এর আগের লেখায় আমি “ডিপ্রেশন-কে ডিল করবেন কীভাবে?“- এ নিয়ে হালকাভাবে লিখেছিলাম। তাতে নানা রকম প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হল এই নিয়ে আরেকটু লেখা দরকার। ডিপ্রেশন-এ থাকলে কি ধরনের সমস্যা হয় আগেই লিখেছি, তাই এ নিয়ে এখানে আর লিখব না। বেশির ভাগই দেখা যায় কোন বিশেষ কারণে ডিপ্রেশন-এ ভুগলে সেটা কোন ধরনের ট্রিটমেন্ট ছাড়াই আবার কেটেও যায়। তাতে হয়ত ছয় থেকে সাত মাস সময় লাগে। কিন্ত এর উলটোটাও হয় কারো কারো ক্ষেত্রে, তাদের হয়ত বছর ঘুরে যায় কিন্তু বিষণ্ণতা আর কাটে না।
ডিপ্রেশন-এর কারণ খুঁজলে দেখা যাবে, এর মূলে রয়েছে অনেক ধরনের জটিলতা যেগুলো একদিনে তৈরি হয় নি। বিবাহিত জীবনে সমস্যা (এই সমস্যা অনেক ধরনের হতে পারে), প্রেম সংক্রান্ত জটিলতা, পারিবারিক ঝামেলা, ডিভোর্স, সেপারেশন, ভালবাসার মানুষের থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া, চাকরি হারানো বা কাজ করা সত্তেও প্রমোশন না হওয়া, কাছের মানুষের মৃত্যু। কিংবা পড়াশুনার জন্য ফ্যামিলি থেকে দূরে থাকা বা বিয়ের পর হঠাৎ করেই বন্ধু-বান্ধব ও পরিবারের থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া। এমনকি এটাও দেখা যায় বহু দিনের স্বপ্ন মা হবেন, কিন্ত মা হওয়ার পরে শারীরিক ও মানসিক চাপে ডিপ্রেশন-এ পড়ে যান।এভাবে কারণ বলে শেষ করা যাবে না। এখন কথা হচ্ছে এ থেকে বের হবেন কিভাবে? কিভাবে করবেন এ ভয়গাঁথার অবসান??
১) সম্ভবত ডিপ্রেশন-এর কারণ বা অনেক ক্ষেত্রে মূল লক্ষণ হিসেবে দেখা যায় কোন বিষয়ে আগ্রহ না থাকা বা কোন ধরনের কর্মকাণ্ডে নিজেকে যুক্ত করতে না পারা। নিজের মধ্যে কোন একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের প্রতি আগ্রহ তৈরি করা বা কোন একটা কাজের সাথে নিজেকে নিয়মিতভাবে যুক্ত রাখা মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি পরোক্ষভাবে আপনার ভেতরে আত্মসম্মান তৈরি করতে সাহায্য করে।
এগুলো আপনাকে একধরনের আত্মতৃপ্তি দেবে, মনকে বিভিন্ন সমস্যা থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করবে এবং নেগেটিভ চিন্তা এবং ইমোশন থেকে দূরে রাখবে। বিশেষত ঠিক যখন আপনার খারাপ লাগা শুরু হবে অর্থাৎ রাগ, দুশ্চিন্তা, অস্থির লাগা, কান্না পাওয়া ইত্যাদি তৎক্ষণাৎ নিজেকে কোন একটা কাজে লাগিয়ে ফেলুন। একবার ভাবুনতো বাচ্চাদের মধ্যে ডিপ্রেশন দেখা যায় না কেন? কারণ তাদের মধ্যে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন বিষয়ে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে, যে কারণে নেগেটিভ চিন্তা তাদের মনে জায়গা করতে পারে না। একই কাজ আপনাকে করতে হবে।
২) ডিপ্রেশন কাটিয়ে উঠতে আপনি তিন ধরনের কাজ করতে পারেন-
* আনন্দ দেয় এমন কোন কাজ: আনন্দ দেয় এমন কাজগুলো আমাদের মন ভালো রাখতে সাহায্য করে। যেমন মুভি দেখা, গল্পের বই পড়া, বন্ধুদের সাথে সময় কাটানো, বেড়াতে যাওয়া ইত্যাদি। কিন্তু সমস্যা হল যারা ডিপ্রেশন-এ ভোগেন, তাদের বেলায় হয় এই কাজগুলো করার কোন আগ্রহই থাকে না অথবা এগুলো থেকে যে ভালো লাগা তৈরি হয় তার স্থায়িত্ব হয় খুব কম। তাই প্রথমটায় জোর করে হলেও এই কাজগুলো শুরু করতে হবে এবং এগুলো চালিয়ে যেতে হবে। যেমন, আপনি ঠিক সপ্তাহে একটা দিন সময় করে মুভি দেখবেন। সেই দিনটা আপনি নিজের মত করে উপভোগ করবেন। সবার বাড়িতেই এখন কম্পিউটার আর নেট কানেকশন থাকে, তাই মুভি দেখা কোন কঠিন কাজ নয়। তবে আমি বলবো চেষ্টা করবেন একটু ভালো মুভি দেখতে। সেই একই নাচ-গানওয়ালা হিন্দি মুভি না দেখে দেখুন “কাস্ট এওয়ে” বা “ফরেস্ট গাম্প”- এর মত মুভি দেখুন। এই বেলা অনেকেই বলবেন, আমার মুভি দেখার সুযোগ নাই। ভালো কথা, তাহলে বই পড়েন।
এখন প্রচুর ভালো ভালো থ্রিলার-এর অনুবাদ পাওয়া যায়, তাছাড়া আমাদের বাঙ্গালী সাহিত্যেও নেহাত কম বই নেই কিন্তু। আমি যদি নিজের কথা বলি, আমি তো এক টানে হুমায়ুন আহমেদের সব বই পড়ে ফেলেছিলাম। আমি এও স্বীকার করছি, সুলতান সুলেমান-এর পুরো চার সিজন আমি একসাথে শেষ করেছিলাম এক মাসে। হাস্যকর মনে হতে পারে! কিন্তু আমি করেছিলাম আমার নিজের ভালো লাগবে বলে। ঐ একটা বছরে আমি প্রচুর ভালো ভালো সিনেমা দেখেছি। এরকম আপনিও ভালো লাগে এমন কিছু একটা করার চেষ্টা করুন। যারা বলবেন, আমাদের সময় নেই, সুযোগ নেই। তাদের বলি, নিজেকে প্রায়োরিটি দিতে শিখুন আগে, অন্যরাও তখন আপনাকে প্রায়োরিটি দেবে। দিনের পর দিন একা একা গুমরে পড়ে থাকা কোন সুস্থতার লক্ষণ না। আর মনে রাখবেন বাড়ির সবাইকে একসাথে আপনি খুশি করতে পারবেন না, সে চেষ্টা করারও কোন মানে নেই। সপ্তাহে একটা দিন, একটা বিকেল নিজের জন্যে রাখতে চাওয়া দোষের কিছু নয়। তাতে কেউ আপত্তি জানালে গায়ে মাখবেন না। মনে রাখবেন নিজের ভালো থাকাটা সবচেয়ে জরুরি।
* গঠনমূলক কোন কাজ: ডিপ্রেশন-এ পড়লে নিজের প্রতি বিশ্বাস কমে যায়। মনে হয় আর কোন কিছুই হবে না আমাকে দিয়ে। এই বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে অল্প অল্প করে কাজ হাতে নিন। আর শেষ করতে পারলে দেখবেন নিজেরই আনন্দ হচ্ছে। এখন কথা হল করবেন টা কী? সেটাও আপনাকেই ঠিক করতে হবে। মোটা হয়ে গেছেন? টার্গেট ঠিক করুন ঠিক এক মাসে এক কেজি ওজন কমাবেন। রান্না করতে ভালবাসেন? ফেসবুক বা ইন্সটাগ্রাম-এ নিজের একটা পেজ খুলুন। ভালো ছবি আঁকতে পারেন? আবার ছবি আঁকা শুরু করুন। বা চাইলে শেখাতে শুরু করুন।
ছোট ছোট অনেকগুলো কাজের একটা লিস্ট আজই তৈরি করুন, যেগুলো আপনি এই বছর শেষ হবার আগেই করতে চান। তবে আগেই বলে রাখি এক্ষেত্রে রিয়েলিস্টিক গোল সেট করবেন। যে মেদ জমতে সময় লেগেছে এক বছর সেটা এক মাসে যাবে না। যেসব কাজের লিস্ট করেছেন, তার প্রতিটা কমপ্লিট হলে নিজেকে একটা গিফট দিন। অন্য কারও কাছ থেকেই গিফট পেতে হবে এমন কথা কে বলেছে? আমি তো আমার জন্মদিনে নিজেকে একটা গোল্ড লকেট উপহার দেবো ঠিক করেছি, সেজন্য কাজও করে যাচ্ছি। অন্য কেউ এসে আপনার মন ভালো করে দিয়ে যাবে না, আপু। পথ হয়ত বাতলে দেবে, কিন্ত সেই পথে হাঁটতে হবে নিজেকেই।
* কল্যাণমূলক বা স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ: স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ, এই কাজগুলো মানুষের আত্ম-উন্নয়নে সাহায্য করে। বেশি দূরে যেতে হবে না। নিজের বাসায় যে কাজের মানুষটি রেখেছেন, তাদের বাচ্চাদের বিনে পয়সায় কিছুদিন পড়িয়ে দেখুন, ভালো লাগবে। রক্তদান কর্মসুচিতে যোগ দিন। পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে যারা আপনার চেয়েও কম সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে, তাদের জন্য কিছু একটা করুন, দেখবেন তখন নিজের সমস্যাগুলোকে আর সমস্যা মনে হবে না।
সবশেষে বলি, চারপাশের সবাইকে গুরুত্ব দেয়ার আগে নিজেকে একটু গুরুত্ব দিন। এতে কারো ক্ষতি হবে না। আমি জানি আমাদের সমাজে ডিপ্রেশন-কে সবাই তুচ্ছ করে দেখে, এমনকি এ নিয়ে টিটকিরি করতেও ছাড়ে না। পাত্তা দেবেন না। স্রেফ পাত্তা দেবেন না। কঠিন হতে শিখুন। টেকেন ফর গ্রান্টেড হয়ে বেঁচে থাকতে আমরা পৃথিবীতে আসি নি। ভয়ংকর বিষণ্ণতা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় শুধু আপনার কাছেই আছে। মনকে বলুন- “বিষণ্ণতায় ডুবে থেকো না!“
ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন।
ছবি- সাটারস্টক