আমার নানী বেঁচে থাকতে তার মুখেই শুনেছি, তিনি নাকি চুল পরিষ্কার করতেন চালতার থকথকে শ্বাস, রিঠা ভেজানো পানি দিয়ে। আমার নানী, মা-খালাদের আলহামদুলিল্লাহ বেশ লম্বা,ঘন চুলই দেখেছি আমি। আমিও সেই ধারাও পেয়েছিলাম। কিন্তু ধরে রাখতে পারি নি। সেটা কিছুটা আমার দোষে (কারণ, চুল নিয়ে বহুত এক্সপেরিমেন্ট করেছি), আরও রয়েছে আজকালকার পরিবেশের দূষণ, ভেজাল খাবার, স্ট্রেইস ইত্যাদি কারণে।
আমি জানি, আমার গল্পটা অনেকের সাথেই মিলবে। অনেকেরই অনেক ঘন চুল ছিল এক সময়ে এখন নেই। আর চুলের সমস্যার তো শেষই নেই। চলতি সময়ের হেয়ার কেয়ার প্রোডাক্ট ব্যবহার করে যখন আমি ক্লান্ত, তখন দিনশেষে ফিরে যাই ট্রেডিশনাল মেথড-গুলোই ফলো করতে। কারণ, ৩০-৪০ বছর আগের মহিলারা এগুলোই ফলো করে তাদের চুলের সৌন্দর্য বজায় রাখতেন। চলুন, আপনাদেরও জানিয়ে দেই সে সকল পদ্ধতি, যার ফলে আপনার চুল বিভিন্ন সমস্যা থেকে মুক্তি পাবে এবং স্ট্রং হয়ে উঠবে।
[picture]
১. আমার নানুবাড়িতে আমি দেখতাম, নারিকেল কুড়িয়ে সেগুলো জ্বাল দিয়ে তেল বানানো হত। সেটাই ব্যবহার করতেন তারা। হ্যা, বলছি হেয়ার অয়েলিং-এর কথা। আপনি যদি একদমই হেয়ার কেয়ার-এ খুবই অলস হন অথবা সময় না পান, তবুও আপনাকে বলব, ১০ টা মিনিট ব্যয় করুন হেয়ার অয়েলিং-এ। সেই সময় টুকু তো আছে অবশ্যই। ট্রেডিশনালি কোকোনাট অয়েল-এর খুব ব্যবহার ছিল। আমার মা ও নারিকেল তেলের মধ্যে কিছু মেথি দানা ফেলে রাখতেন।
আপনি নারকেল তেল মাথার স্ক্যাল্প-এ সিঁথি কেটে লাগিয়ে নিয়ে নিয়ে এরপর পুরো চুলে তেলটা লাগাবেন। এরপর ৫ মিনিট স্ক্যাল্প ম্যাসাজ করবেন। সেটা করতে না চাইলে উডেন চিরুনি ব্যবহার করবেন। এতে মাথার স্ক্যাল্প-এ রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পাবে। সপ্তাহে ২-৩ দিন চুলে কোকোনাট অয়েল লাগাবেন। তবে তেল লাগিয়ে স্ক্যাল্প-এ ২-৩ দিন রেখে দেবেন না যেন। এতে উপকারের থেকে ক্ষতি বেশী হবে।
২. আগের সময়ের মহিলাদের শ্যাম্পু ব্যবহারের সুযোগ ছিল না। তাই তারা ন্যাচারাল উপাদান যেমন- শিকাকাই, রিঠা, হিবিসকাস, লেমন পিল, মশুর ডাল বাটা, মেহেদী বাটা ইত্যাদি ব্যবহার করত চুল পরিষ্কারের জন্যে। যার ফলে তাদের চুল কেমিক্যাল-এর সংস্পর্শে আসত না এবং চুলও ভালো থাকত।
আর আমরা তো আজকাল ২ /১ দিন পর পর শ্যাম্পু ছাড়া নিজের চুলকে ভাবতেই পারি না। তবে কি করে চুল ভালো থাকবে বলুন?? এজন্যে, কেমিক্যাল-এ ভর্তি শ্যাম্পু বাদ দিয়ে হোমমেইড হারবাল শ্যাম্পু ব্যবহার করতে পারেন। এতে চুল পরিষ্কার হবে এবং চুলও ভালো থাকবে। চলুন শিখে নেই কিভাবে বানাবেন-
- একটা লোহার পাত্রে রিঠা, শিকাকাই এবং ড্রাই আমলকী নিয়ে ১ লিটার পানি দিয়ে সারারাত ভিজিয়ে রাখতে হবে। পরদিন আপনি দেখতে পাবেন যে, পানির রঙের পরিবর্তন হয়েছে এবং সব উপকরণ অনেক নরম হয়ে গিয়েছে।
- এবার একটা বড় তলা ভারি প্যান চুলায় দিয়ে দিন। এর মধ্যে রিঠা, শিকাকাই এবং আমলকী ভেজানো (পানিসহ) দিয়ে দিন। এর মধ্যে কিছুটা তুলসী পাতা ডালসহ দিবেন। একটি চামচের সাহায্যে সবকিছু সুন্দরভাবে মিশিয়ে দিন। আঁচ মিডিয়াম রাখুন। ৫ মিনিট পরেই দেখবেন মিশ্রণটির রঙ পরিবর্তন হয়েছে। এভাবে ২০ মিনিটের মতো জ্বাল দিতে থাকুন। ২০ মিনিট পর চুলা বন্ধ করে দিন এবং মিশ্রণটি ঠান্ডা হতে দিন। ঠান্ডা হলে, হাত দিয়ে সমস্ত উপকরণ ভালোভাবে কচলে নিন। এবার, একটি ছাঁকনীতে ছেঁকে ঘন জুস-টা আলাদা করে নিন। এই ঘন জুস-টাই আপনার ন্যাচারাল শ্যাম্পু। এবার জুস-টাকে একটা বোতলে ভরে নিয়ে তাতে ৪-৫ ফোঁটা নারকেল তেল মিশিয়ে ফ্রিজে সংরক্ষণ করুন।
৩. আজকাল আমরা নিজেদের লুক-এ চট করে চেঞ্জ আনতে ব্যবহার করি হেয়ার কালার। যার ফলে চুল যায় ড্যামেজ হয়ে এবং হেয়ার লস শুরু হয়। তবে সেক্ষেত্রে দেখতে গেলে আগের সময়ে মহিলারা কেউই কেমিকেল যুক্ত হেয়ার কালার করতেন না। অনেকের চুল পেঁকে যাওয়ার পর ব্যবহার করতেন মেহেদী পাতা। এছাড়া কালো চুলেও মেহেদী একটা ব্রাউনিশ অরেঞ্জিশ টিন্টেড কালার দেয়। যা রোদ পড়লে দেখতে বেশ লাগে। তাই চুলে কালার চাইলে ব্যবহার করতে পারেন মেহেদী পাতা। রঙ সুন্দর এবং দীর্ঘস্থায়ী করতে এতে যোগ করুন চা পাতা অথবা কফির গুঁড়ো। জানি, এতে কেমিক্যাল হেয়ার কালার-এর মত হবে না একদমই। কিন্তু ভেবে দেখবেন, আপনার চুলটা কিন্তু ভালো থাকবে।
৪. রোগমুক্ত স্বাস্থ্যও কিন্তু সুন্দর চুলের জন্যে অনেক দরকারী। আজকাল সকল ধরনের কাজ করা অনেক সহজ হয়ে গেছে এবং দেখা যায় আজকালকার মানুষ প্রায় সময়টাই ডেস্ক-এর সামনে বসে কাটিয়ে দেয়। পুরো শরীর একটিভ না থাকলে চুলের স্বাস্থ্যও কিন্তু ভালো আশা করা যায় না।
আগের সময়ে পুরুষ বা মহিলা যাই বলেন না কেন তারা খুবই একটিভ ছিলেন এবং সমস্ত কাজ নিজ হাতেই করতেন। যার ফলে শরীর ও ভালো থাকত। আর শরীর ভালো থাকলে তো চুলও ভালই থাকবে তাই না? কারণ, যখনই আমরা একটিভ হই তখন আমাদের সোয়েটিং হয়। যার ফলে মাথার স্ক্যাল্প-এর ক্লগড পোর-গুলো ওপেন হয়, ব্লাড সার্কুলেশন বাড়ে এবং নতুন চুল আসতে সাহায্য করে। তাই যতসম্ভব নিজেকে বিভিন্ন অ্যাক্টিভিটি-এর মধ্যে রাখতে হবে। পরিমিত পুষ্টিকর খাবার তো খেতেই হবে। সে আর নতুন করে কি বলবো!
৫. আচ্ছা এবার চলুন কিছু ইফেক্টিভ ট্রেডিশনাল ইনগ্রেডিয়েন্টস-এর হেয়ার প্যাক এর কথা জেনে নেই-
- একটি বাটিতে ৫-৬ টেবিল চামচ আমলকীর গুঁড়ো নিন। চাইলে আমলকীর পেস্ট-ও নিতে পারেন। এর সাথে ১/২ চা চামচ নারকেল তেল নিয়ে তাতে ৫-৬ টেবিল চামচ পানি মিলিয়ে একটি স্মুদ পেস্ট তৈরি করুন। এটি মাথার স্ক্যাল্প-এ ৪০ মিনিট লাগিয়ে শ্যাম্পু করে ফেলবেন।
- একটি ছোট বোলে ২ চা চামচ শুকনো শিকাকাই পাউডার, ২ চা চামচ আমলকীর পাউডার, হাফ কাপ টক দই ও ১ চা চামচ নারকেল তেল খুব ভালোভাবে মিশিয়ে নিন। এটি পুরো চুলে লাগিয়ে ১ ঘণ্টা রাখবেন। এরপর শ্যাম্পু করে ফেলবেন।
- হাফ কাপ অ্যালোভেরা জেল, ৩ টেবিল চামচ কোকোনাট অয়েল ও ২ চা চামচ মধু এক সাথে মিশিয়ে নিন। এরপর মাথার স্ক্যাল্প এবং চুলে ৩০ মিনিট লাগিয়ে রাখুন। এরপর শ্যাম্পু করুন।
এই তো ছিল, চুলের যত্নে ট্রেডিশনাল মেথড নিয়ে কিছু কথা। আশা করছি, আপনাদের অনেক উপকারে আসবে।
লিখেছেন- জান্নাতুল মৌ
ছবি- সাটারস্টক