গত কিছুদিন ধরে আমরা একটু মিড রেঞ্জ প্রোডাক্টের রিভিউ দিচ্ছিলাম। বিষয়টা যদিও ইচ্ছাকৃত নয়, কিন্তু আমাদের পাঠকদের চোখ এড়ায়নি সেটা। অনেকেই আমাদের ইনবক্সে জানিয়েছেন যে লো কস্টে স্কিন ও হেয়ার কেয়ার নিয়ে তারা আরও কনটেন্ট দেখতে চান। যাতে দেশের যেকোন প্রান্তের পাঠক সেটা ইমপ্লিমেন্ট করতে পারেন। আফটারঅল আমি নিজেও স্টুডেন্ট, এক সিজনের জন্য ৪০০০-৫০০০ টাকার কসমেটিক শপিং করা তো আমার পক্ষেও সম্ভব নয় !
তো এই ভেবেই নতুন আইডিয়া নিয়ে আজ লিখতে বসলাম। যেহেতু সামনে শীত, বডি স্কিন নিয়ে সারাবছর অসচেতন থাকলেও শীতের দিনগুলোয় একটু কেয়ার না নিলেই নয়। কিন্তু এই এক্সট্রা কেয়ারের জন্য কয়েক হাজার টাকা দিয়ে বডি অয়েল, লোশন কিনবেন বলে ভাবছেন? এতগুলো এক্সট্রা টাকা বেড়িয়ে যাবে জাস্ট ৩-৪ মাসের কেয়ারের জন্য? কিন্তু… অন্যভাবে কি বিষয়টা চিন্তা করা যায় না?
আসুন দেখি, শীতের বডি কেয়ারের পুরো শপিংটা আমরা ৫০০ টাকায় করে ফেলতে পারি কিনা!
পুরো বডি কেয়ারের বিষয়টাকে ভাগ করে ফেলি-
(১) অয়েল ম্যাসাজ
(২) বডি স্ক্রাব
(৩) বডি বাটার/ বডি লোশন
[picture]
১ম ধাপ (অয়েল ম্যাসাজ)
অনেকেই শখ করে শীতের শুরুতে একটা হাজার টাকা দামের বডি অয়েল কেনেন। তারপরে ৩-৪ দিন মাখেন। ৫ নম্বর দিনে আর মাখা হয় না… তারপর? পরের বছর সেই বোতলের ধূলা ঝাড়েন এবং ভাবেন- এখনো কি ঠিক আছে তেলটা? এত দামি, টাকাগুলো নষ্ট… মেনে নিন, টাকা আপনিই নষ্ট করেছেন। যে কাজটার রেগুলারিটি মেনটেন করতে পারবেন না কেন তার পেছনে এত খরচ?
অয়েল ম্যাসাজ কেন জরুরী?
- ব্লাড সার্কুলেশন বাড়ানো
- ত্বকের শীতে ফাটা দাগ দূর করা
- গোসলের সময় যেন ত্বকের স্বাভাবিক আদ্রতা বজায় থাকে তা নিশ্চিত করা
ডেইলি ২ ঘণ্টা ধরে ম্যাসাজ করবেন চিন্তা করলে সে হ্যাবিট কখনই সম্ভব না ধরে রাখা। কি করবেন বলে দিচ্ছি। জাস্ট নিজের ন্যাচারাল হেয়ার অয়েল টা নেবেন ২ টেবিল স্পুন তেল পুরো গায়ে মেখে ফেলবেন। ১-২ মিনিটের বেশি লাগবে না। গোসলের আগে এটা করবেন। এতে পানিতে স্কিনের ন্যাচারাল অয়েল ধুয়ে যাবে না। ত্বক ফাটবেও না। পুরো শীত চালিয়ে নিতে পারবেন। শীতের পড়ে চুলে মেখে ফেলবেন। টাকার অপচয় করবেন না।
আর হ্যা, সপ্তাহে ১-২ বার অয়েল ম্যাসাজ করলেই সেটা নরমাল স্কিনের জন্য যথেষ্ট।
খরচ কেমন পড়তে পারে? একটা ১০০ মিলি নারিকেল তেলের বোতল ৬০ টাকায় পাওয়া যায়।
২য় ধাপ (বডি স্ক্রাব)
অরগানিক, সুন্দর ঘ্রাণের লাক্সারিয়াস বডি স্ক্রাবের দাম ১৫০০ টাকা মিনিমাম। কিন্তু আপনার যদি রেগুলার বডি স্কাবিংএর হ্যাবিট না থাকে, তবে সেই, ফেলে রেখে নষ্ট করবেন! এবং বিলাস আর প্রয়োজনের মধ্যে তফাৎ করতে না পারলে টাকা জলে আপনিই ফেলবেন। জেনে নিই কেন করবেন বডি স্ক্রাব-
- মৃত কোষ দূর করার জন্য
(শীত এলেই অনেকে ‘কালো হয়ে যাচ্ছি’ এমন কথা শুরু করেন। মোস্ট অফ দা টাইম তারা স্ক্রাবিং এর ধারে কাছেই থাকেন না, এই গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হলে বডি স্ক্রাব আপনার জন্য প্রয়োজন, বিলাসিতা নয়)
- স্কিনের গ্লো বজায় রাখার জন্য
- ভিজিবল ডেড সেল, কথিত ভাষায় যাকে ‘মরা চামড়া’ ‘ফাটা চামড়া’ বলে তা কমানোর জন্য
বিঃ দ্রঃ
আপনার স্কিন শীত গ্রীষ্ম দুই সময়েই মরে, গ্রীষ্মে ঘামে তেলে একে আপনি দেখতে পান না বলে ময়লাগুলো পুষে রাখেন।
শীতে ঘাম থাকে না, তাই দেখতে পেয়ে কান্নাকাটি করার একটা প্রকোপ শুরু হয়।
কি করবেন-
বাজারে গিয়ে নিচের জিনিস গুলো কিনুন-
- একটা ৩০০ মিলি বডি লোশন, দেশের যেকোনো প্রান্তে পাবেন। দাম ২২০ টাকার মতন
- একটা এক কেজি সাদা রিফাইন্ড চিনির প্যাকেট। দাম ৬০-৬৫ টাকা। আমি ফ্রেশ অথবা তীর ইউজ করি।
খোলা চিনি কিনবেন না। খোলা চিনির দানা স্কিনের জন্য খুবি harsh । মিহি দানার চিনি দরকার বডি স্ক্রাবের জন্য –
- একটা ধুন্দল/ loofah
নিচের জিনিসটার নাম ধুন্দল। কাঁচা বাজারে এমনকি হার্ড ওয়াড়ের দোকানেও পাবেন। দাম ১ পিস ৩০ টাকা। ২ টা কিনবেন। কিনে প্রতিটি মাঝ থেকে কেটে ২ টুকরো করবেন।
- গোসলের আগে শুকনো শরীরে একটুকরো ধুন্দল দিয়ে ম্যাসাজ করুন। একে ‘ড্রাই ব্রাশিং’ বলে। এটা শরীরের রক্ত সঞ্চালন ঠিক রাখার জন্য খুবি প্রয়োজনীয়। বডির জমে থাকা টক্সিন এবং পানি বের করে দিয়ে স্বাস্থ্য ঠিক করতেও ভালো ভূমিকা রাখে। শরীর ভেজাবেন না যেন! শুকনো শরীরে হালকা হাতে ম্যাসাজ করবেন। অতি উৎসাহে ধুন্দল ঘষলে কিন্তু অ্যাকসিডেন্ট হবে। জাস্ট ১ মিনিটে পুরো শরীরে ধুন্দল বুলিয়ে নিন। সপ্তাহে ১/২ দিন এটা করুন।
বাজেট বডি স্ক্রাব
- এবার ৩০০ মিলি লোশন থেকে ১০০ মিলি অর্থাৎ তিন ভাগের একভাগ একটা জারে ঢেলে নিন। এতে ৬-৭ চামচ চিনি মেশান। আর বডি অয়েল হিসেবে যে তেলটা ইউজ করছেন তা থেকে ২ চামচ তেল এনে জারে ঢালুন। পুরো জিনিসটা ভালোভাবে মিক্স করে নিন। ব্যাস হয়ে গেল আপনার ময়েশ্চারাইজিং বডি স্ক্রাব।
বিঃ দ্রঃ
- সপ্তাহে ১ দিন সারা শরীর এই হোমমেড সুগার স্ক্রাব দিয়ে স্ক্রাব করে নিন। জাস্ট গা একটু ভিজিয়ে নিলেই চলবে। রানিং ওয়াটারের নিচে সুগার স্ক্রাব কিন্তু গলে যাবে। জারের ভেতরে পানি ফেলবেন না একই কারণে। একবার পুরো শরীর স্ক্রাব করার জন্য ১.৫-২ টেবিল চামচ স্ক্রাব দরকার হবে।
৩য় ধাপ (বডি লোশন/ বডি বাটার)
- অতিরিক্ত শুষ্ক ত্বকের জন্য (যাদের শরীর ফেটে যায় শীতে)
- বাকি ২০০ মিলি লোশন
- তাতে আর ৫ টেবিল চামচ নারিকেল তেল
- ২ চা চামচ গ্লিসারিন (১২০ গ্রাম বোতলের দাম ৯০ টাকার মত)
সবকিছু মিক্স করে আরেকটা জারে রাখুন। বোতলে রাখলে তেলটা জমে বডি বাটার বের করা কষ্টকর হয়ে পড়বে। গোসলের পড়ে শরীর একটু ভেজা থাকতে থাকতেই সারা গায়ে বডি বাটার মেখে নিন। শরীর শুকানোর অপেক্ষা করলে কিন্তু ড্রাইনেস আরও বাড়বে।
এক্সট্রা টিপ –
এই বডি বাটার রাতে হাতে পায়ে বেশি করে মেখে নিয়ে ঘুমাবেন। পরদিন সকালে খুব ভালোভাবে বডি স্ক্রাব দিয়ে স্ক্রাব করে ফেললে হাত পা পুরো শীতে আর ফাটবেই না। এটা যেকোনো স্কিনের অধিকারীরা ট্রাই করতে পারেন।
- শুষ্ক ত্বকের জন্য (যাদের স্কিন ফাটে না কিন্তু ড্রাই অ্যান্ড রাফ হয়ে যায়)-
জাস্ট বডি লোশনের সাথে তেল মিশিয়ে নিন। লোশনের ময়েশ্চারাইজিং পাওয়ার একটু boost পাবে। ড্রাই স্কিনের হাতের কাছেই লোশন তেলের মিক্সচার রাখবেন। হাত ধোয়া হলে/ পায়ে পানি লাগলে সাথে সাথে একটু মেখে নেবেন। এতে ড্রাইনেসের কারণে হাত পায়ে দাগ পড়া/ রিংকেল পড়ার হার কমে যাবে।
- নরমাল এবং অয়েলি স্কিন-
এরাই বডি ময়েশ্চারাইজিং খুবি অবহেলা করে। ফলাফল, শীতের শেষে এদের স্কিন রাফ ডাল হয়ে একাকার হয়। কিন্তু এদের কেয়ারই সবচেয়ে ইজি। গোসলের পর লোশন রেগুলার মেখে নিলেই হল! আর কিছুই কিন্তু দরকার নেই। কিন্তু এই রেগুলারিটি মেনটেন করতেই অনেক অনীহা দেখা যায়।
এবার আসুন দেখে নিই, টোটাল কত টাকার শপিং আমাদের করতে হবে এই শীত মোকাবেলা করার জন্য-
৬০ + ২২০ + ৬৫ + ৬০ + ৯০ = ৪৯৫ টাকা …!
৫ টাকা বেচে গেছে কিন্তু! শীতের কেয়ার যদি আমরা ৪ মাস ধরে করি তাহলে প্রতিদিনের গড় খরচ-
৪৯৫ টাকা / ১২২ দিন = প্রতিদিন ৪.৫ টাকা প্রায়!
খুব বেশি খরচ মনে হচ্ছে? নিজের কেয়ারের জন্য তাহলে আপনার আসলে কি দরকার? নিজের ইচ্ছা, চেষ্টা, একটু ডিসিপ্লিন?
নাকি হাজার হাজার টাকা?
অযথা টাকার অপচয় যেমন এড়িয়ে চলা উচিৎ তেমনি টাকা খরচের ভয়ে নিজের কেয়ার না নেয়ার অভ্যাসটাও কিন্তু দূর করা উচিৎ। তাই না?
তো আমরা আজকে জানলাম কীভাবে একেবারেই লো কস্টে দেশের যেকোনো প্রান্তেই আপনি নিজের সব ধরণের বডি কেয়ার নিড ফুলফিল করতে পারেন। নিজের আলস্য ধামাচাপা দেয়ার নেক্সট এক্সকিউস কি? আমাদের জানান, আমরা ইজি কন সলিউশন দেয়ার ট্রাই করব।
বিঃ দ্রঃ
১। অনেকেই বলবেন কেন বডি ওয়াশের কথা বললাম না। এখানে আলাদা করে বলার কিছু নেই। বাজারে ৯০-১০০ টাকার ভেতরে খুব মাইলড সাবান পাওয়া যায় । অথবা আপনার নরমাল সাবান যেটা অলরেডি আছে আপনার সেটাই ইউজ করতে পারেন। আর সাবান সারা বছরের জন্য এক ধরণের ইউজ করা সম্ভব যদি শীতের অন্যান্য এক্সট্রা কেয়ার আপনি করেন (যেগুলো উপরে বলা হয়েছে)। সো সাবানকে আমি আমার বাজেটে ধরছি না। যদি ধরতাম তাহলেও কিন্তু বাজেট ক্রস করতো না। তাই না?
২। লেখাটা সার্কাসটিক মনে হতে পারে। অনেকে নিজের দোষ বুঝতে পেরে রেগেও যেতে পারেন। কিন্তু ট্রাস্ট মি …… উপরের প্রতিটি কাজই আমি নিজে করেছি, এবং প্রতিটি উপায় কাজ করে!
৩। মনে করবেন না উপরের উপায়গুলো কাজ করে তার মানে দামি প্রোডাক্ট গুলো, পপুলার চলিত ভাষায় যাকে বলে ‘ভুয়া’। এটা যদি আপনার মনে হয়ে থাকে তাহলে আবারো বলব-
বিলাস আর প্রয়োজনের মধ্যে তফাৎ করতে জানতে হবে।
প্রয়োজন আগে মেটাবেন। একটা প্রপার হ্যাবিট তৈরি করবেন। তারপরে নেক্সট স্টেপে পা দেবেন। এবং বিলাস ও প্রয়োজন কে এক পাল্লায় মাপার চেষ্টা প্লিজ করবেন না।
লেখা নিয়ে গঠনমূলক সমালোচনা থাকলে অবশ্যই কমেন্টে/ ইনবক্সে আমাদের জানাবেন। ধন্যবাদ।
লিখেছেন – মীম তাবাসসুম