মেনোপজ পরবর্তী মানসিক সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় কী?

মেনোপজ পরবর্তী মানসিক সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় কী?

menopause2

জন্মের পর থেকেই একজন নারী তার জীবনের অনেকগুলো ধাপ পার করে থাকে৷ শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য ও একসময় এসে পৌঁছায় মধ্যে বয়সে। প্রতিটা ধাপে তাকে নানা রকম পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। যেমন নারীর জীবনে বয়ঃসন্ধি, সাথে আসে মাসিক চক্রের মত শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া, আবার জীবনের এক পর্যায়ে সে গর্ভধারণ করে। ঠিক তেমনভাবেই মধ্যে বয়সে এসে প্রতিটি নারীকে আরেকটি পরিবর্তনের মুখোমুখি হতে হয়, যাকে বলা হয় ‘মেনোপজ’। মেনোপজ পরবর্তী মানসিক সমস্যা নিয়েই আজকের ফিচার।

মেনোপজ কী?

সোজা ভাষায় যদি বলা হয়, বয়ঃসন্ধিকালে নারীর যে মাসিক চক্র শুরু হয় তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়াকে মেনোপজ বলে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে নারীদের শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের মাত্রা কমতে থাকে, আর এই হরমোন নারীর প্রজনন ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এর পাশাপাশি ডিম্বাশয়ে এগের পরিমাণও কমে যায়। এর ফলে এক সময় মাসিক অনিয়মিত হয়ে যায় এবং এক পর্যায়ে তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, কোনো নারীর মাসিক যদি এক বছর যাবত বন্ধ থাকে তখন তাকে মেনোপজ বলে ধারণা করে নিতে হবে। বেশিরভাগ মেনোপজ ঘটে থাকে ৪৫ থেকে ৫৫ বছরের মধ্যে, তবে কোনো কারণে ৪৫ বছরের আগেও অনেকের মেনোপজ হয়ে থাকে৷ তাকে ‘প্রিম্যাচিউরড মেনোপজ’ বলা হয়ে থাকে। আবার অনেক ক্ষেত্রে ৫৫ পার হয়ে যাবার পরে নিয়মিত মাসিক হচ্ছে এমন ঘটনাও দেখা যায়৷ তবে ৪০ এর আগে মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া মানেই মেনোপজ না, মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়ার পেছনে অন্য কোনো শারীরিক জটিলতা থাকতে পারে৷ তাই মেডিকেল টেস্টের মাধ্যমে মাসিক বন্ধের কারণ জেনে নিতে হবে।

ইস্ট্রোজেন হরমোন লেভেল

এর লক্ষণ কী?

পিরিয়ড বন্ধের সাথে সাথে মেনোপজের একটি কমন লক্ষণ হচ্ছে হট ফ্ল্যাশ। হট ফ্ল্যাশের ফলে শরীরে হঠাৎ করে গরম লাগে, রাতে প্রচুর ঘাম হয় এমনকি এসির মধ্যেও৷ অনেকের ঠিকমতো ঘুম হয় না, রাতে বার বার ঘুম ভেঙে যায়। হুটহাট মুড সুইং হওয়া, চুল পড়া, ব্রণ, হাড়ক্ষয়, ভিটামিন ডি-এর অভাব, প্রাইভেট পার্টের শুষ্কতা, শরীরে জ্বালাপোড়া করা, পেশিতে ব্যথা, দুর্বলতা এগুলোই সাধারণত দেখা যায়। এছাড়া হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপের মতো কিছু জটিলতাও মেনোপজের পর দেখা দেয় অনেকের ক্ষেত্রে।

মেনোপজ পরবর্তী মানসিক সমস্যা

কিছু শারীরিক জটিলতার পাশাপাশি মেনোপজের সময় নারীরা সবচেয়ে বেশি ভুগে থাকে মানসিক সমস্যাতে। কখনো মেনোপজ পরবর্তী মানসিক সমস্যা বেশ তীব্র আকার ধারণ করে। এই মানসিক পরিবর্তনের জন্যে সম্পূর্ণরূপে দায়ী হরমোনের ওঠানামা। মেনোপজের পর যে মানসিক সমস্যাগুলো সাধারণত দেখা দেয়, সেগুলো নিয়েই আজ জানাবো।

১) বিষণ্নতা

অনেক নারীরা মেনোপজকে সহজভাবে মেনে নিতে পারে না। ‘এই বুঝি সব শেষ’ এই ধারণা মনে পোষণ করে থাকে। ফলে তারা বিষণ্নতায় ভুগতে থাকে। তখন খাওয়াদাওয়া একদম কমে যায় কিংবা হঠাৎ করে খাওয়া বেড়ে যায়। আগে যা করতে আগ্রহ হতো সেটাও আর ভালো লাগে না। ছোট ছোট ব্যাপার ভুলে যেতে থাকে এবং দিনের বেশির ভাগ সময় মন খারাপ থাকে৷ বিষণ্নতার কারণে তারা কোনো কাজে আগের মতো মনোযোগ দিতে পারে না।

মেনোপজ পরবর্তী মানসিক সমস্যা

২) হীনম্মন্যতা

মেনোপজের পরে শারীরিক কিছু পরিবর্তন আসে; যেমন ওজন বেড়ে যাওয়া, একনে, চুল পড়া ইত্যাদি। সাধারণত ডিম্বাশয় থেকে নিঃসৃত হরমোন ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন আমাদের ত্বক, চুল, সেক্সুয়াল নীড ইত্যাদির উপর প্রভাব ফেলে, কিন্তু যখন প্রাকৃতিকভাবে এর প্রোডাকশন কমে যায় তখন বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা দেয়, এই ঘটনাটি একদমই স্বাভাবিক। এই পরিবর্তন সবার পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। তখন অনেকে কিন্তু হীনম্মন্যতায় ভুগে থাকে। কোনো কারণ ছাড়াই নিজেকে সব বিষয়ে দোষারোপ করতে থাকার প্রবণতা তৈরি হয় এবং অন্য নারীদের সাথে নিজের তুলনা করতে থাকে৷

৩) আবেগ ও মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা

এই সময়ে অনেক নারীরাই মেজাজ ধরে রাখতে পারে না, এর পেছনেও রয়েছে ইস্ট্রোজেন হরমোনের ভূমিকা। এই হরমোন কমে যাওয়া ফলে ও আয়রনের ডেফিসিয়েন্সি থেকে মুড সুইং হতে পারে। অনেক সময় আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে তারা কান্নাকাটি করে এবং ইনসিকিউরিটিতে ভোগে।

৪) ইনসমনিয়া

অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা ও বিষণ্নতার জন্য ইনসমনিয়া হতে পারে। রাতে ঘুম আসে না, এর ফলে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায় ও কাজে অনীহা সৃষ্টি হয়৷ ইনসমনিয়ার জন্য অনেকে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ঘুমের ওষুধ কিনে খেয়ে থাকেন যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

ইনসমনিয়া বা ঘুমের সমস্যা

৫) উদ্বেগ বা অস্থিরতা

মেনোপজের পর হঠাৎ করেই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অহেতুক অস্থিরতা ও দুশ্চিন্তা শুরু হতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে উদ্বেগের ফলে শ্বাসকষ্ট ও শরীর দিয়ে ঘাম বের হতে থাকে।

মেনোপজ মানে সব শেষ না!

কিছুক্ষণের জন্য যদি নিজের বয়ঃসন্ধিকালে আমরা ফিরে যাই তবে দেখবো যখন প্রথম আমাদের মাসিক ও শারীরিক পরিবর্তন শুরু হয়েছিলো, তখনও আমরা প্রথম দিকে মেনে নিতে পারতাম না। কিন্তু ধীরে ধীরে এই পরিবর্তনের সাথে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম, বুঝতে শিখেছিলাম যে এটাই স্বাভাবিক নিয়ম! মেনোপজও ঠিক তেমনই এক পরিবর্তন, তাই একে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমি শুধু একা না, এই পৃথিবীর সকল নারীকেই এর মধ্যে দিয়ে যেতে হবে বা হয়েছে৷ মেনোপজের পর শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য আমাদের কিছু নিয়ম মানতে হবে। চলুন সেগুলো জেনে নেই এখন।

নিজেকে ভালোবাসুন

মেনোপজ হলে শারীরিক পরিবর্তনের জন্য অনেকেই নিজেকে গ্রহণ করতে পারে না। কিন্তু সবার আগে নিজেকে ভালোবাসতে হবে। মনে রাখতে হবে প্রতিটি বয়সেরই আলাদা সৌন্দর্য রয়েছে। তাই আবার নতুন আমিকে গ্রহণ করে নিতে হবে এবং নিজেকে সময় দিতে হবে। কোনো কিছু ভালো না লাগলে নিজেকে জোর করা যাবে না বা দোষারোপ করা যাবে না। নিজেকে অন্যের সাথে তুলনা করা যাবে না, প্রতিটি মানুষ তার নিজ জায়গা থেকে সেরা।

নিজেকে ভালোবাসুন

নতুন কিছু শিখুন

এই সময়ে এসে আবারও নতুন কিছু করা বা শেখা যেতে পারে যেমন বাগান করা, সেলাই শেখা, ভিন্নধর্মী রান্না করা, বই পড়া, গান ও কবিতা শোনা ইত্যাদি৷ নতুন কিছু আয়ত্ত করতে পারলে আবারও পুরোনো আত্মবিশ্বাস ফিরে আসবে।

মন খুলে কথা বলুন

নিজের মনের ভালো লাগা কিংবা খারাপ লাগা বিশ্বস্ত কারো কাছে খুলে বলুন। কথা চেপে রাখলে সমস্যা আরো তীব্র আকার ধারণ করতে পারে৷

হেলদি লাইফস্টাইল মেনটেইন করুন

সুস্থ থাকার জন্য ডায়েট ও ব্যায়ামের বিকল্প নেই। আর মেনোপজের পর অনেকের ওজন বেড়ে যায়, তাই নিয়মিত সুষম খাবার খেতে হবে এবং হালকা ব্যায়াম করতে হবে। ব্যায়াম করতে না চাইলে প্রতিদিন ৪০/৪৫ মিনিট হাঁটতে হবে। ক্যাফেইন ও সুগার আছে এমন খাবার যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে৷ এই জাতীয় খাবার বিষণ্নতাকে আরো ট্রিগার করে। প্রতিদিন সকালে কিছু সময় রোদে কাটাতে চেষ্টা করুন, এতে ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি দূর হবে।

হেলদি লাইফস্টাইল

পরিবারের ভূমিকা

এই সময়টাতে পরিবারকে সবচেয়ে বেশি পাশে থাকতে হবে৷ তার মনের কথা শুনতে হবে এবং তাকে বোঝাতে হবে এখনো সে আগের মতোই আছে৷ পরিবারের সহযোগিতা পেলে একজন নারীর পথ চলা অনেক সহজ হয়ে যায়৷

চিকিৎসকের পরামর্শ

দিন দিন যদি মানসিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। কাউন্সেলিং, কিছু ওষুধ ও বিহেভিয়ার থেরাপির মাধ্যমে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠা সম্ভব।

মেনোপজ কোনো অসুখ বা রোগ না। মেনোপজ নারীদের জন্য একটি ন্যাচারাল ও কমন ব্যাপার। প্রত্যেকটি নারীকেই এর মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, হয়েছে, হবে। মেনোপজ পরবর্তী মানসিক সমস্যা নিয়ে বসে না থেকে মন খুলে কথা বলুন। এই সময়ে নিজেকে একা না ভেবে বরং নিজেকে ভালোবাসুন, নিজেকে সময় দিন, নিজের যত্ন নিন।

SHOP AT SHAJGOJ

     

    ছবি- সাটারস্টক

    7 I like it
    0 I don't like it
    পরবর্তী পোস্ট লোড করা হচ্ছে...

    escort bayan adapazarı Eskişehir bayan escort