স্পেশাল চাইল্ড বলা হয় আপনার সন্তানটিকে, কেননা সে আর দশটা শিশুর মতো স্বাভাবিক নয়। তবে কি সে অস্বাভাবিক? মোটেও নয়! বিধাতা তাকে স্বাভাবিক বানাননি বলে যে অস্বাভাবিক বানিয়েছেন, তা ধরে নেয়ার আপনি বা আপনারা কেউ নন। মাথায় কেবল এতটুক রাখা চাই যে শিশুটি কিছুটা বিশেষ প্রকৃতির, তার যত্নআত্তিও প্রয়োজন বিশেষ। তাকে এই বিশেষ যত্নটা দিতে গিয়ে প্রতিনিয়ত আপনি যে কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, তা নিয়েই কিছু কথা বলছি এখানে।
একজন বিশেষ শিশুর বাবা-মা যারা, তাদের নিত্যদিন একেকটা যুদ্ধের মতো কাটে। এমন এক যুদ্ধ এটা, যাতে জীবনসঙ্গী বাদে আর কেউ সহযোদ্ধা হয় না। কোনো ক্ষেত্রে তো যুদ্ধটা বাচ্চার মায়ের একার হয়ে দাঁড়ায়, বিশেষ করে এদেশের প্রেক্ষাপটে এটা খুবই স্বাভাবিক দৃশ্য!
এই যুদ্ধে হাঁপিয়ে গিয়ে কখনো ক্ষান্ত দেয়ার ভাবনাও আসে কারো মনে। সব ছেড়ে পালিয়ে যেতেও মন চায়! কিন্তু নিজের সন্তানকে অস্বীকার করাটা কি এতোই সহজ? নিষ্পাপ একটা শিশুকে কেন এমন দুর্বিষহ একটা জীবনে একা ফেলে যেতে হবে? মন কি সায় দেয় এমনটা করতে?
এমন অভিভাবক হয়ে থাকলে কখনো নিজেকে খুব একলা অনুভব করবেন আপনি। নির্বাসিত লাগবে নিজেকে, যখন দেখবেন আশেপাশে আর দশটা শিশু সমাজে সুস্থভাবে বাঁচার অধিকার পাচ্ছে আর আপনি নিজের বাচ্চাটাকে নিয়ে ভিন্ন পথে হাঁটছেন, কিংবা হাঁটতে বাধ্য হচ্ছেন। পরিবারের মানুষেরাও মুখ ফিরিয়ে নেয় অনেক সময়। বাচ্চাটা দিনভর চেঁচামেচি করছে, ঘর নোংরা করছে, কিংবা এক জায়গায় স্থবির হয়ে শুয়ে-বসে নিজেকেই নোংরা করছে বারবার, সবাই এই জিনিসগুলো ভালোভাবে নিতে পারে না। তাই বলে কি শিশুটিকেই নির্বাসনে দিতে হবে? কখনোই নয়! বরং তাকে আগলে রেখে নিজেদের নির্বাসিত জীবনই বরণ করে নেয়া লাগে বাবা-মা হিসেবে। তাহলে কীভাবে চলবে এই নির্বাসিত জীবন? একলা লাগার হতাশা এড়াতে বরং নিজের চলাফেরার পরিধিটা ঢেলে সাজান আরেকবার। এমন বন্ধুরা থাকতে পারে আপনার, যারা আপনার সন্তানকে খুব সহজভাবে গ্রহণ করেছে। আপনার এই বিশেষ জীবনে যারা নিজেরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, তারা বাইরের লোক হলেও আপনার আপনজন। চলাফেরা বাড়ান তাদের সাথেই। সেটা আপনার জন্য ভালো, আর আপনার সন্তানের জন্য তো বটেই।
কখনো আপনি ভীত হবেন। সন্তানের জীবন নিয়ে হাজারটা ভয় আপনাকে স্বাভাবিক হতেও দেবে না। যখন আপনি থাকবেন না, কী হবে বাচ্চার? সে কি কখনো নিজে নিজে সমাজে চলার যোগ্য হতে পারবে? সমাজ কি তাকে একটু স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করবে কোনোদিন? এরকম একেকটা দুশ্চিন্তা আপনার ঘুম কেড়ে নেবে। কাছের মানুষদের সাথে আলোচনা করে হলেও ভেতরকার ভয়কে নিয়ন্ত্রণ করুন। সবটা সবসময় নিজের হাতে থাকে না। তখন অন্য মানুষদের দরকার হয়, যারা জমাটবদ্ধ বাজে অনুভূতি কমিয়ে মন শান্ত করতে পারে অনেকটাই। বাস্তবিক চিন্তাভাবনা রাখুন যতটা সম্ভব। ভয় অমূলক কিনা, কতটা যৌক্তিক, এসব ভুলে বসবেন না একেবারে। আপনার কোনো একটা ভয় পুরোপুরি ভিত্তিহীন হতেও পারে, অন্তত সেটুকু আগে একবার যাচাই করে নিন।
আপনি দশজনের কাছে সন্তানের কথা বলতে সংকোচ বোধ করবেন। এমন হতে পারে যে আপনি তাকে নিয়ে গল্প করতে চাচ্ছেন, কিন্তু মন থেকে বাধা আসছে আর আপনি কিছু বলতেই পারছেন না! কেননা বাচ্চাটা যে পুরোপুরি সুস্থ নয়! ওকে নিয়ে কথাবার্তা সবাই ভালোভাবে নেবে তো? প্রতিনিয়ত নিজের মনের সাথেই চলবে এমন কত যুদ্ধ! সবার কাছে বাচ্চার গল্প করার ইচ্ছা না হয় বাদ রাখুন। তাদের কাছেই গল্প করুন যারা বাচ্চাটাকে ভালোবাসে। যারা তার সম্পর্কে জানতে আসলেই ইচ্ছুক। আপনার বাচ্চার মতো অন্য যেসব শিশু রয়েছে, যোগাযোগ রাখুন তাদের বাবা-মায়েদের সাথে। তাতে করে অনেক সমস্যার সম্ভাব্য সমাধানও সহজে পাওয়া যাবে।
আপনি প্রচণ্ড ক্লান্ত থাকবেন। মানসিক ও শারীরিক, উভয় ক্ষেত্রেই। সারাদিন বাচ্চার সব রকম চাহিদা মেটানোর দিকে সজাগ নজর রাখা আপনার কাজ এবং তাকে নিয়ে দুচিন্তা করা আপনার অভ্যাস। কোনোটা থেকেই নেই মুক্তি! আপনাকে সাহায্য করার জন্য মাঝেমাঝে কেউ থাকতে পারে কিন্তু সবসময় নয়। আগেই বলেছি, যুদ্ধে আপনি একলা সৈন্য, এটা মেনেই ময়দানে থাকা লাগবে। আর সেজন্যই নিজের খেয়াল রাখুন, যত্ন নিন শরীর ও মনের। আপনার সার্বিক সুস্থতা আপনার বাচ্চার জন্য খুব বেশি দরকার।
কথাটা খানিক বিদঘুটে শোনালেও, এটা সত্যি যে কখনো আপনি অন্যের বাচ্চাদের প্রতি ঈর্ষাও বোধ করবেন! এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার, যখন আপনি দেখছেন একটা দুই বছরের বাচ্চা সেসব করে বেড়াচ্ছে যা আপনার ছয় বছরের বাচ্চা পারছে না, আপনার খারাপ লাগবেই। এই খারাপ লাগাটাই ঈর্ষার জন্ম দেবে আপনার মনে। এই জিনিসটা সামলানোও শিখতে হবে বৈকি! ঈর্ষা যেন মাত্রায় থাকে, না বাড়ে, নিজেকে সেটা বোঝানো আপনার কাজ।
এমন আরো কত সমস্যা যে নিত্যদিনের পথচলার সাথী হবে আপনার, আর কারো পক্ষে হয়তো ভাবাও মুশকিল! তবুও জীবন কাটবে এভাবেই। সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে সমস্ত বাধাবিঘ্ন আপনি ঠিক পেরিয়ে যাবেন। অক্লান্ত পরিশ্রমে সন্তানের জন্য একটা বাসযোগ্য জীবন আপনি গড়ে দিতে পারবেন, এই বিশ্বাসটুকু রাখা চাই কেবল।
ছবি – হাফিংটনপোস্ট ডট কম