সন্তানের জন্যে মায়ের দুধের কোনো বিকল্প নেই। আমরা সবাই কম বেশি জানি মায়ের দুধের উপকারিতা। কিন্তু আসলে নবজাতক ও মায়ের জন্য এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিং কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা কি জানি? সন্তান জন্মের আগে থেকেই মায়ের স্তনে দুধ জমতে থাকে এবং শিশু জন্মদানের পর কলোস্ট্রাম বা শালদুধ নিঃসৃত হয় যা বাচ্চার জন্য প্রথম টিকা স্বরূপ। চলুন বিস্তারিত জানা যাক শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা: তাজরিনা রহমান জেনি এর কাছ থেকে।
শালদুধ কী?
জন্মদানের পর মায়ের হলুদ, আঠালো যে দুধ নিঃসৃত হয় তাই শালদুধ। শালদুধ এর উপকারিতা এক নজরে দেখে নেওয়া যাক।
১) এটি বাচ্চার প্রথম খাবার যা প্রোটিন ও ভিটামিন সমৃদ্ধ।
২) সঠিক সময়ের আগেই জন্ম হওয়া শিশুদের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় একটি খাবার যাতে প্রচুর পরিমাণে ক্যালোরি আছে।
৩)এটি বাচ্চার স্টুল পাস হতে সাহায্য করে।
৪) এতে প্রচুর ইমিউনো গ্লোবিউলিন আছে ( Ig A বেশি ) যা শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
শালদুধের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে তাই কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। সন্তান জন্ম নেওয়ার সাথে সাথেই মায়ের কাছে দিয়ে দিতে হবে যাতে মা তাকে দুধ খাওয়াতে পারে। অনেকে ভুল করে বা জেনেশুনে বাচ্চার মুখে মধু বা পানি দেয় যা একেবারেই উচিত নয়।
নবজাতক ও মায়ের জন্য এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিং
জন্মের প্রথম ছয় মাসে মায়ের দুধ ছাড়া এক ফোঁটা পানিও দেওয়া যাবে না। একে বলে এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিং। যদি দেখেন বাচ্চা ঠিকমতো দুধ পাচ্ছে না, তবে বিকল্প উপায়ে হলেও মায়ের বুকের দুধ প্রেস করে খাওয়াতে হবে।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে এতে কি দুধের পুষ্টিগুণ নষ্ট হবে?
না। পরিষ্কার হাত বা পাম্পের মাধ্যমে (ইলেকট্রিক বা উপরোক্ত জিনিসগুলো পাম্পের মতো ব্যবহার করে) কাজটি করলে বাচ্চার কোনো সমস্যা হবে না। আবার অনেক সময় অতিরিক্ত দুধ জমা হলে মায়ের স্তন ব্যথা হতে পারে। তখন বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর দরকার না হলে পরিষ্কার কাপড় গরম পানিতে চিপে নিয়ে স্তনে দিয়ে ম্যাসেজ করে দুধ চিপে ফেলে দিতে হবে। প্রসব পরবর্তী সময়ের দুই তিন দিনের মধ্যে অনেক সময় স্তনে ব্যথা হয়। অবহেলা না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
এখন জেনে নিন মায়ের দুধের উপকারিতা
শিশুর জন্য উপকারিতা
- ইনফেকশনের হাত থেকে বাঁচায়
- সহজে হজম ও শোষিত হয়
- বাচ্চার মস্তিষ্ক গঠনে সহায়তা করে
- বাচ্চাদের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়
- মায়ের সাথে আত্মিক বন্ধন গঠন করে
- বাচ্চার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে
মায়ের জন্য উপকারিতা
১। মায়ের জরায়ু সঠিক অবস্থানে ফিরে আসার জন্য স্তন্য পান করানোর গুরুত্ব অনেক।
২। পরবর্তী গর্ভধারণ প্রলম্বিত করে, ফলে অনেকটা স্বাভাবিক জন্মবিরতিকরণ পিলের ন্যায় কাজ করে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে শতকরা ৭০ ভাগ মায়ের বাচ্চাকে দুধ পান করানো পর্যন্ত ঋতুস্রাব হয় না যদি বাচ্চা এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিং এ থাকে। কারণ প্রোল্যাক্টিন হরমোন এতে পরোক্ষভাবে বাঁধা দেয়।
৩। মায়ের স্তন ও ডিম্বাশয় ক্যান্সারে বাঁধা দেয়। এতে পরিবারের আর্থিক খরচ অনেকটাই কমে যায়। পাশাপশি পরিবার পরিকল্পনায় সাহায্য করে।
সঠিক পজিশন ও অ্যাটাচমেন্ট
মা ও সন্তানের, উভয়ের সুস্থতার জন্যেই প্রয়োজন সঠিক উপায়ে দুধ পান করানো। বাচ্চাকে সঠিক পজিশনে ধরতে হবে। বাচ্চার পুরো শরীর হাত দিয়ে তুলে ধরে দুধ খাওয়াতে হবে। বাচ্চা মায়ের বুকে লেগে থাকবে, মাথা ও শরীর সোজা থাকবে। নাক থাকবে মায়ের নিপল বরাবর। থুতনি মায়ের স্তনে ছুঁয়ে থাকবে। মুখ সম্পূর্ণ হা করে নিচের ঠোঁট বাইরের দিকে উল্টে রেখে খাওয়াতে হবে।
সন্তান জন্মের ৬ মাসের পর থেকে মায়ের দুধের পাশাপাশি অন্যান্য খাবার দিতে হবে, একে কমপ্লিমেন্টারি ফিডিং বলে। এই খাবার হতে হবে পরিষ্কার, নিরাপদ, সহজলভ্য। শক্তি বর্ধক (ভাত, রুটি, তেল, আলু ), দেহ বৃদ্ধিকারী (মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, ডাল), ফল, শাকসবজি নরম করে খেতে দিতে হবে। তৃতীয় বছর থেকে বাচ্চা পরিবারের অন্যান্যদের মতো নরমাল খাবার খেতে পারবে।
আশা করি, নতুন মায়েদের জন্য উপকারী কিছু সঠিক তথ্য দিতে পারলাম। বুঝতেই পারলেন, নবজাতক ও মায়ের জন্য এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবারো আসবো ভিন্ন কোনো টপিক নিয়ে। সবাই ভালো থাকবেন।
ছবি- সাটারস্টক, লেখা- শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা: তাজরিনা রহমান জেনি