‘হরমোন’ খুব পরিচিত একটি শব্দ, তাই না? কিন্তু আমরা কতটুকু জানি এই হরমোন সম্পর্কে? আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এর প্রভাব কতটুকু, সেটা জানতে গেলে অনেক কথা-ই বলতে হবে। তবে কিছু কথাবার্তা আমরা প্রায়ই বলি। যেমন কারো ফেইসে ব্রণ দেখা দিলে বা মুড সুইং হলে সাথে সাথে বলে ফেলি, ‘মনে হয় হরমোনাল সমস্যা!’ আমাদের জীবনে এর প্রভাব অনেক বেশি। মন ভালো রাখতে ‘হ্যাপি হরমোন’ এর কথা শুনেছেন কখনো? আমাদের ভালো থাকা, খারাপ থাকা এসব কিছুতেই হরমোন প্রভাব ফেলে। কিন্তু কীভাবে এই হরমোনগুলো কাজ করে, সেটা কি আমরা জানি? চলুন জেনে নেই আজ।
হরমোন কী?
হরমোন হচ্ছে শরীরের বিভিন্ন গ্রন্থি বা গ্ল্যান্ড থেকে প্রোডিউস হওয়া কেমিক্যাল মেসেঞ্জার যেটা ব্লাডের মাধ্যমে পুরো শরীরে বিস্তৃত হয়ে নির্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন করে। মানব শরীরে বিভিন্ন ধরনের হরমোন রিলিজ হয় এবং প্রত্যেকটির কাজ ভিন্ন ভিন্ন। হ্যাপি হরমোন কোনগুলো, সেটা জেনে নিন তাহলে।
কোনগুলোকে হ্যাপি হরমোন বলা হয়?
মাঝেমধ্যে আমরা বলি ‘ভালো থাকা তো নিজের কাছে’। বিশেষ কিছু হরমোন নিঃসরণের কারণে এই ফিলিংস আমরা পাই। আর তখনই আমরা বলি যে আজকে আমি বেশ ভালো আছি বা আজকের দিনটা আমার জন্য বেস্ট ছিলো। হ্যাপি হরমোন আমাদের শরীরে পজিটিভ এনার্জি নিয়ে আসে এবং মুড ভালো করতে সাহায্য করে। এরকম হরমোন আছে মূলত চারটি। ডোপামিন, সেরাটোনিন, অক্সিটোসিন ও এন্ডারফিন। এই হরমোনগুলোই মন ভালো থাকার মূল কারণ। এগুলো হ্যাপি হরমোন বা ফিল গুড হরমোন নামে পরিচিত।
আজকে জানবো এই হ্যাপি হরমোনগুলো নিয়ে এবং কোন কারণে আমাদের শরীরে এই হরমোন নিঃসরণ হয় বা শরীরে এই হরমোন নিঃসরণ বাড়াতে কী কী করা যেতে পারে।
ডোপামিন
আমাদের ব্রেইনের হাইপোথ্যালামাস থেকে নিঃসৃত হয় এই হরমোনটি। এটি মূলত রিওয়ার্ডিং কেমিক্যাল হিসেবে শরীরে কাজ করে৷ কোনো কাজ শেষে আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি এবং মনে এক ধরনের আনন্দ কাজ করে। অর্থাৎ কোনো কাজ কমপ্লিট করতে পারার যে আনন্দ প্রকাশ করি তা এই হরমোনের মাধ্যমে আসে। যখন ডোপামিন সঠিক পরিমাণে ক্ষরণ হয়, আমরা তখন বেশ হ্যাপি, ফোকাসড ও মোটিভেটেড ফিল করি। যখন ডোপামিন স্বাভাবিকের তুলনায় কম ক্ষরণ হয়, আমরা তখন বেশ ক্লান্ত অনুভব করি এবং নিজেদেরকে দুঃখী মনে করি।
সেরোটোনিন
এটি মুড স্ট্যাবল করতে বেশ ভূমিকা রাখে। প্রতিদিন সকালে কিছুটা সময় রোদ লাগানো, মেডিটেশন, এক্সারসাইজ ও প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘুরতে যাওয়া সেরোটোনিনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। আবার লাইফে যখন কোনো গোল সেট করে সেটা অর্জন করা হয়, তখনও সেরাটোনিন নিঃসৃত হয়। তাছাড়া ৯০% সেরাটোনিন আমাদের খাদ্যনালীতে প্রোডিউস হয়ে থাকে। এজন্যই অনেকসময় বলা হয় ক্ষুধা পেটে মেজাজ খিটখিটে থাকে। তাই হেলদি খাবার খাওয়া অনেক জরুরি, পাশাপাশি প্রতিদিন সকালে ৩০ মিনিট হাঁটাও শরীরের জন্য ভালো।
অক্সিটোসিন
এই হরমোনটি ‘লাভ’ হরমোন নামে পরিচিত। আমাদের মনের ভেতরে যেকোনো একটি সম্পর্কের প্রতি বিশ্বাস, ভালোবাসা, ভরসা বজায় রাখতে এই হরমোনটি কাজ করে। আপনার প্রিয় মানুষটার সাথে ভালো সময় কাটানোর পেছনেও আছে এই হরমোনের কারসাজি। কিংবা আপনার প্রিয় পোষা প্রাণীর সাথের সময় কাটানো, কারোর উপকার করতে পারার আনন্দ, পরিবার ও বন্ধুদের সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করা, বাচ্চাদের সাথে আনন্দঘন মুহূর্ত উপভোগ করা- এগুলোতে সেরাটোনিন বেশি নিঃসৃত হয়।
এন্ডোরফিন
এটি বডির ন্যাচারাল পেইন কিলার। এটি এক ধরনের Opioid Peptide যেটা হাইপোথ্যালামাস ও পিটুইটারি গ্ল্যান্ড থেকে নিঃসৃত হয়। পেইনের সাথে সাথে স্ট্রেস কমাতেও সাহায্য করে। যখন আমরা শারীরিক বা মানসিকভাবে আহত হই, তখন এন্ডোরফিন সক্রিয় হয়। হাসলে এন্ডোরফিন নিঃসৃত হয়। জানেন কি, আমরা যখন চকলেট খাই তখনও এর নিঃসরণ বেড়ে যায়। তাই প্রতিদিনের ডায়েটে অল্প পরিমাণ ডার্ক চকলেট রাখুন। ডাক্তাররা প্রায়ই পরামর্শ দিয়ে থাকেন যে হাসিখুশি থাকুন, শরীর ভালো থাকবে। হাসলে আয়ু বাড়ে। তাই মন খুলে হাসুন।
মন ভালো রাখতে ‘হ্যাপি হরমোন’ বাড়ানোর কিছু টিপস
দিনের শুরুতে প্রকৃতির সাথে সময় কাটানো
প্রতিদিনের সকালটা শুরু করুন প্রকৃতির সাথে। সকালের মিষ্টি রোদ গায়ে লাগান। একটু হাঁটাহাটি বা ইয়োগা করে শরীরকে রাখুন ফিট। ঘরের বারান্দায় শখের বাগানে একটু পানি দেওয়া বা কিছুক্ষণ বসা এগুলো মনকে ফ্রেশ রাখে আর শরীরে হ্যাপি হরমোনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।
ডায়েটে স্বাস্থ্যকর খাবার রাখা
আগেই বলেছি, হ্যাপি হরমোন সেরাটোনিন হেলদি গাট মেনটেইনে সাহায্য করে। ভিটামিনস, ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার, লিফি ভেজিটেবলস, প্রোবায়োটিকস এসব ডায়েটে রাখার ট্রাই করুন। তাছাড়া গ্রিন টি শরীরে ডোপামিনের পরিমাণ বাড়াতে সাহায্য করে।
প্রিয়জনের সাথে সময় কাটানো
এখনকার সময়ে সবাই এতোটাই ব্যস্ত যে চলার পথে পরিচিত মানুষটার সাথে দেখা হলে দাঁড়িয়ে দু’টো কথা বলার সময় পর্যন্ত হাতে থাকে না। কেমন যেন যান্ত্রিক জীবন! সাপ্তাহিক ছুটি কাটাতে পারেন আপনার প্রিয় মানুষগুলোর সাথে। তাদের জন্য পছন্দের কোনো আইটেম বানানো, বাইরে ঘুরতে যাওয়া বা কথা বলা এগুলা কিন্তু আপনার মনের অজান্তেই হ্যাপি হরমোন সিক্রেশনের কারণ হয়। খেয়াল করে দেখুন, কোনো সমস্যায় পড়লে যখন সেটা কাছের মানুষের সাথে শেয়ার করেন, তখন আপনি রিলিফ ফিল করেন।
অ্যাসেনশিয়াল অয়েল থেরাপি
শরীরের অলফ্যাক্টরি সিস্টেম যেটা ঘ্রাণের জন্য দায়ী, এটি অনেক ক্ষেত্রে ব্রেইনকে ট্রিগার করে সেরাটোনিন ও ডোপামিন রিলিজ করার জন্য। এজন্য ঘরে রাখুন অ্যাসেনশিয়াল অয়েল; যেমন ল্যাভেন্ডার, লেমনগ্রাস, রোজমেরি ইত্যাদি। স্ট্রেস, দুশ্চিন্তা, ডিপ্রেশন এগুলো দূর করতে অ্যারোমাথেরাপি বেশ কার্যকর।
মনখুলে হাসা
এটি সবচেয়ে ইম্পরট্যান্ট। কাজের চাপে, ব্যস্ততায় আমরা এখন হাসতে ভুলে গেছি। দিনের শুরুটা হয় প্রতিদিনের রাস্তার জ্যাম ঠেলে অফিসে যাওয়া আর শেষ হয় ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাসায় ফেরা। তবু এর মাঝে ভালো থাকার চেষ্টা করুন। বাসায় ফিরে বাচ্চাদের সাথে সময় কাটানো, বাগান করা, মুভি দেখা বা ক্যামেরাবন্দী থাকা অতীতের সুন্দর মুহূর্তগুলো স্মৃতিচারণ করা- এই তো এভাবেই সময় কাটিয়ে দিন। মন খুলে হাসুন, প্রাণবন্ত হয়ে বাঁচুন।
নিজের লক্ষ্য অর্জন করা
নোটবুকে নিজের লক্ষ্যগুলো সম্পর্কে নোট রাখুন। প্রতি নতুন বছরে আপনি কতটুকু এগোচ্ছেন আপনার লক্ষ্যের দিকে সেটি খেয়াল করুন। ছোট ছোট গোল সেট করুন। হতে পারে সেটা পারসোনাল বা প্রফেশনাল এই যেমন, নিজের স্বাস্থ্যের দিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখা, স্মোকিং ছাড়া, অফিসে নতুন কিছু শেখা ইত্যাদি। এতে কিন্তু ডোপামিন নিঃসরণ বৃদ্ধি পায়।
বছরে অন্তত একবার দূরে বেড়াতে যাওয়া
ছুটিতে আপনার পছন্দের জায়গায় ঘুরে আসুন, সমুদ্র কিংবা পাহাড়ের কাছাকাছি। এতে শরীর ও মন প্রফুল্ল থাকে আর হ্যাপি হরমোন রিলিজ হয়। পরিবার কিংবা কাছের বন্ধুদের নিয়ে ট্যুর প্ল্যান করে ফেলুন, যাওয়ার আগে সেই জায়গা সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নিন।
নিজেকে ভালোবাসা
অক্সিটোসিন হরমোনের কথা মনে আছে তো, যেটা লাভ হরমোন নামে পরিচিত? আপনার কাছের মানুষগুলোর সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখুন। কখনো ছোটখাটো বিষয় নিয়ে রাগারাগি করবেন না বা স্ট্রেস নিবেন না। এসব দ্বন্দ্ব, কথা কাটাকাটি হ্যাপি হরমোনের পরিবর্তে স্ট্রেস হরমোন রিলিজ করে। অতীতের খারাপ কোনো কিছু মনে না রেখে প্রতিটি দিন নতুনভাবে শুরু করুন। নিজেকে ভালোবাসুন, সুস্থ থাকুন।
তো এখন বুঝতেই পারছেন, মন ভালো রাখতে ‘হ্যাপি হরমোন’ কতটা গুরুত্বপূর্ণ। পরিশেষে বলবো, আমাদের এই ছোট্ট জীবনটা কিন্তু অনিশ্চিত। তাই এই স্বল্প সময়ে যতটা নিজে ভালো থাকা যায় এবং অন্যকে ভালো রাখা যায়- এটাই মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। এভাবে চিন্তা করলে জীবন অনেকটা সহজ হয়ে যাবে। আজ এই পর্যন্তই, ভালো থাকুন।
ছবি- সাটারস্টক