… গোঁড়ায় গলদ
এই পর্ব শুরু করার আগে বলে নেই, কোন প্রোডাক্টকে খারাপ প্রমাণ করা এই লেখার উদ্দেশ্য না। কি ইউজ করলে আসলে আপনার হেয়ারে কি ইফেক্ট পড়বে, সেটা আমি পড়াশোনা করে যা বুঝেছি সেটাই খুব সহজ করে বোঝানোর চেষ্টা করছি… ‘কি হবে’ তা নিয়ে তো সাজগোজে প্রচুর টিপস দেয়া হয়… আমি না হয় একটু, কীভাবে হবে, তা নিয়ে কথা বলি…
সিল্কি ঝলমলে চুলের মুল কাহিনী খুবই সহজ… চুলের উপরের লেয়ারটা (কিউটিকল) যতটা পারা যায় সমান করে রাখা… যার কিউটিকল যত বেশি মসৃণ, তার চুল তত ঝলমলে…
গত পর্বে, আমরা এই কাজটা করার খুব সহজ শর্টকাট সিলিকন-যুক্ত প্রোডাক্ট নিয়ে কথা বলেছি। সেগুলো কীভাবে কাজ করে জেনেছি…
যেখানে শেষ করেছিলাম, সেখান থেকেই স্টার্ট করি?
তো, আপনি রোজ চুলে ৫ মিনিট মাস্ক, সিরাম, তেলের অল্টারনেটিভ লাগিয়ে অভ্যাস করে ফেলেছেন… একদিন শ্যাম্পু করে এগুলো কোনটাই ইউজ করলেন না, ফলে চুল আঠালো হয়ে গেল, জটা ছাড়াতে গিয়ে একগাদা চুল ছিঁড়ে গেল…
এখন আপনি কি করবেন?
চুলে মেহেদি দেবেন? সাজগোজেই চুলের মাস্কের হাজার হাজার রেসিপি আছে, কোনটা খুঁজে বের করে কোনটা ট্রাই করবেন?
কিন্তু কি বলেছিলাম? চুলের প্লাস্টিকের লেয়ার ভেদ করে চুলে হাত দিতে পারবে একটা মাস্কও? – না…
অনেকে নিজেই বুঝে গিয়েছেন তাই না?
এক্ষেত্রে আঠালো চুলের হাত থেকে মুক্তি পেতে আপনার যা যা করার আছে তা হল-
১। হয় অপেক্ষা করা… কয়েকমাস ধরে চুল শ্যাম্পু করে করে সিলিকনের লেয়ার ধুয়ে চুলের আসল চেহারা সামনে নিয়ে আসা। (আসল চেহারা কেমন ছিল মনে আছে তো? )
কিন্তু? এত ধৈর্য আমার থাকলে কি আর আমি সিরাম আর ৫ মিনিট মাস্কের প্রেমে পড়ে তেলের অল্টারনেটিভ কিনে আনি? অবশ্যই আমার এই ধৈর্য হয়নি…
২। পরের বার শ্যাম্পু করেই সিরাম মেখে ফেলা। এবং বুঝে যাওয়া, সিরাম/ সিলিকনে ভর্তি কন্ডিশনার মাস্ক না মাখলেই চুল আঠালো হয়ে যাবে… সুতরাং, স্পেশাল অকেশনে মাঝে মাঝে যে জিনিসটা ইউজ করার কথা ছিল- এখন আপনি এক সপ্তাহে ৩-৪ বার সেটা মাখছেন…
ফলাফল, চুলের উপরের কেমিকাল লেয়ার আস্তে আস্তে মোটা হতে থাকা…
যেহেতু, বেশিরভাগ মানুষ ২ নাম্বারটাই বেছে নেবেন, সেহেতু যে ঘটনাটা ঘটবে তা হল-
– আপনি পুরোপুরি সিরাম, সিলিকনে ভরা কন্ডিশনার, ১০০% মিনারেল অয়েলযুক্ত ড্রাই অয়েলের উপরে নির্ভরশীল হয়ে যাবেন… ২-৩ মাসে একটা করে প্রোডাক্ট কিনবেন… কসমেটিক ব্র্যান্ড খুব কম খরচে লয়াল একজন কাস্টোমার পেয়ে যাবে… যে বারবার নিজের ক্ষতি করে নিজের পকেটের পয়সা দিয়ে বোতল ভর্তি প্লাস্টিক (রূপক) কিনে নিয়ে যাচ্ছে…
[picture]
এখানে আপনার লাভ কি?
কোন লাভ নেই…
আপনার লোকসান কি?
– টাকা, একে তো ওই জিনিসগুলোই বারবার কিনবেন… দ্বিতীয়ত চুলের ড্যামেজ সারবে বলে এখন তেল, ঘরোয়া হেয়ার মাস্ক এসব কিনে এনেছেন… অজথা চেষ্টা করে যাচ্ছেন মাখার… কিন্তু রেইনকোট ভেদ করে বৃষ্টি যেমন গায়ে লাগে না, আপনার শখের মাস্ক, এক্সট্রা ভার্জিন তেলও সেভাবে চুল ছোঁয়ার চেষ্টা করেও পারে না… সো দুইভাবে আপনি হাজার হাজার টাকা জলে ফেলছেন… অনেকে তো পার্লারে প্রোটিন ট্রিটমেন্ট আরও কি কি যেন করাতে চলে যান… হিসাবটা বুঝতে পারছেন?
– চুল, পানি, পুষ্টির অভাবে চুলের অবস্থা একে তো করুন… আঁচড়াতে গিয়ে একগাদা চুল ছিঁড়ে যাচ্ছে… এই সময়ে চুল ফাটাও শুরু হয়… ফাটা চুল লম্বা করা যায় না। আবার সিলিকন-যুক্ত শ্যাম্পু ইউজ করে স্কাল্পেও সিলিকনের লেয়ার পড়ে যায়… শুরু হয় খুশকি… চুলের গোঁড়ায় একই সাথে সিলিকন, খুশকি, এতে আটকা পড়া ময়লা ইত্যাদির যন্ত্রণায় ঘটে যায় সর্বশেষ ঘটনাটা,
চুলের ফলিকল–টা মরে যায়… আর চুলটা পড়ে যায়… এতদিন শুধু চুল আঠালো আর রুক্ষ ছিল… এখন চিরুনি ছোঁয়ালেই গোঁড়া থেকে চুল উঠে আসবে…
অনেকে চুলের গোঁড়ায় সাদা দানা মতো দেখেন… ওটা হচ্ছে, হেয়ার সেবামের পুটুলি… আপনার শখের শ্যাম্পু সিরামের যন্ত্রণায় যে রোমকূপ থেকে বেরই হতে পারেনি… দলা পাকিয়ে উল্টা চুলটাকেই গলা টিপে মেরে ফেলেছে…
তো এই হল, মোটামুটি তেলের বিকল্প শ্যাম্পু, কন্ডিশনার, মাস্ক আর সিরামের পুরো কার্যকারিতা.…..
খুব নিশ্চিন্ত হয়ে বলতে পারছি এটাই হবে কারণ দীর্ঘ ৫-৬ বছর হাজার হাজার টাকা খরচ করে বিদেশি প্রোডাক্ট ইউজ করে আমি আমার কোমর ছাড়ানো চুলের অর্ধেকের মতো হারিয়েছি… এবং আমি নিশ্চিত আমি একা নই, যে হঠাৎ করে দেখেছে, গাদা গাদা চুল অকারণে পড়ে যাচ্ছে… চুলের গোছা পাতলা হয়ে খুলি দেখা যাচ্ছে…
কয়জন এই ঘটনার দোষ পানি, পলিউশন এসবের উপরে চাপাতে চেয়েছেন বলুনতো? নিশ্চিত বলতে পারি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কালপ্রিট আপনার শখের নারিকেল তেলের সাবস্টিটিউট ১০-১২ ধরণের সুন্দর সুন্দর নাম ওয়ালা চকচকে হেয়ার কেয়ার প্রোডাক্টের বোতলগুলো…
কিন্তু, এসব প্রোডাক্টে তো লেখা থাকে এরা নারিকেল তেলের বদলে শ্যাম্পু কন্ডিশনারে ১০-১২ রকম তেল মিশিয়ে দেয় !! যা মাত্র ৫ মিনিটে চুলে পুরো হট অয়েল ম্যাসাজের ইফেক্ট দেয়! কেন বলে?
আচ্ছা ধরুন, আপনি একটা গাছ লাগিয়েছেন… গাছের গোঁড়াটা খুব ভালোভাবে পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে দিলেন… এখন আপনার ইচ্ছা গাছটাকে বড় করা, সুস্থ রাখা… অ্যান্ড বাজারে গিয়ে দেখলেন অনেক ধরণের নতুন সার, খুব কমপ্লেক্স নামযুক্ত কীটনাশক বাজারে পাওয়া যাচ্ছে… আপনি শখের চারাটার জন্য অনেক টাকা দিয়ে ১০-১৫ ধরণের সার কিনে আনলেন… রোজ গাছে পানি দেন, সার কীটনাশক দেন… কিন্তু হঠাৎ দেখলেন ১০-১২ দিন পড়ে চারাটা মরে গেল… !
কেন এটা হল ? নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন? সুদুর প্রাচ্যের ক্যামেলিয়া অয়েল, ম্যাজিকাল আরগান অয়েল… অর্গানিক নারিকেল তেল তখনি আপনার চুলকে পুষ্টি দেবে যখন আপনি এই অসাধারণ উপাদানগুলো আসলেই চুলে লাগাবেন… কিন্তু আপনি এমন কিছু প্রোডাক্ট ইউজ করছেন, যারা নিজেরাই আপনার চুলে একটা প্লাস্টিকের লেয়ার ফেলে দিয়ে আবার নিজেরাই ৭-১০ রকমের তেলের ম্যাজিক দেখানোর কথা বলছে… আর আপনি মিথ্যা সিলিকনের পর্দায় আলোর ঝলকানি দেখে ভাবছেন— বাহ !! তেল না দিয়েও কেমন সিল্কি চুল পেয়ে গেলাম…!
আপনি যদি না জানেন, এইসব প্রোডাক্ট আসলে আপনার চুলে কি করছে, আপনি কি খুশি মনে বছরের পর বছর এসব প্রোডাক্ট ইউজ করবেন না? যদি করেনই, ব্র্যান্ডগুলো আপনাকে কেন এসব শর্ট কাট মেথড বিক্রি করে নিজেরা মুনাফা করবে না… ?
They aren’t here to educate you ! They are here to sell!
তারা আপনাকে দেবে-
WHAT YOU WANT… NOT WHAT YOU NEED
দুটোর মধ্যে কিন্তু তফাৎ আছে…
আর ৩-৪ বছর পর নিজের পাতলা ফিনফিনে চুলের গোছা নিয়ে আমার মতো হা-হুতাশ করছেন…
সরি, যা লিখছি ব্যাক্তিগত এক্সপেরিয়েন্স থেকে লিখছিতো, আপনাদের হয়ত অনেক বেশিই বোর লাগছে…
আসুন আমরা চলে যাই নেক্সট টপিকে-
তাহলে, আমার দরকার তেল…
কিন্তু তেল এমন কি করে যা আধুনিক শ্যাম্পু কন্ডিশনার পারে না?
আপনার চুল বা ত্বক দুটোই কিন্তু ভেদ করা যায়… যদি কোন উপাদানের অনু এত ছোট হয় যে সে রোমকূপ বা চুলের কিউটিকল এর মাঝের ফাকা থেকেও ছোট… তাহলে কিন্তু সে ওই ফাকা দিয়ে ভেতরে চলে যেতে পারবে…
আসুন কয়েকটা উপাদানের নাম জেনে নেই যারা আসলেই এই কাজটা পারে-
১। পানি–
যখন আপনি চুল ভেজাবেন সে চুলের মধ্যে গিয়ে আদ্রতা দেবে… এতে চুল রুক্ষ হবে না/ ভাঙে না… এজন্য রোজ গোসল করাটা জরুরী… আমরা সবাই এটা জানি তাই না? নোংরা জটা বাধা চুল তো গোসল না করলেই হয় রাইট?
২। তেল-
সব তেল নয়… কিছু কিছু তেল… সবচেয়ে ছোট অনু যাদের তারাই প্রতিটি চুলের ভেতরে আদ্রতা এবং পুষ্টি নিয়ে যেতে পারে… যেহেতু গোসলের উপকারিতা আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়… এই তেলগুলো নিয়েই আমরা কথা বলব…
যেসব তেল চুল এবং স্ক্যাল্পের স্কিন সবচেয়ে ভালো পেনেট্রেট করতে পারে তারা হচ্ছে-
– নারিকেল তেল
– অ্যাভোকাডো অয়েল
– তিলের তেল
এখন অনেকেই বলবেন, অ্যাভোকাডো/ তিলের তেল যোগার করব কোথা থেকে? তাদের জন্য- আমি কিন্তু নারিকেল তেলের কথাও বলেছি… আমাদের অভ্যাস হচ্ছে ঘরে সোনা রেখে বাইরের পিতলের পেছনে ছোটার… তাই বরং বাজারে পাওয়া যায় না, গেলেও হাজার হাজার টাকা গচ্ছা দিতে হয় এমন উদ্ভট তেলের পিছনে না ছুটে একদম বেসিক থেকেই শুরু করি? কেমন?
নিশ্চয়ই ৪০-৫০ টাকার নারিকেল তেল সবার বাসাতেই আছে…
আসুন দেখি শুধু নারিকেল তেল দেয়ার সাথে সাথে চুলে কি কি হয়-
– নারিকেল তেল চুলের ডগার কিউটিকল ভেদ করে ভেতরে চলে যায় …
নারিকেল তেলের ক্ষমতা আছে কিউটিকল ভেদ করে একদম কর্টেক্স পর্যন্ত গিয়ে আদ্রতা দেয়ার… ফলে কি হয়? কর্টেক্স দুর্বল হয়ে চুল ভাঙ্গে না… আর সব চুল যখন প্রায় সমান লম্বা হবার সুযোগ পায় তখন কি হয় জানেন? চুল ঘন দেখায়…
– নারিকেল তেল কিউটিকল স্মুদ করে
প্রতিবার গোসলের আগে যখন আপনি তেল দিয়ে নেবেন তখন পানির ধারা আপনার চুলের কিউটিকল এলোমেলো করে ফেলতে পারে না… একঢিলে আপনি দুই পাখি মারছেন… আপনি চুল পরিষ্কারও করতে পারছেন, আবার তেলের কল্যাণে স্মুদ কিউটিকল অথবা সিল্কি চুল নিশ্চিত করছেন…
– নারিকেল তেল স্কাল্পের রোমকূপ ভেদ করে ত্বকের গভীরে চলে যায়
আপনার প্রি্য় তেলের সাবস্টিটিউট শ্যাম্পু কি করে মনে আছে? চুলের রোমকূপ সিলিকন দিয়ে বন্ধ করে দেয়… কিন্তু তেলের অনু খুব ছোট তাই সে রোমকূপ দিয়ে ভেতরে চলে যায়… নারিকেল তেলের থাকে ন্যাচারাল অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল ক্ষমতা… সে মাথার ত্বকের জীবাণু দূর করে রোমকূপের স্বাভাবিক সেবাম ফ্লো নিশ্চিতকরতে হেল্প করে… আর এক্সট্রা যে তেলটা মাথার ত্বকে রয়ে যায়… তা খুব সহজে ১ বার শ্যাম্পু করে ধুয়ে ফেলা যায়… এবং এই পুরো ব্যাপারটিতে মাথার ত্বকে এক্সট্রা কোন লেয়ার পড়ে না … ফলে চুলের গোঁড়ায় সিলিকন, যাচ্ছেতাই কেমিক্যাল জমে চুলটার মৃত্যু হয় না…
সারাজীবন তেল ব্যাবহার করে আমার মায়ের চুল এখনো আমার থেকে বেশি… আর আমি ৫-৬ বছর স্মার্ট হেয়ার কেয়ার ইউজ করে চুল ফিনফিনে করে কি নিজেকে খুব স্মার্ট প্রমাণ করতে পারলাম? না…
অনেক গদাইলস্করি চালে লিখছি বলে এই পর্বটাও লম্বা হয়ে গেল… কিন্তু জানি সবাই চান নিজের শখের চুলের যত্নে একটু লাক্সারিইয়াস প্রোডাক্ট, তেল, সিরাম এসব ইউজ করতে… আর টিভি খুললে শ্যাম্পুর অ্যাডের মডেলের কম্পিউটার জেনারেটেড চুল থেকে চোখ ফেরানোই তো মুশকিল…
কিন্তু কি জানেন? ৫০ টাকার নারিকেল তেল যতই আনস্মার্ট লাগুক না কেন… ১০০০ টাকার বিদেশি কন্ডিশনারের চেয়ে তার ক্ষমতা কিন্তু খুব একটা কম না…
আর আমার অন্তত এতটুকু শিক্ষা হয়েছে যে আমি আর এই জীবনে তেলের সাবস্টিটিউট ৫ মিনিট সলিউশন নিজের পকেটের টাকা দিয়ে কিনব না… ২ ঘণ্টা মাথায় তেল মেখে নয় একটু খ্যাতই হলাম…
কিন্তু মিছরির ছুরির কোন প্রয়োজন আমার আর নেই…
অন্তত ৫ বছর পর আমার চুলগুলো তো মাথায় থাকবে তাই না… ?
আশা করি আজকের লেখাটা ভালো লেগেছে…
খুব শীঘ্রই হারবাল হেয়ার অয়েল কী? এবং কীভাবে কাজ করে তা একটু ডিটেলে লিখব… হেয়ার কেয়ারের বিভিন্ন স্টেপ কীভাবে কাজ করে জানতে চাইলে আস্ক করতে পারেন… ভবিষ্যতে বুঝিয়ে লেখার ট্রাই করব…
ভালো থাকবেন…
লিখেছেন – তাবাসসুম মিম