রিয়া চাকরি করছেন একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। দশটা থেকে পাঁচটার নিয়মবদ্ধ অফিস জীবন। কোনো দিন একটু দেরিও হয় ফিরতে, কাজের চাপ বেশি থাকলে। ঘরে অশান্তির শেষ নেই। বৌ মানুষ কেন বাইরের কাজে সময় দেবে? চাকরি কি আর কেউ করে না নাকি! রিয়ার কী এমন কাজ যে সকাল সকাল ঘরটাও ভালো মতন না গুছিয়ে অফিস ছুটতে হয়? আর ফিরতেও তো সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয় প্রায়ই। রিয়া অফিসের কাজ সামলে তার ফাঁকেই ভাবে, আজকে ঘরে ফিরে নতুন কোন কথাটা শোনা লাগবে। বুকচাপা দীর্ঘশ্বাসটা মুক্তি পায় কখনো, কখনো বা তাও না। কর্মজীবী নারীর করণীয় নিয়ে অজানা থাকার কারণে এই সমস্যা হয়ে থাকে।
আফসানা নিজের একটা বুটিক হাউজ পরিচালনা করছেন। বাহারি কাপড়ের পসরা সাজানো দোকান তার। অনলাইন সার্ভিস-ও দেন আফসানা তার দোকান থেকে। এই কাজটা নিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় কাটে আফসানার। ভাগ্যিস, গোটা পরিবার ভীষণ সাহায্য করে তাকে! শ্বাশুড়ি মায়ের তুলনা নেই, নিজের মায়ের মতোই উনি। আফসানার কাজের নিয়মিত খবর রাখা থেকে শুরু করে ঘরের কাজ সামলে নিয়ে আফসানাকে তার ব্যবসার জন্য যথেষ্ট সময় দেয়া, সবটাই মায়ের জাদু। কাজের হাজার চাপ থাকা সত্ত্বেও আফসানা মানসিকভাবে ফুরফুরে থাকেন। এতো স্বস্তির জীবন কয়টা মেয়ের হয়? কিন্তু সবসময়ই তা হয় না। তাই আজকে আমরা আলোচনা করবো কর্মজীবী নারীর করণীয় সম্পর্কে। চলুন জেনে নেই কর্মজীবী নারীর করণীয় সম্পর্কে এবং ঘরে-বাইরে কাজের ভারসাম্য আনার কার্যকরী উপায় সম্পর্কে।
কর্মজীবী নারীর করণীয়
১) কর্মজীবনে নারী
কর্মজীবনে নারীরা হতাশায় ভোগেন, তার বড় একটা কারণ হচ্ছে পরিবারের অসহযোগিতা। ফলাফল, হয় ব্যক্তিগত জীবনে টানা অশান্তি, নয় শেষমেশ কাজটাই ছেড়ে দেয়া! ভাবুনতো, একজন পুরুষকে তো তার বাইরের কাজের জন্য এত ভেবেচিন্তে পা ফেলা লাগে না, তবে একজন নারীকে কেন ভাবতে হবে প্রতি পদে? অথচ, চাইলেই পরিবার সবচেয়ে বড় সমর্থন হয়ে উঠতে পারে মেয়েদের কাজের ক্ষেত্রে। বিষয়টা খুব কি কঠিন?
২) সাংসারিক কাজে ভূমিকা
একজন নারী যদি স্বভাবতই সাংসারিক হয়ে থাকেন, বাইরের কাজ সামলেও সংসারের খুঁটিনাটি কাজে তার অংশগ্রহণ থাকবে। এটা যেমন তাকে বলে দিতে হবে না, তেমনি নারী যদি সংসারের কাজে শুরু থেকেই অনাগ্রহী হয়ে থাকেন, তবে তাকে জোর করে এসব কাজে যুক্ত করা বাড়ির লোকের কর্ম নয়! তাছাড়া, একজন নারী যদি উপার্জনক্ষম হন এবং ঘর সামলানোর জন্য সাহায্যকারী হিসেবে মানুষ রাখেন, এবং তার সাহায্যেই সংসার পরিচালনা করেন, তবে সেই সিদ্ধান্তকে সম্মান দেখানো খুব অসুবিধার হয় কি?
৩) বাইরের কাজ নিয়ে পরিবারের অমত
অনেক সময় পরিবারের মেয়ের বাইরে কাজ করা নিয়েও বাকি সদস্যরা অসন্তুষ্ট থাকে। নিরাপত্তাহীনতার ভয় থেকে মেয়ের কাজকে অপ্রয়োজনীয় ভাবা, সব রকম চিন্তাই এর জন্য দায়ী। বাবা কিংবা ভাইদের যথেষ্ট টাকা আছে, মেয়ে ঘরে বসে রাজকন্যা হয়ে থাকবে আর বিয়ের পর রাজরানী হয়ে সংসার করবে, এটা অনেক পরিবারেরই চাওয়া। আবার, কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষ একসাথে কাজ করার বিষয়টা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, সেই কারণেও ঘরের মেয়ে-বৌকে বাইরে কাজে যেতে দিতে অনীহা দেখা যায়।
৪) কাজের ব্যাপারে পরিবারকে জানানো ভালো
কর্মজীবী নারী তার কাজের ধরণ নিয়ে পরিবারে খোলাখুলি কথা বলে রাখতে পারেন। যেমন, নির্ধারিত সময়ের বাইরেও যদি কখনো সখনো বাড়তি সময় থাকা লাগে অফিসে, সেটা আগেভাগেই ঘরে বলে দেয়া ভালো। এমনটা যদি প্রায়ই হয় সেক্ষেত্রে পরিবারের কাছে এই বিষয়টা অদ্ভুত হবে না তখন। তাদের যদি দেরি করে ঘরে ফেরা নিয়ে আপত্তি থাকে, আর ঐ নারী নিজেও চাকরি নিয়ে খুশি না থাকেন, তবে চাকরি ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়াই ভালো। আর যদি নারী নিজে এমন কর্মক্ষেত্র নিয়ে খুশি থাকেন, তাহলে পরিবারের সদস্যদের সাথে অনবরত মতবিরোধ হবার সম্ভাবনা নিয়েই কাজ করে যেতে হবে।
৫) চাকরিজীবী মায়ের করণীয়
মা অফিস কিংবা ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকলে বাচ্চাদের ছোটবেলা থেকেই স্বনির্ভর হতে শেখানো উচিত। গৃহিণী একজন মা যেমন গোটা দিন সংসার ও সন্তানের পরিচর্যায় কাটাতে পারেন, একজন কর্মজীবী মা সেটা পারেন না। এই বিষয়টার সাথে বাচ্চাদের অল্প বয়সেই অভ্যস্ত করে নেয়া বুদ্ধিমানের কাজ। স্বনির্ভর হবার অর্থ এই নয় যে প্রতিটা কাজই বাচ্চারা নিজের হাতে করবে, কিন্তু বেশিরভাগ কাজ নিজে করতে পারার মত শিক্ষা তাদের দিতে হবে। সকালে মুখহাত ধুয়ে নাস্তার টেবিলে আসার অভ্যাসটা তাদের নিজেদের হোক। স্কুলের ব্যাগটা মা এক ফাঁকে গুছিয়ে দিলেন। মাকেও অফিসের জন্য বের হতে হবে, স্কুলের মতো অফিসে যাবারও নির্দিষ্ট সময় থাকে, দেরি হলে অফিসেও বকুনি শোনা লাগতে পারে বা কাজের ক্ষতি হতে পারে, সহজ কথায় এই জিনিসগুলো বাচ্চাদের বোঝানো উচিত।
৬) ঘরের কাজ করবে সবাই
গৃহস্থালির দায়িত্ব পরিবারের সদস্যরা ভাগাভাগি করে নিলে সংসারের অর্ধেক অশান্তি এমনিই কমে যায়। সব কাজ একজনের নয়, সে যদি পুরোদস্তুর ঘরে থাকা মানুষ হয়, তবুও না। আর বাইরের কাজ সামলে একজন মেয়ে ঘরের বেশিরভাগ কাজ করবে, এমনটা ভাবা অন্যায় বটে। বিবাহিত মেয়েদের বেলা স্বামীর সমর্থন এই ক্ষেত্রে খুবই জরুরি। কাঁটায় কাঁটায় সমান সমান কাজ না হোক, কাজের পাল্লা যেন স্ত্রীর দিকে সত্তুর/আশি ভাগ না পড়ে সেটা নিশ্চিত করা চাই। মিলেমিশে কাজ বলতে স্ত্রীকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ানো বোঝায় না। স্ত্রী যখন রান্নাঘরে খুন্তি নাড়ছে, তখন সবজিটা কেটে দেয়া, ভাত হয়ে গেলে মাড় ঝরিয়ে দেয়া, এটুকুই কিন্তু কাজে অংশগ্রহণ হয়। স্বামীকে অবশ্যই সংসারে এই মাত্রার দায়িত্ববান হতে হবে যাতে স্ত্রীর কর্মজীবন নির্বিঘ্ন হতে পারে। দিনভর অফিসে খেটে এসে ঘরের কাজে টানা লেগে থাকা, শারীরিক আর মানসিক উভয় বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।
ছবি- সংগৃহীত: সাটারস্টক