ক্যান্সার এক ঘাতক রোগের নাম। মানব দেহের অনেক রকম ক্যান্সারের মধ্যে ব্লাড ক্যান্সার অন্যতম। এটি হেমাটোলজিক্যাল ক্যান্সার নামেও পরিচিত। ব্লাড ক্যান্সারের আবার অনেক রকম প্রকারভেদ আছে, এগুলোকে লিউকেমিয়া, মাল্টিপল মায়েলোমা ও লিম্ফোমা বলা হয়ে থাকে। প্রতিটির রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, যেগুলোর মাধ্যমে এগুলোকে আলাদা করা যায়। আজকের ফিচারে থাকছে ব্লাড ক্যান্সার সম্পর্কে বিস্তারিত।
ব্লাড ক্যান্সার বা লিউকেমিয়া কী?
লিউকেমিয়া সাধারণত শ্বেত রক্তকণিকার অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে হয়ে থাকে। শ্বেত রক্তকণিকা অস্থি মজ্জায় উৎপন্ন হয় এবং এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধকারী যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত। সাধারণত শরীরের প্রয়োজন অনুযায়ী এগুলো বৃদ্ধি পায় এবং সুশৃঙ্খলভাবে বিভক্ত হয়। কিন্তু লিউকেমিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের অস্থি মজ্জা অতিরিক্ত পরিমাণে শ্বেত রক্তকণিকা তৈরি করে, যা সঠিকভাবে কাজ করে না। লিউকেমিয়া প্রায়ই ৫৫ বছরের বেশি বয়সী প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে দেখা দেয়, তবে এটি ১৫ বছরের কম বয়সী শিশুদেরও হতে পারে।
কী কী উপসর্গ দেখা যায়?
- ক্লান্তি ও দুর্বলতা – ক্রমাগত ক্লান্তি ও দুর্বলতা ব্লাড ক্যান্সারের একটি সাধারণ লক্ষণ, যা শরীরের অস্বাভাবিক রক্তকণিকা উৎপাদনের প্রভাবকে প্রকাশ করে।
- আকস্মিক ওজন হ্রাস – শরীরের স্বাভাবিক বিপাকীয় প্রক্রিয়া বজায়ের অক্ষমতার কারণে হঠাৎ করে ওজন অতিরিক্ত কমে যেতে পারে।
- ঘন ঘন ইনফেকশন- দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ব্লাড ক্যান্সারের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যার ফলে রোগী ঘন ঘন বিভিন্ন রকম ইনফেকশনে আক্রান্ত হতে পারে এবং চিকিৎসা করাও কঠিন হয়ে পড়ে।
- ক্ষত ও রক্তপাত- ব্লাড ক্যান্সার হলে রক্তকণিকা উৎপাদনে অস্বাভাবিকতার কারণে সহজে ঘা ও ছোটখাটো কাটা থেকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ দেখা দিতে পারে বা ঘন ঘন নাক দিয়ে রক্তপাত হতে পারে।
- লিম্ফ নোড ফুলে যাওয়া – লিম্ফ নোড ফুলে বা বড় হয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে ঘাড়, বগল বা কুঁচকিতে অবস্থিত লিম্ফ নোড ব্লাড ক্যান্সারের উপস্থিতি নির্দেশ করতে পারে।
- রাতে ঘাম হওয়া- পরিবেশগত কারণ ছাড়া রাতে অতিরিক্ত ঘাম রক্তের ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।
- হাড়ের ব্যথা- ব্লাড ক্যান্সার হাড়কেও প্রভাবিত করতে পারে, যার ফলে হাড়ে প্রচন্ড ব্যথা ও অস্বস্তি হতে পারে। এই ব্যথা প্রায়ই স্থায়ী হয় এবং সময়ের সাথে অবস্থা আরো খারাপ হতে পারে।
- নিঃশ্বাসের সমস্যা – অস্বাভাবিক রক্তকণিকা উৎপাদনের কারণে অক্সিজেন বহন ক্ষমতা কমে যাওয়ার ফলে শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
এছাড়াও রক্তস্বল্পতার জন্য দুর্বলতা, খাবারে অরুচি, পায়ে পানি জমা, দীর্ঘদিনের জ্বর বা ঘন ঘন জ্বর, দাঁতের গোড়া থেকে রক্তপাত, প্রস্রাব পায়খানার সাথে রক্তপাত, লিভার-প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গও দেখা দিতে পারে।
ব্লাড ক্যান্সার কেন হয়?
বিজ্ঞানীরা লিউকেমিয়ার সঠিক কারণ ব্যাখ্যা করতে পারেননি। তবে সাধারণত এটি বংশগত ও পরিবেশগত কারণগুলোর সংমিশ্রণ থেকে হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। যদিও এই মিউটেশনগুলোর সঠিক কারণ সবসময় স্পষ্ট নয়,তবে কিছু কারণ রয়েছে যা বিশেষ অবদান রাখতে পারে, যেমনঃ
- জিনগত কারণ- জেনেটিক মিউটেশন ব্লাড ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে।
- ইন্ডাস্ট্রিয়াল কেমিক্যাল এক্সপোজার- রাসায়নিক কেমিক্যাল বা পেস্টিসাইডের সংস্পর্শে বেশিদিন থাকলে তা থেকে ক্যান্সার হতে পারে।
- পূর্বের ক্যান্সার চিকিৎসা- অনেক সময় অন্যান্য ক্যান্সারের জন্য নির্দিষ্ট ধরনের কেমোথেরাপি ও রেডিয়েশন থেরাপি নেওয়া ব্যক্তিদের লিউকেমিয়া হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
কারা ঝুঁকিতে রয়েছেন?
- বয়স- ব্লাড ক্যান্সারের ঝুঁকি বয়সের সাথে বৃদ্ধি পায়।
- জেন্ডার- কিছু ব্লাড ক্যান্সার, যেমন লিম্ফোমা পুরুষদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।
- পারিবারিক ইতিহাস- পরিবারের কারো ব্লাড ক্যান্সার থেকে থাকলে বাকি সদস্যদেরও ঝুঁকি বেড়ে যায়। তবে তা সম্পূর্ণই বংশগত কারণে। অনেকে একে ছোঁয়াচে রোগ মনে করেন যা সঠিক নয়।
- ভাইরাল ইনফেকশন- নির্দিষ্ট ভাইরাসের সংক্রমণ, যেমনঃ অ্যাপস্টাইন বার ভাইরাস ব্লাড ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
- ইমিউন সিস্টেমের রোগ- যে রোগগুলো ইমিউন সিস্টেম দুর্বল করে, যেমনঃ এইডস বা অটোইমিউন ডিজঅর্ডারের ফলে ব্লাড ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
ব্লাড ক্যান্সারের চিকিৎসা
- কেমোথেরাপি- কেমোথেরাপিতে ওষুধের মাধ্যমে ক্যান্সার কোষকে হত্যা বা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এটি বিভিন্ন ধরনের রক্তের ক্যান্সারের একটি সাধারণ চিকিৎসা।
- রেডিয়েশন থেরাপি- এক্স-রে সহ তীব্র মাত্রার অন্যান্য শক্তিশালী রশ্মির বিকিরণ ব্যবহার করে রেডিয়েশন থেরাপি দেয়া হয়। এর মাধ্যমে পুরো শরীরে অথবা শরীরের নির্দিস্ট জায়গায় বিকিরণ ছুড়ে দেওয়া হয়, যার ফলে নির্দিস্ট ক্যান্সার সেলের মৃত্যু ঘটে। অস্থি মজ্জা প্রতিস্থাপনের জন্য রেডিয়েশন থেরাপি ব্যবহার করা যেতে পারে।
- টার্গেট থেরাপি- দেহে ক্যান্সার কোষের উপস্থিতি নির্দিস্ট করে বিভিন্ন ড্রাগ ব্যবহার করা হয়। এগুলো কোষের অস্বাভাবিকতাকে চিহ্নিত করে তার বৃদ্ধি বন্ধ করে দেয়।
- ইমিউনোথেরাপি- এই পদ্ধতিটিতে ক্যান্সার কোষগুলিকে চিনতে এবং ধ্বংস করতে শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা হয়।
- স্টেম সেল প্রতিস্থাপন- কিছু ক্ষেত্রে অস্থি মজ্জায় ক্ষতিগ্রস্ত বা রোগাক্রান্ত কোষ প্রতিস্থাপন করার জন্য স্টেম সেল প্রতিস্থাপন বা বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা যেতে পারে।
আশা করি ব্লাড ক্যান্সার নিয়ে আপনাদের সব দ্বিধা দূর করতে পেরেছি। ক্যান্সার শুনলেই মনে আতঙ্ক জাগলেও সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় করে যথাযথ চিকিৎসা নিলে অনেক ক্যান্সারই ভালো হয় এবং নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পর্যায় বুঝে কেমোথেরাপি বা শুধু ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করলেও সম্পুর্ণ সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই ব্লাড ক্যান্সারের উপসর্গ দেখা দিলে দেরি না করে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
ছবিঃ সাটারস্টক