পৃথিবীর যেকোন বাবা-মায়ের কাছে তাদের সন্তান সবচেয়ে বেশি প্রিয়। এ আদরের সন্তানকে গর্ভে ধারণ করার সময় থেকেই তাকে সবসময় রক্ষা করার চিন্তা বাবা-মা করে থাকেন। এ “রক্ষা” করার চিন্তা কখনো কখনো অবসেশনে রূপান্তরিত হতে সাহায্য করে আশেপাশের সবার কাছ থেকে পাওয়া তথ্য। যেমন দাম্পত্যজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হবার হাতুড়ে জ্ঞান আর লেবার পেইন সহ্য করার ভয়, সেই সাথে অনেক ক্ষেত্রে ডাক্তারদের বাণিজ্যিক চিন্তাভাবনা যোগ হয়ে যাওয়ার কারণে আমাদের দেশে বর্তমানে সি সেকশন বা সহজ ভাষায় সবাই যেটাকে বলে থাকে সিজার, তার পরিমাণ আশংকাজনক হারে বেড়ে গিয়েছে।
সন্তান জন্মদান একটি প্রকৃতি নির্ধারিত স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। একজন নারী কম বেশী ৪০ সপ্তাহ গর্ভধারণের পর যোনীপথে সন্তান প্রসব করেন – এটাই প্রকৃতির নিয়ম। তাই যোনীপথে সন্তান বেরিয়ে আসাকে নরমাল বা স্বাভাবিক ডেলিভারী বলা হয়। বিজ্ঞান বলছে শুধুমাত্র ১০-১৫ শতাংশ ক্ষেত্রে ডেলিভারী যোনীপথে হবে না, সেক্ষেত্রে তলপেট দিয়ে জরায়ু কেটে নবজাতককে বের করতে হবে। এই মেজর সার্জারি’টির নামই হচ্ছে সি সেকশন।
সি সেকশন একটি বিশেষ ব্যবস্থা এবং অন্যান্য অস্ত্রোপচারের মতো এরও পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া রয়েছে। যেহেতু এটি একটি গুরুতর অপারেশন, তাই অপারেশন চলাকালীন ও পরবর্তী জটিলতা হতে পারে। পূর্ণাঙ্গ বা আংশিক অজ্ঞান করে এই অপারেশন করতে হয় তাই অ্যানেসথেশিয়া সম্পর্কিত জটিলতাগুলো হতে পারে। গর্ভফুলের অবস্থান সংক্রান্ত নানান জটিলতা এবং অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে।
যথাযোগ্য মেডিকেল কন্ডিশন থাকলে অবশ্যই সি সেকশন করতে হবে মা ও শিশুর নিরাপত্তার জন্য। সেটা শুধুমাত্র ডাক্তারের নির্দেশে হওয়াটাই কাম্য।যেসব কারণে সি সেকশন করতে নির্দেশ করেন ডাক্তার-
- বেশি বয়সে মা হলে ভ্যাজাইনাল টিয়ারিং এর সম্ভাবনা থাকে, তখন ডাক্তার সি সেকশনের কথা বলতে পারেন।
- প্লাসেন্টা প্রিভিয়া (Placenta Previa), অর্থাৎ গর্ভফুল নিচের দিকে থাকলে।
- প্লাসেন্টা অ্যাবরাপশান (Placenta Abruption) থাকলে।
- বেবি যদি ব্রীচ পজিশনে থাকে,অর্থাৎ তার মাথা উপরের দিকে এবং পা নিচের দিকে থাকে, সেক্ষত্রে ওসি সেকশন করা জরুরি।
- গর্ভস্থ শিশুর গলায় নাড়ী পেঁচিয়ে গেলে।
- যদি গর্ভস্থ সন্তান অনেক বেশি ওজনের হয়ে যায়।
- প্রিএকল্যাম্পশিয়া থাকলে। যার সাথে উচ্চ রক্তচাপও সম্পর্কিত।
- গর্ভে দুই বা ততোধিক সন্তান একসাথে থাকলে।
কিন্তু আমাদের এখানে এখন ঐচ্ছিক সি সেকশনের ট্রেন্ড শুরু হয়েছে যেটা সত্যিই খুব ভয়ানক। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক, এমনকি মফস্বলের হাসপাতালগুলোতেও কম্পলিকেশন না থাকা সত্ত্বেও কখনো কতিপয় ডাক্তারদের বাণিজ্যিক মনোভাবের কারণে, চাপে পড়ে, আবার কখনো বা গর্ভবতী নারী ও তার পরিবারের নিজের ইচ্ছাতেই যথেচ্ছ সি সেকশন হচ্ছে।সি সেকশনের কিছু নিজস্ব ঝুঁকি রয়েছে। একটি হচ্ছে অ্যানেসথেশিয়ার ঝুঁকি। আরেকটি হচ্ছে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি। কিংবা ইনফেকশনের ঝুঁকি। কাজেই মা সেখানে ঝুঁকি মুক্ত থাকছে, এ কথা কিন্তু পুরোপুরি সত্য নয়। অর্থাৎ যে নারীর স্বাভাবিক প্রসব হতো, অস্ত্রোপচার করে প্রসব করানোর কারণে দীর্ঘমেয়াদি জটিলতায় হয়তো সে ভুগতে পারে। সে ক্ষেত্রে ভোগান্তিও বাড়ছে। আর্থিক খরচও বাড়ছে। অথচ সি সেকশন কিন্তু খুব মেজর একটা সার্জারি। যেখান থেকে রিকভারি করতে বেশ অনেকটা সময় লাগে।
অন্যদিকে নরমাল ডেলিভারিতে লেবার পেইনের কষ্ট তীব্রতম হলেও আপনি সন্তান জন্মদানের পরপরই অনেক হালকাবোধ করবেন। নিজে নিজে হাঁটাচলা করা, বাথরুমে যাওয়া-আসা, ইজিলি বসে কারো সহযোগিতা ছাড়া ব্রেস্টফীডিং করানো (যেহেতু আপনার পেটে কোন স্টিচ নেই) সব করতে পারবেন। স্টিচের ভয়ে হাসতেও মানা নেই, কাশতেও মানা নেই। যদি আগে থেকে ব্যায়ামের অভ্যাস থাকে তাহলে ডেলিভারির পর ব্লীডিং বন্ধ হওয়ার পর ব্যায়াম শুরু করতে পারবেন, ভারী ব্যায়ামসহ। সি সেকশন হলে ভারী ব্যায়াম সাধারণত ৩ মাস পর থেকে শুরু করা যায়।
গর্ভধারণ করার পর থেকেই নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেয়া দরকার। তারপর যদি কোন কম্পলিকেশন তৈরি হয়, সেটা ভিন্ন কথা।
মায়ের এবং পারিবারিক দিক থেকে ডাক্তারদের উপরে অনেক সময়ই চাপ থাকে, যে মা ব্যথা সহ্য করতে পারবে না, নরমাল ডেলিভারিতে বাচ্চার মাথা লম্বাটে হয়ে যাবে, বাচ্চার ব্রেইনে চাপ পড়বে, দাম্পত্য জীবনে ইন্টিমেসিতে সমস্যা হবে- এই রকম আরো বেশ কিছু ভুল ধারণার ভাণ্ডার!
কাজেই যার কোন গর্ভকালীন সমস্যা নেই, কেন সে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ামাত্রই লেবার রুমে না গিয়ে চার দিনের সি সেকশনের প্যাকেজের কাগজ সাইন করে ওটি রুমে ঢুকবে? প্রপার মেডিকেল কন্ডিশন ছাড়া ঐচ্ছিক সি সেকশন কে না বলুন।
সবাই ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন, এবং প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা বাড়াতে চেষ্টা করবেন।
ছবি – কমপ্লেক্স ডট কম
লিখেছেন – ফারহানা প্রীতি