আমার খুব কাছের একজন বান্ধবী গত মাসে মারা গিয়েছে, স্বাভাবিক নিয়মে নয়, সুইসাইড করে, আড়াই বছরের ফুটফুটে একটা মেয়েকে পেছনে ফেলে রেখে গিয়েছে। আগেরদিন সন্ধ্যায় ও ওর মেয়েটার ছবি ফেসবুকে, ইনস্টাগ্রামে আপলোড করেছে। আমি সেগুলোতে লাইক দিয়েছি, কমেন্ট করেছি। ওর সাথে মেসেঞ্জারেও কথা হয়েছে। তখনো পর্যন্ত আমি জানতাম না যে পরদিন সকালে বাথরুমের ভেন্টিলেটরের সাথে ফাঁসি দেয়া অবস্থায় ওর লাশ পাওয়া যাবে। আমরা যারা ওর কাছের বন্ধু ছিলাম আমরা সবাই মোটামুটি ধারণা করে নিলাম, নিশ্চয়ই ওর বরের বাইরে কোথাও অ্যাফেয়ার ছিল, আর নাহলে শ্বশুরবাড়ির মানুষজন টর্চার করতো, নাহলে অমন হাসিখুশি মেয়ে ছিল নামিরা, ও তো সুইসাইড করার কথাই না। সন্ধ্যায় নামিরার মা জানালেন, উনার মেয়ে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ছিল, এমনকি আগেও কয়েকবার সুইসাইডের অ্যাটেম্পট নিয়েছে, একবার মেয়েকে কোলে নিয়ে ছাদ থেকে লাফ দেয়ার ও চেষ্টা করেছিল।
[picture]
এ ঘটনাটা আমার জন্য বিশাল একটা ধাক্কা ছিল। আমি পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন নিয়ে লিখি। নিজেকে নিঃশর্তভাবে ভালোবাসাটা যে কতটা জরুরী সেটা নিয়ে লিখি। আর আমারই কাছের একজন বান্ধবী যার সাথে আমার প্রায় নিয়মিতই কথা হতো, আমি ঘুণাক্ষরেও কখনো ওর সাথে মেসেঞ্জারে চ্যাটিং করে, আর সোশ্যাল মিডিয়ায় ওর নিজের পরিবারের সাথে হাসিমুখের ছবি দেখে টের পাইনি যে সে পোস্টপার্টাম পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনে আক্রান্ত। আমি ধাক্কা খেয়েছি, আমি সত্যিই বিশাল বড় ধাক্কা খেয়েছি।
সন্তান জন্মদানের পর বিষণ্ণতাকে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন বলা হয়ে থাকে। অকারণেই মন খারাপ লাগা, নিজেকে মা হিসেবে ব্যর্থ ভাবা, বাচ্চার যত্ন নিয়ে অতিরিক্ত আগ্রহ বা অতিরিক্ত অনীহা, সবসময় ক্লান্ত অনুভব করা, অতিরিক্ত খাওয়াদাওয়া করা বা একেবারেই ক্ষুধা নষ্ট হয়ে যাওয়া, বেঁচে থাকাকে অর্থহীন মনে করা, সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা, অকারণেই অপরাধবোধে ভোগা, অকারণে কান্না পাওয়া, অকারণে রেগে যাওয়া, ফিজিক্যাল ইন্টিমেসিতে অনাগ্রহ – এরকম অনেক ধরণের লক্ষণ দেখা যায়। একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম সিম্পটম দেখা দেয়। সাধারণত বাচ্চার জন্মের কয়েক সপ্তাহের ভেতরেই এটা ঠিক হয়ে যায়, কিন্তু ইদানীং অধিকাংশ মেয়েদের ক্ষেত্রেই এটা দীর্ঘমেয়াদী হয়ে যায়।
প্রেগন্যান্সির কারণে অনেকের পড়াশোনায় গ্যাপ আসে, অনেকের ক্যারিয়ারে। ওজন বেড়ে যাওয়া, ঘুমের অভাব, হরমোনাল ইমব্যালেন্স, নিজের জন্য সময় বের করতে না পারা, অনেকের কোন সাহায্যকারী না থাকায় মাল্টিটাস্কিং এর প্রেশার বেড়ে যাওয়া, আশেপাশের মানুষের খোঁচা দেয়া কথা, সব মিলিয়ে সদ্য মা হওয়া মেয়েটা এমনিতেই নাজেহাল অবস্থায় থাকে। সবাই ঘুরেফিরে তাকে বারবার মনে করিয়ে দেয়, সে এখন আগে একজন “মা”, পরে একজন “মানুষ”। বাচ্চার সমস্ত দায়দায়িত্ব তাকে একাই নিতে হবে, কারণ মা হওয়া মানেই ত্যাগের প্রতিচ্ছবি। আসলেই কি তাই?
এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে আমরা সন্তান হবার পর সন্তানের সাথে কাটানো সুন্দর মুহূর্তগুলোর ছবি ঠিকই শেয়ার করি, কিন্তু নিজে যে ডিপ্রেশনে আক্রান্ত সেটা খুব কাছের মানুষদের ও জানতে দেই না। ফ্রেন্ডলিস্টে বন্ধুর সংখ্যা ঠিকই হাজার ছাড়িয়ে যায়, কিন্তু মনের খবর কাউকেই জানানো যায় না। কিন্তু এমনটা কি হওয়া উচিৎ?
কিছুদিন আগেও দেখলাম ফেসবুকে মা দের একটা গ্রুপে একজন পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন এবং ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হয়ে সুইসাইড করাকে খুব সুন্দর করে ধুয়ে দিয়েছেন, নেগেটিভ ভাবে, যে ডিপ্রেশন হলো বিলাসিতা। মানুষ শুধু হাত পা ভেঙে বিছানায় পড়লেই কি সেটাই অসুস্থতা? মানসিক সুস্থতা যে কতটা জরুরী এটা এখনো আমাদের দেশে, ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্টের মানুষগুলো জানতে চায় না, যারা কিঞ্চিৎ জানে তারাও সহজে মানতে চায় না।
পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনে সাধারণত দুরকমের ট্রিটমেন্ট দেয়া হয়ে থাকে, অ্যান্টিডিপ্রেস্যান্ট মেডিসিন (যেটা ব্রেস্টফীডিং এর সময়েও খাওয়া যায়), আর কাউন্সেলিং বা টক থেরাপি। অ্যান্টিডিপ্রেস্যান্ট মেডিসিনের মধ্যে সিলেক্টিভ সেরেটোনিন রিআপটেক ইনহিবিটরস হচ্ছে নিরাপদ অপশন, যেটা প্রায়ই ব্রেস্টফীডিং মায়েদেরকে প্রেসক্রাইব করা হয়ে থাকে। আর আপনার ডাক্তার অবশ্যই আপনার চেয়ে বেশি জানেন, কাজেই ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলুন। সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাওয়াটাকেও আমাদের দেশে বিলাসিতা আর পাগলামি ধরা হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে একজন মানুষ জানে যে তার চিকিৎসার প্রয়োজন, কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে সাইকিয়াট্রিস্টের শরণাপন্ন হতে চায় না। ফলে ছোট সমস্যাই একটা সময় বড় আকার ধারণ করে।
নিজেকে ভালোবাসুন। প্লিজ নিজেকে নিঃশর্তভাবে ভালোবাসুন। আপনি একজন মা, কিন্তু সেইসাথে আপনি একজন মানুষ ও। আপনার পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন থেকে বের হয়ে আসার জন্য অন্যদের সহযোগিতা জরুরী, আপনার নিজেকে নিজের সহযোগিতা করাটাও কিন্তু জরুরী। নিজের প্রতি ভয়াবহ মাত্রায় এক্সপেকটেশন রাখবেন না। আপনিও একজন মানুষ, ভুলত্রুটি মানুষের দ্বারাই হয়। মা হওয়া একটা গ্র্যাজুয়াল প্রসেস, এটা কেউ কাউকে শেখাতে পারে না, সবাই ভুল করতে করতেই শেখে। নিজের যা কিছু পছন্দ তাই করুন, বন্ধুদের সাথে মন খুলে আড্ডা দিন, ছবি তুলুন, আঁকুন, গান শুনুন, গুনগুনিয়ে নিজেও গেয়ে ফেলুন, বেড়াতে যান, সাজগোজ করুন। আপনার মন ভালো থাকলে আপনার সন্তান ও ভালো থাকবে, আপনার চারপাশের সবাই ভালো থাকবে।
লিখেছেন – ফারহানা প্রীতি