চুল পড়া বন্ধ করে চুলের গোড়া মজবুত করতে ও নতুন করে চুল গজানোর ক্ষেত্রে, মাথার ত্বক পরিষ্কার রাখতে প্রাচীন কাল থেকেই অ্যাসেনশিয়াল তেল ব্যবহৃত হয়ে আসছে। গাছের বিভিন্ন অংশ যেমন ফুল, পাতা, শেকড়ের নির্যাস ইত্যাদি থেকে অ্যাসেনশিয়াল অয়েল তৈরি হয়। এ ধরণের বেশিরভাগ তেল সাধারণত ৪/৫ ফোটা করে নিয়ে অন্য কোন তেলের সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করা হয়। যে তেলের সাথে মেশানো হয় সেগুলোকে বলা হয় ক্যারিয়ার অয়েল (carrier oil)। যেমন – জোজোবা তেল, আমন্ড তেল ইত্যাদি। তেলটি শুধু মাথার ত্বকে দিতে হবে, চুলে নয় আর সার্কুলার মোশন (circular motion)– এ ম্যাসাজ করতে হবে। তবে যে কোন অ্যাসেনশিয়াল তেল পুরোপুরিভাবে ব্যবহারের পূর্বে ত্বকের সামান্য অংশে লাগিয়ে দেখতে হবে যে সেটাতে আপনার অ্যালার্জি আছে কিনা। অ্যাসেনশিয়াল অয়েল যেমন কিনতে পাওয়া যায় সেরকম আপনি নিজের বাসায়ও তৈরি করতে পারেন। চুলের যত্ন নিতে নিজে কিভাবে চুলের জন্য অ্যাসেনসিয়াল অয়েল তৈরী করবেন, তাই দেখে নিন চলুন!
চুলের যত্ন নিতে ৫টি অ্যাসেনশিয়াল অয়েল বানানোর নিয়ম
১. চুলের যত্ন নিতে হার্বাল হেয়ার অয়েল
অ্যালোপেসিয়া (Alopecia)-এর কারণে চুল পড়ে যায় অকালেই। কিছু হার্ব আছে যেগুলো চুল গজানোর জন্য বা চুল রক্ষার জন্য উপকারী। এই হার্বাল তেলটি আপনি ঘরে বসেই তৈরি করতে পারবেন আপনার চুলের গোড়া শক্ত করার জন্য এবং ঘন চুল পাবার জন্য। এটি তৈরী করতে লাগবে- কারি পাতা (একে আমাদের দেশে বারসুঙ্গা বা নিমভুত গাছের পাতাও বলা হয়), নীম পাতা, তুলসী পাতা, মেথি দানা, আমন্ড তেল, ঢাকনা সহ একটি পাত্র, একটি বোতল ও পরিষ্কার কাপড়ের টুকরো।
প্রস্তুত প্রণালীঃ
পাত্র এবং পাতাগুলো ভালো মতো ধুয়ে পরিষ্কার করে নিন। সবগুলো পাতা একসাথে খুব ছোট ছোট টুকরো করে নিন বা পিষে নিন। এবার আমন্ড তেল, মেথি দানা, আর পাতাগুলো একসাথে পাত্রে ঢেলে সেটা ঘন না হওয়া পর্যন্ত গরম করতে থাকুন। এরপর পাত্রটি নামিয়ে মিশ্রণটি ঠান্ডা হওয়ার জন্য ঢেকে রাখুন। ঠান্ডা হয়ে গেলে একটি বোতলে পরিষ্কার কাপড়ের সাহায্যে ছেঁকে ব্যবহার করুন। এই তেল ঠান্ডা জায়গায় না রাখলেও হবে।
২. চুলের যত্ন নিতে লেমন অ্যাসেনশিয়াল অয়েল
লেবুর বাইরের অংশ গ্রেট করে নিন। একটি ছোট গ্লাসে বা বোতলে গ্রেট করা অংশটি রাখুন। এবার পুরো বোতলের বাকি অংশটুকু অলিভ অয়েল দিয়ে ভরে ফেলুন। সূর্যের আলো সব সময় পড়ে এমন জায়গায় কয়েকদিনের জন্য রেখে দিন। তবে প্রতিদিনই বোতলটি কয়েকবার করে ঝাকাতে হবে। কয়েকদিন পরে বোতলের তেল কোন ছাঁকনি বা কাপড়ের সাহায্যে ছেঁকে ফেলুন। লেমন অ্যাসেনশিয়াল তেল তৈরি হয়ে গেল। এই তেল এয়ার টাইট পাত্রে ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রেখে ব্যবহার করুন। এই তেল আঠালো চুল পরিষ্কার করার জন্য আর মাথা ব্যথার জন্য ব্যবহার করতে পারেন।
সাবধানতা
লেমন অয়েল ব্যবহার করার সময় বা লেমন অয়েল চুলে লাগিয়ে রোদে যাবেন না। চুল ধোয়ার পর যেতে পারবেন।
৩. মিন্ট অয়েল
এই তেল মাথার যে অংশে ব্যবহার করা হবে সেখানে রক্ত প্রবাহ বৃদ্ধি পায়। যেহেতু রক্ত প্রবাহ ভালো হয়, তাই এটি চুল তাড়াতাড়ি গজানো আর বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য উপকারী। এটি তৈরি করতে লাগবে- একটি বোতল, একটি পাত্র, আমন্ড অয়েল, পুদিনা পাতা, পরিষ্কার কাপড়ের টুকরো।
প্রস্তুত প্রণালীঃ
প্রথমে পুদিনা পাতাগুলো ভালোমতো ধুয়ে নিন। পুদিনা পাতাগুলো যতটুকু সম্ভব ছোট ছোট টুকরো করে নিন নাহলে পিষে নিন। এবার পাতাগুলো একটি পাত্রে রেখে দিন। পাত্রে রাখা পুদিনা পাতার উপর আমন্ড তেল এমনভাবে ঢালুন যেন তেলের মধ্যে পুদিনা পাতা পুরোপুরি ডুবে যায়। এবার পাত্রের মুখ ঢাকনা দিয়ে আঁটকে ২-৩ দিনের জন্য জানালার পাশে রেখে দিন। মাঝেমাঝে পাত্রটি ঝাকাবেন। ২-৩ দিন পরে পরিষ্কার কাপড়ের সাহায্যে তেল ছেঁকে নিন যেন পুদিনা পাতার কোন বড় টুকরো বোতলে না পড়ে। এবার কোন ঠান্ডা জায়গায় রেখে দিন এবং দীর্ঘ সময়ের জন্য ব্যবহার করুন।
সাবধানতা
১) গর্ভাবস্থায় এই তেল ব্যবহার করা যাবে না
২) সেনসেটিভ ত্বক যাদের তারা ব্যবহার না করলেই ভালো
৪. গার্লিক অয়েল
চুলের গোড়া মজবুত করে, চুল পড়ে গেলে নতুন করে চুল গজাতে সাহায্য করে, আর স্ক্যাল্প থেকে ক্ষতিকর টক্সিন দূর করে। এক মুঠ রসুনের কোয়া, এক কাপ অলিভ অয়েলে এক সপ্তাহের জন্য রেখে দিন। এরপর এই তেল ২ সপ্তাহ ধরে ব্যবহার করতে পারবেন। ঘুমাতে যাওয়ার আগে মাথার যেসব জায়গা থেকে চুল অনেক পড়ছে সেখানে আলতোভাবে এই তেল ম্যাসাজ করুন। তারপর শাওয়ার ক্যাপ দিয়ে মাথা ঢেকে শুয়ে পড়ুন। সকালে উঠে হালকা শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলুন। কয়েক সপ্তাহ পরেই দেখবেন চুল পড়া কমে গিয়েছে এবং একই সাথে নতুন চুল গজাচ্ছে। গার্লিক অয়েল প্রস্তুত হবার আগ পর্যন্ত চুল যেখানে কম সেই জায়গায় রসুনের কোয়া ঘষে পরে সেখানে অলিভ অয়েল দিতে পারেন।
৫. সাধারণ অ্যাসেনশিয়াল অয়েল
এছাড়াও যেকোন অ্যাসেনশিয়াল অয়েল যদি ত্বক, চুল বা অন্য কাজের জন্য প্রস্তুত করতে চান তাহলে নীচের নিয়ম অনুযায়ী করতে পারেন। এর জন্য যা যা লাগবে সেগুলো হলো- ১/৪ কাপ হার্ব ( যেটার তেল আপনি তৈরী করতে চান), ১ কাপ অলিভ অয়েল, হলুদাভ/বাদামী বা গাঢ় রঙের কাঁচের বোতল, মাঝারি আকারের পাত্র, ছাঁকনি বা পরিষ্কার কাপড়।
প্রস্তুত প্রণালীঃ
একটি মাঝারি আকারের পাত্রে অলিভ অয়েল আর হার্বগুলো একসাথে মিশিয়ে নিন। এই মিশ্রণ নীচের যে কোন একটি উপায়ে গরম করতে পারেন।
১) চুলায় খুব অল্প আঁচে ৬ ঘন্টা রেখে দিন
২) চুলায় রাখতে না চাইলে ২ সপ্তাহ একটানা সূর্যের আলোয় রেখে দিন
সব শেষে তেলটি ছেঁকে হলুদাভ বা বাদামী কাঁচের বোতলে রাখতে হবে। এরকম গাঢ় রঙের বোতলে রাখতে হবে কারণ, এর ফলে তেলটি অনেক দিন ঠিক থাকবে। যদি একদম স্বচ্ছ কাঁচের বোতলে রাখতে চান তাহলে সেটা সূর্যের আলোয় নেয়া যাবে না এবং শুকনো, ঠান্ডা জায়গায় রাখতে হবে।
ঘরে তৈরি করতে না চাইলে বিভিন্ন হার্বাল প্রোডাক্ট-এর দোকান থেকে অ্যাসেনশিয়াল অয়েল কিনতে পারেন। তবে কেনার আগে তেলের মেয়াদ এবং আপনার ত্বকের উপযোগী কিনা তা দেখে কিনবেন। যেমন-
১) ল্যাভেন্ডার অ্যাসেনশিয়াল অয়েল তৈলাক্ত চুলের জন্য আর চুল পড়া বন্ধ করার জন্য।
২) অলিভ অ্যাসেনশিয়াল অয়েল আর তুলসি (basil) ও পুদিনা (peppermint) অ্যাসেনশিয়াল অয়েল শুষ্ক চুলের জন্য।
৩) টি ট্রি অ্যাসেনশিয়াল অয়েল খুশকির জন্য।
৪) তুলসি তেল তৈলাক্ত চুলের জন্য আর চুল গজানোর জন্য খুবই উপকারী। চুলের যত্ন নিতে চাইলে আপনি তুলসির তেল ব্যবহার করতে পারেন।
৫) রোজমেরি অয়েল চুল বৃদ্ধি আর মাথার চুলকানি রোধ করার জন্য। সব ধরণের চুলে ব্যবহার করা যায়। তবে প্রেগনেন্ট মহিলা আর যাদের হাইপারটেনশন আছে এমন কারো ব্যবহার করা উচিত নয়।
আপনি চাইলে আপনার পছন্দমতো প্রোডাক্ট কিনতে পারেন অনলাইনে শপ.সাজগোজ.কম থেকে। আবার যমুনা ফিউচার পার্ক ও সীমান্ত স্কয়ার এ অবস্থিত সাজগোজের দুটি ফিজিক্যাল শপ থেকেও কিনতে পারেন আপনার পছন্দের প্রোডাক্টটি!
তাহলে এবার অ্যাসেনশিয়াল অয়েল বানিয়ে ফেলুন নিজে নিজেই এবং ঘরে বসেই করুন চুলের যত্ন! হাসুক আপনার চুল, হাসুন আপনিও!
ছবি- সংগৃহীত: shutterstock