিন স্ট্রিট, বসুন্ধরা সিটি, উত্তরার পদ্মনগর (জমজম টাওয়ারের বিপরীতে), মিরপুরের কিংশুক টাওয়ার এবং চট্টগ্রামের খুলশি টাউন সেন্টার এ অবস্থিত। এই শপগুলোতে ঘুরে নিজের পছন্দমতো অথবা অনলাইনে শপ.সাজগোজ.কম থেকে কিনতে পারেন আপনার দরকারি প্রোডাক্টগুলো।
ছবিঃ সাজগোজ