গর্ভধারণ সমস্যা নিয়ে লিখতে অনেকে অনুরোধ করেছেন। তাই এ নিয়ে আজ বিস্তারিত জানাবো। লেখাটা আমার পরিচিত আত্মীয়ের সম্পর্ক নিয়েই শুরু করছি। এ যেন সেই দিনের কথা! ওদের দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকী, দেখতে দেখতে পথ চলার দুটো বছর পার হয়ে গেলো! বেশ কিছু ফ্রেন্ডস আর ফ্যামিলি মেম্বারদেরকে নিয়ে বাসাতেই একটা ছোটখাটো গেট টুগেদারের আয়োজন করা হয়েছে। ওর ছোট নানী বেশ রসিক মানুষ, হঠাৎ বলে উঠলেন “আর কত হানিমুনের সময় পার করবা? এবার একটা খেলার পুতুল নিয়ে এসো!” সত্যি কথা বলতে কি ওদের প্রেমের বিয়ে হলেও দুজনই চেয়েছিল একান্তে বেশ কিছু সময় কাটাতে, বিভিন্ন নতুন নতুন জায়গায় ঘুরতে যেতে, ক্যারিয়ারে আরেকটু মনোযোগ দিতে, আর সেই সাথে কিছু সেভিংস করতে যেন সংসারে নতুন অতিথি এলে সবকিছু সুন্দরভাবে ম্যানেজ করে নেয়া যায়। ওরাও ভাবছিল এবার ওরা নতুন অতিথির জন্য তৈরি।
দেখতে দেখতে আরো একটা বছর কেটে গেলো। ওদের তৃতীয় বিবাহবার্ষিকী। দুজনেরই মনটা বেশ খারাপ। গেলো এক বছরে তারা সন্তানের জন্য অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু লাভ হয় নি। প্রথম প্রথম মাস ছয়েক তারা বিষয়টা খুব একটা আমলে নেয় নি, কিন্তু ছয় মাস পেরোবার পর ধীরে ধীরে দুশ্চিন্তা ভর করা শুরু করলো। তার মধ্যে আশেপাশের মানুষজনের তীর্যক মন্তব্য, সন্তান পাওয়ার দুশ্চিন্তায় দাম্পত্যে দূরত্ব এসব তো ছিলই। এসবের মাঝে দুজনের এত বছরের ভালোবাসাটাও যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে।
উপরের গল্পটি কিন্তু এখন বেশ কমন একটি ঘটনা। অন্তত এক বছর চেষ্টা করার পর যদি আপনি গর্ভবতী হতে না পারেন তবে আপনার ফার্টিলিটির সমস্যা থাকতে পারে। প্রায়ই দম্পতিরা চেষ্টা করার দ্বিতীয় বছরে সাহায্য ছাড়াই কনসিভ করে। তারপরও যাদের সন্তান ধারণে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করতে হতে পারে। বয়স একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর গর্ভধারণের ক্ষেত্রে। একজন নারী তার লেইট টুয়েন্টিস (Late 20s) এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফার্টাইল থাকেন। ৩৫ এর পর, ফার্টিলিটির হার কমে যায় এবং গর্ভপাতের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
১. প্রতি ১০০ জন নারীর মধ্যে প্রায় ৫০ জন নারীর পলিসিস্টিক ওভারী সিন্ড্রোম, ফেলোপিয়ান টিউবে সমস্যা, এগ রিলিজে সমস্যা, ওভোলিউশন সাইকেল প্রবলেম – এ জাতীয় সমস্যার কারণে সহজে গর্ভধারণ করতে পারেন না।
২. শতকরা ১০০ জন পুরুষের মধ্যে ৩৫ জন পুরুষের শুক্রাণুর সংখ্যা বা মান ভালো না হওয়ায় সন্তান গ্রহণে সমস্যা হয়।
৩. প্রতি ১০০ জন দম্পতির মধ্যে ১০ জনের অনেক রকম পরীক্ষা করা সত্ত্বেও সন্তান ধারণে সমস্যার কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না।
৪. প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৫ জন দম্পতির ক্ষেত্রে অন্যান্য সাধারণ কোন কারণ বের হয়।
কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন?
স্ত্রীর মাসিক শুরুর দিনটিকে ডে ১ বলা হয়, ঐ দিন থেকে ৮ম দিনের পর ৯ম দিন থেকে মূলত যেকোন সময় স্ত্রী কনসিভ করতে পারেন। চিকিৎসকেরা সাধারণত এই সময়টায় প্রতি এক দিন অন্তর সন্তানলাভের জন্য চেষ্টা করতে বলে থাকেন। ওভোলিউশনের সময়টা যাদের মাসিকের সাইকেল রেগুলার তাদের ক্ষেত্রে সাধারণত ১২ থেকে ১৪ তম দিনে হয়ে থাকে। ঐ সময় গর্ভধারণের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে। এই নিয়ম মেনে যদি এক বছর পরও গর্ভধারণ না হয়, তখন আসলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়াই ভালো।
চিকিৎসক কি কি টেস্ট করতে দিতে পারেন?
স্বামী এবং স্ত্রী উভয়ের ফুল বডি চেকআপ, যেখানে ব্লাড প্রেশার, ব্লাড সুগার, থাইরয়েড, নারীদের জন্য আল্ট্রাসাউন্ড, পুরুষদের জন্য স্পার্ম কাউন্ট এ ধরণের টেস্টগুলো করতে দেয়া হয় সাধারণত। এসব টেস্টের রেজাল্টের ভিত্তিতে সমস্যা নির্ণয় করে চিকিৎসা দেয়া হয়।
গর্ভধারণ সমস্যার (ফার্টিলিটি সমস্যা) ট্রিটমেন্ট
চিকিৎসা ব্যবস্থা এখন অনেক উন্নত। দম্পতির গর্ভধারণ করতে না পারার সঠিক কারণটি শনাক্ত করতে পারলে ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে তার সমাধান করা সম্ভব।
১. ওভোলিউশনের জন্য নির্দিষ্ট কিছু মেডিসিন আছে, যা ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী খেলে ওভোলিউশনের সাইকেল এবং টাইমিংটা ঠিক হয় এবং ওভোলিউশনে সহায়তা করে।
২. নারীর জরায়ু বা গর্ভাশয়ে সিস্ট বা টিউমার জাতীয় কোন সমস্যা থাকলে সেটা সার্জারীর মাধ্যমে ঠিক করা সম্ভব।
৩. নারীর থাইরয়েড বা বাড়তি ওজনের সমস্যার ট্রিটমেন্ট সম্ভব।
৪. আর্টিফিসিয়াল ইনসেমিনেশন
৫. আই ভি এফ
ফার্টিলিটি সমস্যার ট্রিটমেন্টে কিছু সাজেশন
এসব চিকিৎসা অনেক ক্ষেত্রেই দম্পতির শরীরে এবং মনে প্রভাব ফেলে, সেই সাথে এগুলো বেশ ব্যয়সাধ্যও।
১. সবার আগে জরুরী কাউন্সেলিং। আমাদের দেশে কাউন্সেলিং এর উপর একেবারেই জোর দেয়া হয় না, যার জন্য কিন্তু অনেক ভালো চিকিৎসা ব্যবস্থাও দেখা যায় ঠিক মতো কাজ করে না। শুধুমাত্র কিন্তু আপনারাই এ সমস্যায় নন, আরও অনেক দম্পতি এ সমস্যায় আছেন।
২. আজকাল ফার্টিলিটি সমস্যা নিয়ে ভুগছেন এমন দম্পতিদের বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপ আছে, সেখানেও মন খুলে কথা বলতে পারেন। মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে পারেন।
৩. মন ভালো রাখতে হবে, সবসময় হাসিখুশি থাকতে হবে, সন্তান লাভের প্রক্রিয়াটাকে স্ট্রেসফুল করা যাবে না, আপনারা যদি সারাক্ষণ এভাবে ভাবতে থাকেন যে কবে আপনারা প্যারেন্টস হতে পারবেন, তাহলে কিন্তু আপনাদের দু’জনের একান্তে কাটানো সময়টা একেবারেই উপভোগ্য হবে না এবং আল্টিমেটলি সেটা গর্ভধারণের প্রক্রিয়াটাকে আরো ধীরগতির করে দিবে। তাই স্ট্রেস নেওয়া যাবে না।
৪. দু’জন একে অপরকে সময় দিন, ভালোবাসুন, আর ভবিষ্যতের চিন্তায় নিজেদের বর্তমানটাকে জিওপারডাইজ করবেন না। দু’জন মিলে ঘুরতে যান। একসাথে রান্না করুন, বই পড়ুন, ছবি আঁকুন, উপহার দিন, কফি খেতে যান। ভালো লাগবে। আপনাদের দাম্পত্য যদি স্ট্রেসফুল হয়, তাহলে কি আপনারা ভালো থাকবেন?
সবাই ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন, এবং সবচেয়ে বড় কথা স্ট্রেস ফ্রি জীবনযাপনের চেষ্টা করবেন।
ছবি – সংগৃহীতঃ জিভাফারটিলিটি.কম, সুপারহাবার.টিভি