সন্তান যখন গর্ভে থাকে, তখন থেকেই আশেপাশের মানুষের পরামর্শ আর শুভাকাংক্ষিতায় একটি মেয়ে নিজেকে ভুলে যেতে শুরু করে। অনেক মেয়ের মাঝে এ সময় বারবারই মনে হয়, আমি মনে হয় আমার ১০০% দিতে পারছি না, আমি মনে হয় ভালো মা হতে পারব না, আমি তো কিছুই জানি না, আমি ছাড়া সবাই বাচ্চার ভালো বোঝে। হরমোনের পরিবর্তন আর শারীরিক কারণে ধীরে ধীরে এই মন খারাপ ভাবটা ডিপ্রেশনে রূপান্তরিত হতে শুরু করে। আর সেটা আরও প্রখর হয় সন্তান জন্মদানের পর। এই সময়টাকে বলা হয় প্রসব পরবর্তী বিষণ্ণতা বা পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন বা বেবি ব্লুজ।
“কপালে সবসময় একটা কালো কাজলের টিপ দিয়ে রাখবা, মানুষের নজর লাগে কিন্তু! আর শোন মায়ের নজর সবচেয়ে বেশি লাগে, বাচ্চার মুখের দিকে অমন করে তাকিয়ে থাকবা না তো!”
“শোন, প্রতিদিন নিজে ১ লিটার করে দুধ খাবা, ঘি খাবা, ওজন বাড়লো না কি হলো এইসব নিয়ে চিন্তা করতে যাবা না, বাচ্চা কিন্তু নাইলে ঠিক মতো বুকের দুধ পাবে না!”
“বাচ্চা তো হলোই সেদিন, এখনই কিসের বেড়াতে যাওয়া! বেড়ানোর জন্য তো সারাজীবন পড়ে রয়েছে। কক্সবাজার গিয়ে ঐসব বাতাস লাগাবা, পানি নাড়বা আর বাচ্চাটার লাগবে ঠাণ্ডা।”
“পা ধরে টেনে টেনে ম্যাসাজ করবা, ছেলে যেন বাবার মতো লম্বা হয়, তোমার যা হাইট অমন হলে তো সর্বনাশ!”
“রঙটা তো পরিষ্কার হলো না, পেটে থাকতে দুধ খাওনি?”
“আমরা তো বাচ্চাকে জীবনে ঐসব তোলা (ফর্মুলা মিল্ক) দুধ খাওয়াই নাই, ডায়াপারও পরাই নাই। তোমরা হচ্ছো অলস মা, কষ্ট না করেই মা হয়েছো!”
“সব খাবার কি একাই খাচ্ছো নাকি? বাচ্চার স্বাস্থ্য এমন কেন? হাতির ঘরে মশা হলে চলে?”
“মা হয়েছো, ঐভাবে চলবা, এত সাজগোজ কিসের? বাচ্চার যত্ন নাও ঠিক মতো!”
কি? খুব পরিচিত মনে হচ্ছে লাইনগুলো? হাঁ, আমাদের দেশে, বিশেষ করে ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্টে যখন প্রথমবার মা হয়, তখন তার পরিবার এবং সমাজ (অধিকাংশ ক্ষেত্রে) ধরে নেয় যে আজ থেকে সে একজন মা, আর অগোচরে ভুলেই যায় যে মেয়েটি মা তো বটেই, কিন্তু সে একজন মানুষও!
এ সময় পরিবারের ভূমিকা কি?
পরিবার প্রতিটা মানুষের নির্ভরতার একটা জায়গা, পরিবার থেকে যদি নেগেটিভিটি আসে তাহলে ডিপ্রেশনের অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতে সময় লাগে না। এ সময়টায় পরিবারকেই সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। নতুন মা হবার পর ঘুমটা ভীষণ জরুরী। সন্তানকে কিছুক্ষণ পরপর খাওয়ানো, ডায়পার বা কাঁথা চেইঞ্জ করা সব কারণে দেখা যায় মায়ের ঘুম ঠিক মতো হয় না। আর মেজাজ ও খিটখিটে হতে থাকে।
ব্রেস্টমিল্ক পাম্প করে রাখলে, অথবা ফর্মুলা ফীডিং করালে পরিবারের অন্যরা একটা নির্দিষ্ট সময় বাচ্চাকে খাওয়ানোর দায়িত্বটা নিতে পারেন, ফলে মা ঘুমানোর সুযোগ পাবে। সবসময় তাকে উৎসাহ দিতে হবে। কারণ মাতৃত্ব একটা Gradual Process, এটা কিন্তু সত্যিই কেউ কাউকে শেখাতে পারে না, আর কেউ মায়ের পেট থেকে শিখেও আসে না। এটা প্রকৃতিগতভাবেই সব মা-ই আস্তে আস্তে শিখে যায়। তাই সবসময় মায়ের ভুল ধরা বাদ দিয়ে তাকে উৎসাহিত করার চেষ্টা করুন, তাকে ছোটখাটো উপহার দিন, তার প্রশংসা করুন। এই ছোট্ট ছোট্ট ব্যাপারগুলোই কিন্তু তাকে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন থেকে বেরিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে আসতে সাহায্য করবে।
প্রসব পরবর্তী বিষণ্ণতা বা পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের লক্ষণ
- সন্তান জন্মদানের আগেই ডিপ্রেশনের অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতে থাকলে।
- সন্তান জন্মদানের ২-৩ সপ্তাহ পর ও যদি মন খারাপ, হতাশা কাজ করে।
- নিজেকে দোষারোপ করা এবং বারবার জাস্টিফাই করার চেষ্টা করা – আমি কেমন মা।
- ভালো লাগার জিনিসগুলো আর ভালো না লাগা, ভালো লাগার কাজগুলোতে উৎসাহ না পাওয়া।
- অকারণ দাম্পত্য কলহ।
- অকারণে কান্নাকাটি করা, এবং প্রতিটা ক্ষেত্রেই নেভেটিভিটি খোঁজা।
- আত্মহত্যার চিন্তা করা।
প্রসব পরবর্তী বিষণ্ণতা বা পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের চিকিৎসা?
সাধারণত সন্তান জন্মদানের ২-৩ সপ্তাহ পর-ই বেবি ব্লুজ কেটে যেতে শুরু করে। কিন্তু কোন কারণে যদি এটা না হয়, এবং আপনার প্রসব পরবর্তী বিষণ্ণতা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়, তখন আসলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিৎ। ভালো কোন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আপনাকে সহযোগিতা করতে পারবেন। সঠিক মেডিকেশন আর সাইকোথেরাপির মাধ্যমে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন দূর করা সম্ভব।
আপনি মা হয়েছেন, কিন্তু আপনি একজন মানুষও। নিজেকে ভালবাসুন, নিজের যত্ন নিন। আপনার সন্তান অবশ্যই আপনার প্রায়োরিটি, কিন্তু আপনি নিজেও কিন্তু আপনার প্রায়োরিটি। A happy mother can raise a healthy & happy child.
নিজেকে ভালোবাসুন, নিজেকে সম্মান করতে শিখুন। যখন নিজেকে ভালোবাসতে পারবেন তখন কোন ডিপ্রেশন আপনাকে আর দমিয়ে রাখতে পারবে না।
ছবি – ফটোগ্রাফারস ডট ক্যানাভেরা, ইমেজবাজার