আমাদের যেখানে শেষ, আমার কন্যার শুরুটা হয় সেখানে।
মাত্রই টিভিতে একটি অনুষ্ঠান শেষ হল, উপস্থাপক “ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, সুন্দর থাকুন” বলে বিদায় নিলেন।
আমরা ও চ্যানেল পাল্টালাম।
ওই মুহূর্তে কন্যার প্রশ্ন শুরু –“আচ্ছা মামনি, ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন বুঝলাম কিন্তু সুন্দর থাকুন মানে কি?”
আমার পাল্টা প্রশ্ন – “তুমি বলো তো – সুন্দর থাকুন মানে কি?”
কন্যার উত্তর – মন ভালো থাকা!
সাত বছর বয়সী কন্যার মুখে , এমন উত্তর আশা করিনি। তার উত্তর শোনে আমি মুগ্ধ! আমি নিশ্চিত ওই বয়সে আমার মাথায় এমন উত্তর কখনোই আসতো না।
আমার আত্মবিশ্বাসী উত্তর হতো – সুন্দর থাকা মানে নায়িকাদের মতো সেজেগুজে থাকা।
তাহলে ‘সুন্দর থাকা’ আসলে কি? আমার কন্যার মতো বললে বলতে হয় মন ভালো থাকা। মন ভালো কি চাইলেই থাকা যায়?
এজন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা করতে হয়। রূপচর্চার মতো করে ঘষেমেজে মনের চর্চা করতে হয়। আমরা কজন তা করি?
প্রতিনিয়ত নিজেদের কথার তীরে যখন অন্যকে বিদ্ধ করে একধরণের আত্মউল্লাসে মেতে উঠি। তখন কি আমি সত্যিই সুন্দর থাকি??
একসাথে আড্ডা আলোচনায় হাসি আনন্দের পাশাপাশি যখন অন্যের সমালোচনায় মুখরিত হই, তখন আমি আসলে কতটা সুন্দর??
আমার কাছের একজনের খারাপ সময়ে আমি যখন ব্রজেশ্বর এর মতো সকল জঞ্জাল পাশ কাটিয়ে চলি, তখন আমার চকচকে মুখটা কোন সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত হয়?
[picture]
সংসারের চাওয়া পাওয়ার দোলাচলে যখন সকল অপ্রাপ্তির হিসেবের খাতা খুলে নিজের কাছের মানুষটিকে অথবা অন্যকোন পরিজনকে কাঠগড়ায় দাড় করাই, তখন নামিদামি ব্রান্ডের পরিধেয় ও সাজসজ্জায় সত্যিই কি আমাকে সুন্দর দেখায়!
সবকিছু নিজের মতো করে,নিজের ছাঁচে ঢেলে চাওয়াটাই আমার সুন্দর থাকার বড় অন্তরায়।
যে পরিবারে আমার বাস তার প্রতিটি সদস্যকে ভালো না বেসে আমি সুন্দর থাকতে পারি না। সম্পর্কের মাঝে হিসেবের খাতা খুলে বসলেই সুন্দর থাকা যায় না। কে আমার জন্য কতটুকু চুল ভেজালো সেই হিসেবের খাতা ছুঁড়ে ফেলে, যতটুকু পারি অন্যদের জন্য আমি চুল ভেজাই, মনের আনন্দে যদি ভেজাতে পারি সেটাই আমার সুন্দর থাকা।
আমার পরিমিতিবোধ আমাকে সুন্দর রাখবে, যেমনটি আমার পার্লার আমার ত্বকের সৌন্দর্য ধরে রাখতে সাহায্য করে। চর্চা করতে হবে প্রতিনিয়ত। একদিনের চেষ্টা আমাকে সেই গন্তব্যে পৌছে দিবে না যেখানে পৌছলে সত্যিই আমি সুন্দর থাকবো।
আমার কন্যার প্রশ্নের উত্তরটিকে আরেকটু বুঝিয়ে বলতে গেলে বলতে হয় – সুন্দর থাকা মানে মনের ভেতর থেকে ভালো লাগা, ভালো থাকা। এবার এই কথার মর্ম বুঝতে না পেরে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুয়া কন্যার আবার প্রশ্ন – মানে?
মানে- inner good feelings.
বুঝলাম এইবার কন্যার পছন্দ হয়েছে।
সেই থেকে আমি ভাবছি এই মনের ভেতর থেকে ভালো লাগা, ভালো থাকা ( inner good feelings) কীভাবে বাড়ানো যায়? ঘর থেকেই শুরু করে দেখেছি পথ আছে অসংখ্য…
- বাচ্চাদের ছোটখাটো ভুলে রাগ না হয়ে ওদের বুঝিয়ে বললে মন প্রফুল্ল হয়।
- ঘরের কাজে সাহায্য কারী মেয়েটির ভুল অথবা অনুপস্থিতি র ঘটনায় রেগে না গিয়ে ” তার ভাগ্যের সাথে নিজের সৌভাগ্যের জন্য সৃষ্টিকর্তা কাছে তাৎক্ষণিক শুকরিয়া চিত্তের প্রশান্তি যোগায়।
- নিজের লোকটির সাথে প্রচণ্ড মনোমালিন্যের মুহূর্তে আগ বাড়িয়ে sorry বলায় ভালোবাসার সময়টা দীর্ঘায়ত হয়।
- পরিবারের অন্যরা আমার জন্য কি করলো না ভেবে আমি নিজের আয়ত্তাধীন কতো বেশি তাদের জন্য করতে পারি সেই চেষ্টা সম্পর্কের গভীরতা বাড়ায়।
- দূর্বলের উপকার করার আগ্রহ মনের অন্ধকার কমায়।
- অন্যের সমালোচনা না করে প্রশংসা করলে মনের গ্লানি দূর হয়।
- প্রতিটি মানুষের ইতিবাচক দিক খুঁজে বের করার চেষ্টা মানুষটির সাথে সম্পর্কের সৌন্দর্য বাড়ায়।
- নিজেকে সুন্দর রাখার এই চর্চা প্রতিনিয়ত যেমন একজনকে সুন্দর রাখবে, সেই সাথে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুন্দর থাকার শিক্ষা দিবে।
বয়সের সাথে সাথে ত্বকের সৌন্দর্য একদিন ম্লান হবে, কিন্তু নিজের সুন্দর থাকা এবং সান্নিধ্যের সকলকে সুন্দর রাখার প্রক্রিয়া দিনে দিনে তীক্ষ্ম থেকে তীক্ষ্ণতর হবে। এই সৌন্দর্য্য দেখার জন্য ঘরের আয়নায় চোখ রাখতে হবে না, ফুটে উঠবে সামনে থাকা প্রতিটি দৃষ্টিতে, সান্নিধ্যে থাকা প্রতিমুখের হাসিতে। রূপচর্চার পাশাপাশি মনের চর্চাও চলতে থাকুক একই সাথে। একজন থেকে প্রতিজন,সুন্দর থাকি সবাই মিলে।
মডেল – সামা মেহজাবিন রিনতি
লিখেছেন – ইয়াসমিন আক্তার মনি