২০০৭ সালে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে, নিউইয়র্ক আর আশেপাশের এলাকার কিছু অংশে অভিযান চালিয়ে আমেরিকার পুলিশ প্রচুর পরিমাণে ভেজাল এবং নকল খাদ্যদ্রব্য উদ্ধার করে…! একটুও ভুল শুনছেন না, ঢাকার জিঞ্জিরার কথা বলছিনা, তথাকথিত সভ্য পশ্চিমের কথাই বলছি। শুনে আপনার শিউরে উঠবে যে, মোট উদ্ধারকৃত ভেজাল দ্রবের বাজার মূল্য আনুমানিক ৭০০,০০০ ডলার, মানে ৫০ কোটিরও বেশি টাকার প্রোডাক্ট বাজেয়াপ্ত করা হয়। জানতে চান কি ছিল সেই ভেজাল দ্রব্য? প্রায় ১০,০০০ ব্যারেলের মতো “এক্সট্রা ভার্জিন” লেবেল লাগানো অলিভ অয়েল !!
শুনে আরও অবাক হবেন যে, ভার্জিন এক্সট্রা ভার্জিন তো দূরে থাক, ব্যারেল গুলো ভর্তি ছিল পারফিউম আর কালার যুক্ত সয়াবিন এবং পাম অয়েল দিয়ে! এই অভিযানগুলোর ফলে বেরিয়ে আসে, মিলিওন ডলারের ভেজাল ‘এক্সট্রা ভার্জিন’ অলিভ অয়েল দুনিয়া জুড়ে বিক্রি করাটা মাফিয়া গোষ্ঠীর একটি লো রিস্ক সাইড বিজনেস মাত্র। হ্যাঁ, সেই একই অলিভ অয়েল যা আমরা “ইম্পোরটেড ফ্রম আমেরিকা” দেখে আহ্লাদে গদগদ হয়ে চোখ বুজে কিনে ফেলি।
উপরে কেবল খাওয়ার অলিভ অয়েল নিয়ে কথা বলেছি। গায়ে মাখার তেলে ‘এক্সট্রা ভার্জিন’ অমুক তমুক লিখে মিনারেল অয়েল যারা বিক্রি করে তাদের হিসেব আলাদা।
[picture]
আমি সব সময় এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল সালাদ, স্মুদি তে অ্যাড করি, চুল আর স্কিনের জন্যও ইউজ করি। চেষ্টা করি এসব করে ভেজাল আর কেমিক্যাল থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকতে। কিন্তু – গোঁড়ায় যখন গলদ – তখন?
আজকে আপনাদের সাথে আলাপ করার বিষয় এটাই। ‘এক্সট্রা ভার্জিন’ নামে আস্থা নিয়ে কেনা বিদেশ থেকে আমদানি হওয়া ভেজাল পণ্যের ব্যাপারে কি করা যায়? ভেজাল পণ্য চেনার কি কোন উপায় আছে? যদি থাকে বা নাই থাকে, আপনি কি করবেন?
“ভেজাল” এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল ! কীভাবে সম্ভব?
ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির এক রিসার্চে পাওয়া গেছে, বাজারের কমন ‘এক্সট্রা ভার্জিন’ অলিভ অয়েল ব্র্যান্ডের দুই তৃতীয়াংশেরও বেশি কোন না কোনভাবে তাদের প্রোডাক্টে ভেজাল রাখে! কখনো পাওয়া যায় লো কোয়ালিটি অলিভ থেকে পাওয়া তেল, যা কোনভাবেই এক্সট্রা ভার্জিন লেবেলের উপযুক্ত নয়, কখনো পুরনো নষ্ট হয়ে যাওয়া তেল, আবার সবচেয়ে খারাপ, ভেজাল মেশানো তেল- সবচেয়ে প্রচলিত ভেজাল দেয়া হয়, সয়াবিন, বাদাম তেল, পাম অয়েল আবার ফিশ অয়েল দিয়েও! এসব ভেজালের দাম আসল এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েলের ধারে কাছেও নয়, আর তাই খুব সহজে অসৎ ব্যবসায়িরা ২০০-৩০০% মুনাফা লুটছে সারা বিশ্ব থেকে।
এটা কিন্তু সত্যিই একটা বড় চিন্তার বিষয়…
কেন? কারণ শুধু আমেরিকানরা-ই সারাবছর অলিভ অয়েলের পেছনে খরচ করে প্রায় ৭০০ মিলিওন ডলার!! এর মধ্যে বেশির ভাগ ব্যক্তিগত সচেতনতা থেকে বাকিরা বিভিন্ন রোগের পথ্য হিসেবে। অনেকে নিজের শিশুর হেলদি খাবারের জন্য আসল অলিভ অয়েলের নামে টাকা দিয়ে নকল হার্মফুল তেল কিনছেন। সব মিলিয়ে অসৎ এই ব্যবসা একটা বিশাল সচেতন জনসংখ্যাকে ধীরে ধীরে ভেজাল নকল পণ্য খাইয়ে স্বাস্থ্যের ঝুঁকির ভেতরে ফেলে দিচ্ছে।
আসল এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল!
সে অত্যন্ত দামি এবং রেয়ার একটি পণ্য। কেন? কারণ একে তো ধীরে ধীরে চাষের জমি কমে যাওয়ায় অরগানিক অলিভ ফার্মের সংখ্যা কমছে, সাথে সাথে অলিভ অয়েলের গুনাগুণ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ায় এর চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। চাহিদা আর উৎপাদনের ভেতরে বিশাল ফারাক থাকায় দামও তাই বেড়েই চলেছে। এই তরল সোনা তাই আকর্ষণ করছে অসৎ মাফিয়া চক্র এবং ব্যবসায়ীদের যারা “হেলদি হতে চায়, কিন্তু আসল মাল চেনে না” এমন বিশাল একটা মার্কেট হাতের কাছেই পেয়ে গেছে।
জানেন? বলা হয় এটা পসিবল যে প্রায় অর্ধেকেরও বেশি আমেরিকান সুপারশপ ক্রেতারা জীবনে কখনো ১০০% পিওর অলিভ অয়েল টেস্ট করেনি! এতেই বোঝা যায়, সুপারশপ গুলো এইসব ভেজাল পণ্য ছড়িয়ে দেয়ায় কতো বড় পার্ট নিচ্ছে! আর বাঙালীদের কথা তো বাদই দিলাম। আমি নিজে যে জীবনে পিওর অলিভ অয়েল খাইনি সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিত! কিন্তু, ‘অলিভ অয়েল’ কিনেছি কিন্তু অনেক। বলাই বাহুল্য, এখন সবকিছু ভেবে ভালোভাবেই বুঝতে পারছি সেগুলো কোনভাবেই পিওর ছিল না।
বুঝলাম ‘সব খারাপ’ কিন্তু এখন বলুন, ‘আসল’ জিনিস পাবো কোথায়?
খুব কঠিন প্রশ্ন! তিন অন্ধ আর হাতির গল্পটা জানেন তো? ঐ যে একজন বলে হাতি দড়ির মতো অন্যজন বলে হাতি থামের মতো? যেখানে জীবনে কোনদিন আসল জিনিস চোখে দেখা বা চেখে দেখার সৌভাগ্য হয়নি সেখানে ‘আসল মাল চেনার ৫ টি উপায় নামে’ একটি ক্লিকবেইট নাম যদি আমি এই আর্টিকেলে দিয়েও দেই, সেই উপায় যে খুব কাজে আসবে না তা আমি নিজেই বুঝতে পারছি।
অনেক বিশেষজ্ঞ শেফ, যারা নিজেদের কুকিং সাপ্লাই ব্র্যান্ড চালান, তারাও চোখ বাঁধা অবস্থায় নিজের ব্র্যান্ডের ‘এক্সট্রা ভার্জিন’ অলিভ অয়েল কে ‘জঘন্য’ ‘খাওয়ার অযোগ্য’ বলে ঘোষণা দেন এমনটাও শোনা গেছে। তো পুরো বিষয়টা যখন এতটাই ধোঁয়াটে, তখন কিভাবে চিনব আমরা আসল প্রোডাক্ট?
আমি নিজে আজকাল যে মেথড গুলো ফলো করি সেগুলোই নিচে জানাচ্ছি-
(১) ঘনত্ব
আসল এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েলে ম্যাক্সিমাম মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকায় এর ঘনত্ব অন্য যেকোনো ভেজিটেবল অয়েল বা রিফাইনড অয়েলের চেয়ে বেশি হয়। একই কারণে, ফ্রিজে রাখা হলে এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল স্বাভাবিকের চেয়েও বেশি ঘন হয়ে যায়। তাই, ফ্রিজের নিম্ন তাপমাত্রায় তেলের ঘনত্ব চেঞ্জ হচ্ছে কিনা সেটা দেখে রিফাইনড তেল আর আসল অরগানিক এক্সট্রা ভার্জিন তেলের ভেতরে তফাৎ বের করা গেলেও যেতে পারে।
(২) মেয়াদ
এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েলের সেলফ লাইফ ২ বছর। সৎ উৎপাদনকারী তেল উৎপাদনের ১৮ মাসের ভেতরে সেটা ব্যবহার করে ফেলতে বলবেন এবং এটা বোতলে লিখেও দেবেন। তাই ৩ বছর ৪ বছর মেয়াদ লেখা বোতল মার্কেটে নজরে পড়লে সেটা এড়িয়ে গেলেই ভালো করবেন।
(৩) দাম
আগেই জানিয়েছি এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েলের প্রোডাকশন কস্ট-ই আকাশচুম্বি। খুব কথা না বাড়িয়ে বলতে চাইলে বলা যায় আধা লিটার এক লিটার এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল ৫০০-১০০০ টাকায় বিক্রি করা সম্ভব নয়। এছাড়া আছে স্কিন ক্যাফে-এর ১০০% ভার্জিন অলিভ অয়েল যা আপনি পাবেন যমুনা ফিউচার পার্ক ও সীমান্ত স্কয়ার-এ অবস্থিত শপ.সাজগোজ.কম-এর ফিজিকাল শপ-এ এবং তাদের অনলাইন-এও সরাসরি অর্ডার করতে পারবেন। দাম ৮৫০/- টাকা যেটায় ১৫% ডিস্কাউন্ট চলছে।
(৪) সিল চেক করুন
ইউরোপ থেকে আমদানি হওয়া এক্সট্রা ভার্জিন তেলে D.O.P এবং আমেরিকা থেকে আমদানি হওয়া অরিজিনাল প্রোডাক্টে C.O.O.C সিল থাকবে।
(৫) বোতল চেক করুন
এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল সবসময় ডার্ক মোটা কাঁচের বোতলে স্টোর করা হয় এবং সূর্যালোক থেকে দূরে রাখা হয়। সো এডিবল এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল কখনোই স্বচ্ছ / প্লাস্টিক / মেটাল পাত্রে করে সেল করা হবে না।
জানি উপায়গুলো খুবি ধোঁয়াটে, কিন্তু আমরা যারা আসল প্রোডাক্ট কোনদিন দেখেছি কিনা তাই নিয়েই সন্দেহ আছে তাদের পক্ষে সাবধান থাকতে চাইলে এভাবেই শুরু করতে হবে। যাই হোক, অনেক লম্বা হয়ে গেল লেখাটা। প্রোডাক্ট চেনার নতুন কোন পদ্ধতি জানতে পারলে অবশ্যই আবার লিখব। ততদিন পর্যন্ত ভালো থাকুন।