আমাদের সমাজ এখনও এমন একটা জায়গায় আছে যেখানে ‘চিকন’, ‘পাতলা’, ‘শুকনো’– এসব শব্দ দিয়েই দৈহিক সৌন্দর্য বোঝানো হয়। একটা নির্দিষ্ট ‘সাইজ’ এর থেকে একটু হেভি বা একটু লাইট হলেই আর দেখতে হবে না… এরা কেউই ‘সুন্দর’ না। সমাজের চোখে সুন্দর হওয়ার ধাক্কায় ‘সুস্বাস্থ্য’ শব্দটার কথাতো কোনভাবেই মনে পড়ার কথা নয়, তাই না? মেয়েরা ফিট থাকতে জিম করতে গেলে একটি ডিসিশন নিতে এমন কত কথায় না তার মাথায় চলে আসে!
এছাড়া আরেকটা প্রবলেম হচ্ছে সুস্থ লাইফস্টাইল, এক্সারসাইজ নিয়ে আমাদের ভেতরে প্রচলিত অদ্ভুত কিছু মিথ। যেমন- মেয়েরা ফিট থাকতে জিম করে না, জিম করে ছেড়ে দিলে আগের থেকেও মোটা (!) হয়ে যায়, জিম করলে ফিগার ছেলেদের মতো হয়ে যায়… ইত্যাদি ইত্যাদি। মাঝে মাঝেই এসব টপিক নিয়ে এতো উৎসাহ নিয়ে একেকজন ভুল ধারণা ছড়িয়ে বেড়ান! অবাক হয়ে যাই!! কোথা থেকে শুরু হয় এসব আজগুবি গল্প? আর কেনই বা শিক্ষিত স্মার্ট মেয়েরা অত্যাধুনিক স্মার্টফোন টিপে টিপে এসব ইডিয়টিক কনসেপ্ট ছড়িয়ে বেড়ায়? প্রবলেম-টা কোথায়?
এমনি একটা আজগুবি গল্প নিয়ে আজকের লেখা। জিম করলেই নাকি বাংলাদেশি মেয়েদের মাসল হয়ে যায়! তাই কি? একটু ডিটেইল-এ যাই।
মেয়েরা ফিট থাকতে জিম করতে গেলে যেসব কথা বলতে হয়
সুন্দরের কনসেপ্ট-এ যাচ্ছি না। আপনি নিজেকে নিয়ে হ্যাপি, কনফিডেন্ট থাকলেই আপনি সুন্দর। কে কী দেখে সুন্দর বলে সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর আপনার দরকার নেই। আমরা কথা বলবো সুস্বাস্থ্যের বেসিস-এ। আপনাদের কী মনে হয়? চিকন বা শুকনো হতে পারলেই আপনি সুস্থ? আর যারা লম্বা-চওড়া, বা লার্জ সাইজের কামিজ পরে তারা সবাই অসুস্থ? এমন ধারণা যদি আপনার থাকে তবে আজ একটা নতুন অস্বাস্থ্যকর বডি টাইপ-এর কথা জানবেন। সেটা হচ্ছে- স্কিনি ফ্যাট।
স্কিনি ফ্যাট আবার কী?
একজন খুব মাস্কুলার শক্তিশালী টপ ফিমেল অ্যাথলেট-এর শরীরের মোট ওজনের ১৫%-২০% হয় ফ্যাট ।
রেগ্যুলার এক্সারসাইজ করেন এমন একজন নারীর মোট ফ্যাট পারসেনটেজ ২১%-২৪%।
মোটামুটি একসেপ্টেবল ফ্যাট পারসেনটেজ ২৫%-৩২%।
আর একেবারেই আনহেলদি ফ্যাট পারসেনটেজ ৩৩% বা এরও উপরে।
উপরের হিসাবে কোথাও কি ওজনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে? না। আসলে একজন মানুষের ওজন যাই হোক, তার বডির ফ্যাট আর মাসল-এর পারসেনটেজ-এর উপরেও তার সুস্থতা নির্ভর করে।
আসুন এখন আরেকটা কেইস দেখি। ধরা যাক একজন ৫ ফুট ২ ইঞ্চি লম্বা নারীর মোট ওজন ৫০ কেজি। কি, বেশ নরমাল ওজন, না? কিন্তু তার দেহের মোট ফ্যাট পারসেনটেজ ৩৩% এর বেশি। তো? উপরের হিসাব অনুযায়ী আমরা তাকে কি ফিট বলতে পারি?
না, এই নারী হচ্ছেন ফ্যাট। শুকনো বা ‘স্কিনি’ হয়েও ‘ফ্যাট’, যাকে বলে স্কিনি ফ্যাট।
দেখতে চিকন পাতলা হতে পারলেই যে আপনি ‘ফিট’ এরকম কিন্তু কোন রুল নেই। বরং ক্রাশ ডায়েট করে করে ম্যালনিউট্রিশন-এ দেহের মাসল একেবারে ধ্বংস করে ফ্যাট পারসেনটেজ বাড়িয়ে ফেলে চরম অস্বাস্থ্যকর একটা পর্যায়ে চলে গেছেন এমন উদাহরণ ভুরি ভুরি।
‘মাসল হওয়া’- কথাটার মানে কী?
না, নতুন করে আপনার শরীরে মাসল গজাবে না। সব পূর্ণাঙ্গ মানুষ সমান সংখ্যক মাসল নিয়েই পৃথিবীতে আসেন। মাসল-এর উপরে ফ্যাট-এর একটা লেয়ার থাকে তার উপরে আপনার চামড়া বসানো থাকে। পারফেক্ট ডিজাইন! যেকোনো সাধারণ বিজ্ঞান বইতে এটা লেখা আছে। ভুলে গিয়ে থাকলে রিভিশন দিন। ‘মাসল হওয়া’ বলতে টেকনিক্যালি কিছুই নেই।
কিন্তু সালমান খান, বিপাশা বসুর মতো আপনার মাসল দেখা যাচ্ছে না কেন?
মাসল দেখা যাচ্ছে না, এটা আমাদের সমাজে ছেলেদের জন্য ভীষণ দুঃখ আর মেয়েদের জন্য বিশাল আনন্দের ব্যাপার… অনেকেতো আবার অসাধারণ নিয়মানুবর্তী, শক্তিশালী এবং ফিট এসব নারীদের দেখে মুখ টিপে এক ফাঁকে একটু হেসে নেন আর বলেন-
“ছি! মেয়েদের ফিগার এমন কি ভালো দেখায়?”
আপা, প্লিজ!! পিছলে হাসি পরে! আগে বেসিক জানুন। ধরা যাক, যেকোনো নধর বাঙালী আধুনিক নারী বা পুরুষ। যার ‘মাসল নেই’, কেন? আপনাদের মাসল-এর লেয়ার-এর উপরে ফ্যাট লেয়ার-এর পুরুত্ব এতটাই যে বাইরে থেকে ফ্যাট-এর নিচে কি আছে বা নেই কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। ফ্যাট পারসেনটেজ একসেপ্টেবল যাদের, তাদের ক্ষেত্রে এটা হতে পারে। ‘ফিট’ নয় এমন নারীতো বটেই পুরুষের জন্যও একটু মাসল ডেফিনিশন পাওয়া প্রায় ইম্পসিবল। আর আনহেলদি পরিমাণে ফ্যাট থাকলে তো প্রশ্নই আসে না। তাই ‘মাসল বানাতে’ হলে আপনাকে ফ্যাট পারসেনটেজ সিগনিফিকেন্ট হারে কমাতে হবে একই সাথে মাসল-গুলোকে প্রেসার দিয়ে এক্সারসাইজ করিয়ে এমন একটা সাইজ দিতে হবে যা বাইরে থেকে বোঝা যায়।
তো? আমি যদি এখন একদম স্মুথ লবঙ্গলতিকা ফিগার চাই, আমি তো তাহলে মাসল বাড়াব না, ঠিক?
-ভুল। জেনে নেই, কেন আপনি একটা হেলদি ফ্যাট আর মাসলের রেশিও পেতে কাজ করবেন?
মেয়েরা ফিট থাকতে জিম করতে যাবার আগে জানুন
১. বডির শেইপ ঠিক রাখতে
দুর্বল মাসলের অধিকারিদের দেহে একটা থলথলে ভাব লেগেই থাকে। একারণে পাতলা হয়ে গেলেও ঝুলে যাওয়া পেটের সমস্যা, বয়সের সাথে সাথে শরীরের শেইপ নষ্ট হয়ে যাওয়া আর সিজার বা এধরনের কিছু হলেতো কথাই নেই। টানটান ফিগারকে বাই বাই জানিয়ে দিন। ফিট মাসলে কখনোই এসব প্রবলেম হয় না।
২. এক কেজি ফ্যাট, এক কেজি মাসল-এর চেয়ে বেশি জায়গা নেয়
এই কারণে একই ওজনের দুজন মানুষের একজন সাইজ ৩৪, আরেকজনের সাইজ ৪০ দরকার হয়। অস্বাস্থ্যকর ফ্যাট দূর করে সেখানে মাসল তৈরি করে আপনি আপনার বডিকে আগের থেকে স্লিম বানাতে সক্ষম হবেন।
৩. মাসল ফ্যাট-এর চেয়ে বেশি ক্যালরি বার্ন করে
এজন্য লং টার্ম ফিটনেস এবং ওজন মেইনটেইন করতে আপনার সুবিধা হবে। যদি আপনি প্রয়োজনের চেয়ে বেশি মাসল ধ্বংস করে ফেলেন তবে আপনার দেহের মেটাবলিজম কমে যাবে। তখন যতই কম খান না কেন ওজন আর কমবে না। এই কারণে অনেকের ওজন একটা জায়গায় এসে থেমে যায়। আর কমতে চায় না।
উপরের কোন সমস্যা কি আপনার আছে? ভাবুন, যদি থেকে থাকে তবে আপনাকে অবশ্যই ফ্যাট কমানোর জন্য আত্মহারা না হয়ে ফিট মাসল মাস তৈরি করতেও কাজ করতে হবে। কি করবেন? প্রোপার ইয়োগা , অ্যারোবিক অথবা জিম-এর ওয়েট লিফটিং বা স্ট্রেন্থ ট্রেনিং… সাথে সাথে দেহের মাসলের ক্ষয় পূরণ করে নতুন মাসল ফাইবার তৈরি করার জন্য প্রতিদিন ২-৩ সারভিং লিন প্রোটিন খেতে হবে।
কিন্তু ? যদি ছেলেদের মতো দেখায় তখন?
– না, দেখাবে না। সপ্তাহে ৩ দিন ৩০ মিনিট ২ কেজি ওজনের ডামবেল নিয়ে এক্সারসাইজ বা কয়েকটা ওয়েট লিফট করলেই আপনি ‘ছেলেদের মাসল’ – পেয়ে যাবেন না।
কারণ- পুরুষের দেহে প্রচুর পরিমাণে মাসল মাস তৈরি করার কাজটা করে টেসটস্টেরন। নারী দেহে এর দেখা পাওয়া ভার। সপ্তাহে ৩ বার ৩০ মিনিটের জিমে সেই পুরুষের পক্ষেও সিক্স প্যাক মাসল বানানো অসম্ভব। তাই “মাসল বানাতে’ হলে যে পরিমাণ ফিটনেস ট্রেনিং এর দরকার হয় তার ১০০ ভাগের এক ভাগও আপনি করছেন না।
কিন্তু, ‘মাসল হয়ে যাওয়ার ভয়ে’ জিম এক্সারসাইজ-এর মতো অত্যন্ত হেলদি একটা লাইফস্টাইল-কে এড়িয়ে চলে আপনি নিজের ক্ষতিই করছেন।
তো, হেলদি থাকুন… শুঁকনো হয়ে গেছেন বলেই খুব জিতে গেছেন এমনটা ভাববেন না। আপনি ফিট কিনা সেটা দেখুন। দরকারের থেকে বেশি বা কম মাসল কোনটাই ভালো নয়। দরকারি রেশিও-তে মাসল আর ফ্যাট রাখুন। দেখবেন শরীরে শক্তি থাকবে, ফিগারও সুন্দর থাকবে লম্বা সময় পর্যন্ত। না খেয়ে থেকে ফ্যাট কমাচ্ছেন নাকি মাসল ধ্বংস করছেন সেটা সময় পেলে একটু ঠিকভাবে ভাবুন। আর জিমে যেতে চাইলে চলে যান… দরকারি এক্সারসাইজ করুন। অযথা আজেবাজে গুজবে কান দেবার দরকার নেই।
**বেশ অগোছালো লেখা… আসলে সেলফ কেয়ার-এর খুব নতুন একটা প্রশ্নের উত্তরে এমন অনেকগুলো কনসেপ্ট চলে এলো যা সহজ ভাষায় একটা আর্টিকেলে লেখা অসম্ভব। যারা ফিটনেস নিয়ে একটু হলেও আগ্রহী, তাদের অল্প সাহায্য আজ হলেও যথেষ্ট। কোন অংশ ধোঁয়াটে লাগলে জানাবেন। হেলথ আর এক্সারসাইজ নিয়ে প্রচলিত মিথ-গুলো নিয়ে ভবিষ্যতে আরও লেখার ইচ্ছা আছে, তার পাশাপাশি এই কনসেপ্ট-গুলোও আলোচনা করব আশা করি। স্বল্প পরিসরে আজকের লেখা এলোমেলো লেগে থাকলে ক্ষমাপ্রার্থী।
ছবি – সাটারস্টক