আজকাল যেকোন অনুষ্ঠান , জাতীয় দিবস , ঈদ , পূজা এমন কি দৈনন্দিন কাজে; বাসা কিংবা অফিসে মেয়েরা শাড়ি পরছে না। সব জায়গাতে পাশ্চাত্য পোশাক বেছে নিচ্ছেন নারীরা। ফলে দেশীয় শাড়ির চাহিদা কমে যাচ্ছে , দেশে শাড়ির ব্যবসা এখন খারাপ।
দেশীয় শাড়ি বাদ দিয়ে পাশ্চাত্য পোশাকের পাশাপাশি ভারতীয় শাড়ি ব্যবহার করছেন মেয়েরা। শাড়িতে থাকছে ভারতীয় ডিজাইন!
আজকাল বিয়েতেও অনেকে দেশীয় শাড়ি বেছে নেন না। বিয়ের কনে থেকে শুরু করে অতিথিদের চাহিদা এখন বিদেশী পোশাকের দিকে। বিশেষ করে বিখ্যাত ডিজাইনার দিয়ে তৈরি পোশাক এখন মেয়েদের প্রথম চাহিদা। এমন কি বাঙালির বিভিন্ন সামাজিক উৎসবেও মেয়েরা বাঙালি পোশাক বেছে নেন না, তারা পছন্দ করেন ভারতীয় শাড়ি কিনবা পাকিস্তানি সালওয়ার কামিজ।
এখন সব অনুষ্ঠানে টাঙ্গাইল , মসলিন , জামদানি , রাজশাহী সিল্ক এসবের জায়গায় ভারত , পাকিস্তান থেকে আসা ঝলমলে শাড়ি জায়গা দখল করে আছে ! আমাদের দেশে যুগ যুগ ধরে যেসব শাড়ি ঐতিহ্য ধরে রাখছে যেমন-সুতি শাড়ি , তাঁত , টাঙ্গাইল , কোটা , মসলিন , জামদানি , রাজশাহী সিল্ক , শিফন , জর্জেট , কাতান ইত্যাদি। আজকাল এসব দেশীয় শাড়ি সম্পর্কে ধারণাও অনেকে রাখেন না।
[picture]
টাঙ্গাইলের শাড়ি
টাঙ্গাইলের শাড়ির ব্যবসায়ীদের অভিযোগ এখন এটাই যে মেয়েরা এখন দেশীয় শাড়ি পরে না। ফলে ব্যবসা ভালো চলছে না। কয়টা মেয়ে এখন শাড়ি পরে? সব জায়গাতেই পাশ্চাত্য ধাচের ড্রেস কিংবা গাউন পরছেন সবাই। শাড়ির থেকে ডিজাইনার গাউনের চাহিদা এখন বেশি। বয়স্করা দুই-একটার বেশি শাড়ি কিনেন না, তাই ব্যবসায়ীদের আশা থাকে তরুণীদের দিকেই।
টাঙ্গাইলে বর্তমানে তৈরি হচ্ছে হাফসিল্ক শাড়িও। এটিও সাধারণ রঙ আর ডিজাইনে তৈরি হয়। তবে বেশ জনপ্রিয় এখন। টাঙ্গাইল থেকে পাইকারি দামে এই শাড়ি অনেকেই কিনে থাকেন। তবে কম কেনার ফলে তেমন লাভজনক হয় না।
শাড়ির চাহিদা কমার ফলে শাড়ির উৎপাদন কমে যাচ্ছে। টাঙ্গাইলে তিন ধরণের তাঁতের শাড়ি চলে। যার মধ্যে আছে পিটলুম, চিত্তরঞ্জন তাঁত এবং বিদ্যুচ্চালিত তাঁত। এদের মধ্যে পিটলুম সব থেকে বিখ্যাত। কারণ এই শাড়ি হাতে বানানো হয়।একটি শাড়ি বানাতে লাগে ৬ থেকে ৭ দিন। এই কাজের সাথে যুক্ত কারিগরের সংখ্যা ২০ হাজারেরও কম। টাঙ্গাইলের শাড়ির অন্যতম ঐতিহ্য এই পিটলুম শাড়ি। যার উৎপাদন দিন দিন কমে যাচ্ছে।
টাঙ্গাইলের শাড়ির মান খুব ভালো। বহরে ঠিক, বেশি ভারি হয় না , আরামদায়ক , দেখতেও সাধারণের মধ্যে চমৎকার লাগে! গরমে পরার জন্য বিশেষ উপযোগী হিসেবে জনপ্রিয়তা পায়। ঘরে বাইরে যেকোন জায়গায় পরার মতো শাড়ি হলো টাঙ্গাইলের শাড়ি !
রাজশাহী সিল্ক
রাজশাহী সিল্ক সব সময়ই দামি শাড়ি হিসেবে জনপ্রিয়। দেখা যায়, আমাদের মা খালাদের কাছে এসব শাড়ি অনেক প্রিয় হয়ে থাকে।এই সিল্কে আরামের চেয়ে দেশীয় ডিজাইনের আভিজাত্যই বেশি ফুটে ওঠে। গুটিপোকা থেকে উৎপন্ন রেশম সুতা থেকে আগে সিল্ক কাপড় তৈরি করা হতো। এখন এভাবে সিল্ক তৈরি কমে গেছে। ফলে যান্ত্রিক তাঁতে শাড়ি বুনন করা হয় এখন।
আগে আধুনিক শাড়ি বলতে রাজশাহী সিল্কের জনপ্রিয়তা ছিলো অনেক বেশি!
মণিপুরি শাড়ি
মণিপুরি শাড়ির বুনন একটা বিশেষ সম্প্রদায় থেকে আসছে। বৈচিত্র্যময় নকশার এই শাড়ি কম পরে মেয়েরা। তাই এই শাড়ির নকশাকার বা তাঁতীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। সিলেট শহরের পোশাকের দোকানগুলোতে মেলে মণিপুরি শাড়ি। বেশ অল্প দামেই মণিপুরি শাড়ি পাওয়া যাবে এখানে। মণিপুরী শাড়ির রঙ ও নকশা দেখলেই বোঝা যাবে এটা মণিপুরী শাড়ি। কারণ এই শাড়ির পুরো জমিনেই কম-বেশি নকশার ছাপ থাকবে। মূলত এই শাড়ি এক বা দুই রঙের হয় না, বেশ কয়েকটি রঙ নিয়ে নকশা করা হয়।
জামদানি শাড়ি
জামদানির ক্ষেত্রে এর ঐতিহাসিক পটভূমি কাজ করছে। বর্তমানে ঢাকার আশপাশেই তাঁতশিল্পীদের বোনা জামদানি যেন হয়ে উঠেছে আভিজাত্য। জামদানি একান্তই ঢাকার নিজস্ব কাঁচামালের তৈরি। এই শাড়ির বুনন সময়সাপেক্ষ আর নকশা খুবই সুক্ষ হয়। পৃথিবীর আর কোনো দেশের তাঁতীদের পক্ষে এ শাড়ি তৈরি সম্ভব হয়নি। জামদানি শাড়ির দাম তাই বর্তমানে অনেক বেশি।
এ শাড়ির নকশা কেবল একজন তাঁতী দিয়ে শেষ করা যায় না , শাড়ি প্রস্তুত হওয়ার প্রতিটি পর্যায়ে পারিবারিক সহযোগিতার প্রয়োজন হয়।
জামদানি শাড়ির মূল আকর্ষণ এর নকশা।তাঁতিরা সরাসরি তাঁতে বসানো অবস্থায় নিজের মতো নকশায় শাড়ি বুনেন, মন থেকে ভিন্ন ভিন্ন নকশা আঁকেন। যা এই শাড়িকে সব থেকে অনন্যা করে তুলে।তাই একটি শাড়ির ডিজাইনের সাথে অন্যটির খুব বেশি মিলে না। একটি শাড়ি বুনতে সময় লাগে প্রায় ২ থেকে ৩ মাস। জামদানি শাড়ির দাম নির্ভর করে শাড়ির কম বেশি ডিজাইনের উপর।
জামদানি শাড়ি আপনাকে সবার থেকে আলাদা করে রাখতে পারে যেকোন অনুষ্ঠানে।
কাতান
কাতান শাড়ি আগে মেয়েরা বিয়েতে পরতো।আমাদের মা খালাদের আমলে বেনারসি আর কাতান পরা হত বিয়েতে। হালকা কাজে বা এক কালারের সাথে গাঢ় পাড়ের কাতান শাড়ি ব্যবহার করে থাকতেন নারীরা। আর বিয়েতে ব্যবহার করতেন ভারি কাজের কাতান শাড়ি।
এক কালারের কাতান হলেও আঁচল আর পাড়ে বিভিন্ন নকশা করা থাকে। আজকাল চিকন পাড়ের কাতানও অনেকে ব্যবহার করে থাকেন। কাতান শাড়ির অন্যতম আকর্ষণ হলো এর উজ্জ্বলতা! যেটি খুব গর্জিয়াজ লুক দেয়!
এছাড়াও সাধারণের মধ্যে কোটা, মসলিন, শিফন, জর্জেট ইত্যাদি শাড়িও একইভাবে বাংলাদেশে ঐতিহ্যময়। যা একজন নারীকে সব থেকে অনন্যা করে রাখে।
বর্তমানে মেয়েরা যেসব পাশ্চাত্য পোশাকের ধারা নিয়ে আসছে তাদের তুলনায় দেশীয় শাড়িতে সাজা একটি মেয়ের সৌন্দর্য তিন গুণ বেড়ে যায়! নিজের দেশের ঐতিহ্যকে উপেক্ষা না করে সেটিকে নিজের অহঙ্কার হিসেবে বেছে নিন।
যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পাশ্চাত্য ধারার পোশাক ব্যবহার করছেন সবাই। না চাইতেও অনেক দামি পোশাক বেছে নিচ্ছেন বর্তমান যুগে চলতে। তাই বলে দেশীয় পোশাককে একেবারেই উপেক্ষা করা যায় কি! বাঙালি নারীর সৌন্দর্যের অহংকারই তো শাড়ি!
ছবি – দেশেবিদেশে ডট কম, পিন্টারেস্ট ডট কম, একুশ আমার ডট কম
লিখেছেন – সোহানা মোরশেদ