কোলোরেক্টাল বা কোলন ক্যান্সার (Colorectal/Bowel/Colon cancer) বেশ প্রচলিত রোগ এখনকার সময়ে। সারা বিশ্বে এই রোগে প্রতি বছর প্রায় ৬.৫ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। নতুন করে আক্রান্ত হয় প্রায় ১.৫ লাখ। কেবলমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেই এই রোগে প্রতি বছর প্রায় ৫০ হাজার মানুষ মারা যায়। ক্যান্সার-এ মৃত্যুর দিক দিয়ে এর স্থান নবম। বাংলাদেশে এ রোগ সম্পর্কে সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। তবে আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি হওয়া ক্যান্সার-এর মধ্যে প্রথম পাঁচটির একটি এই কোলোরেক্টাল ক্যান্সার। আসুন তাহলে জেনে নেই এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত।
কোলোরেক্টাল বা কোলন ক্যান্সার কী?
এই ক্যান্সার এর বিষয়টি মোটামুটি এখন সবাই জানে। কোলন হচ্ছে অন্ত্র, আমাদের খাদ্য পরিপাক এবং খাদ্যের যে নালিটি রয়েছে সেটার নিচের যে অংশ রয়েছে একে বলা হয় কোলন বা বৃহদন্ত্র। আর তারও নিচের যেই অংশটা যেখানে মল জমা থাকে সেটাকে বলা হয় রেক্টাম (Rectum)। এই অংশের ক্যান্সার-কে বলা হয় কোলোরেক্টাল ক্যান্সার। আর এই ক্যান্সার-টি এখন একটি বহুল প্রচলিত রোগ।
কেন হয় কোলোরেক্টাল বা কোলন ক্যান্সার?
কোলোরেক্টাল ক্যান্সার-এর কিছু ঝুঁকির কারণ রয়েছে। এটি মূলত বংশগত। বংশে কারও ক্যান্সার থাকলে বাকি সদস্যদেরও হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে সবচেয়ে বেশি যেটি বলা হচ্ছে সেটি হচ্ছে কোলন-এ পলিপ (Colon Polyp)। কারও যদি কোলন-এ পলিপ হয়, সেটি পরে ক্যান্সার-এ রূপান্তরিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
কারও যদি কোষ্ঠকাঠিন্য (Constipation) থাকে খুব বেশি মাত্রায়, তাহলে ঝুঁকি রয়েছে। কোষ্ঠকাঠিন্য থাকা মানে হল, বেশি সময় ধরে জীবাণুগুলো শরীরের সংস্পর্শে থাকে।
ঝুঁকিতে রয়েছেন যারা!
১. কোলোরেক্টাল ক্যান্সার যে কোন বয়সেই হতে পারে। তবে সাধারণত ৫০ বা তাঁর বেশি বয়সের মানুষদেরই বেশি হয়ে থাকে।
২. আগে থেকেই কোলন বা অন্ত্রের কোন অংশে ক্যান্সার বা পলিপ হয়ে থাকলে সেটি পরবর্তীতে আরো বিস্তৃত হতে পারে।
৩. অন্ত্রের বিভিন্ন রোগ যেমন ইনফেকশন, আলসার, অন্ত্রের প্রদাহ ইত্যাদি ঠিকমত চিকিৎসা না হলে কোলন ক্যান্সার-এ রুপ নিতে পারে।
৪. ধূমপান ও অ্যালকোহল সেবনকারীরা অনেক বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। সেটা যে কোন ধরনের ক্যান্সার-এর জন্যই। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে ধূমপায়ীরা অধূমপায়ীদের থেকে ৩০-৪০ ভাগ বেশি কোলোরেক্টাল ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন।
৫. খাদ্যতালিকায় শর্করার তুলনায় আমিষ বেশি থাকলে কোষ্ঠকাঠিন্য হয়। যেমন- গরুর মাংস, ফাস্টফুড, বার্গার এসব বেশি খেলে বা শাক সবজি তুলনামুলক ভাবে কম খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। আর কোষ্ঠকাঠিন্য থাকা মানেই তিনি কোলন ক্যান্সার-এর ঝুঁকিতে রয়েছেন।
৬. ডায়াবেটিস রোগী বা যাদের ইনসুলিন রেজিস্টেন্স আছে, তাদের ঝুঁকি বেশি।
৭. স্বাভাবিক ওজনের তুলনায় অতিরিক্ত ওজন যাদের তাঁদের কোলন ক্যান্সার-এ আক্রান্ত হওয়ার এবং মৃত্যুর হার বেশি।
কোলোরেক্টাল বা কোলন ক্যান্সার হওয়ার লক্ষণসমূহ
১. মলত্যাগের অভ্যাসের পরিবর্তন।
২. কমপক্ষে চার সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য বা পর্যায়ক্রমে ডায়রিয়া ও কোষ্ঠকাঠিন্য থাকা।
৩. পায়ুপথে বা মলের সঙ্গে রক্ত যাওয়া।
৪. পেটে অস্বস্তিভাব যেমন গ্যাস, পেট ফুলে থাকা, পেট মোচড়ানো, পেট ফাঁপা ভাব ইত্যাদি থাকা।
৫. ক্রমশ ওজন কমে যাওয়া।
৬. রক্তশূন্যতা।
৭. মলত্যাগের পরেও পেট পুরোপুরি খালি হয় নি এমন বোধ হওয়া।
৮. ক্যান্সার কোলন থেকে ছড়িয়ে শরীরের অন্য কোথাও গেলে যেমন লিভারে গেলে ব্যথা হতে পারে। ফুসফুসে গেলে কাশি হতে পারে। এমনকি হাড়েও ছড়িয়ে পড়তে পারে ক্যান্সার কোষ।
কোলোরেক্টাল ক্যান্সার-এর চিকিৎসা
শুরুতেই ধরা পড়লে এই রোগের যথাযথ চিকিৎসা করা সম্ভব। কোলোরেক্টাল ক্যান্সার নিরাময়ে সার্জারি, রেডিয়েশন, কেমোথেরাপি- এর যে কোনটি বা কয়েকটি একসঙ্গে ব্যবহার করা যায়। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় কোলোরেক্টাল ক্যান্সার-এর চিকিৎসায় অনেক অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে। এর পাশাপাশি নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি যেমন অ্যান্টিবডি ব্যবহার, জিনথেরাপি, টিউমারের রক্ত চলাচলে বাধা দেওয়া- এ রকম নানা পদ্ধতির মাধ্যমে কোলোরেক্টাল ক্যান্সার-এর চিকিৎসার সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে।
সচেতন হন
১. কোলন ক্যানসারের ঝুঁকি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে জীবনযাত্রার ধরণ পরিবর্তন করা জরুরী। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় বিভিন্ন রকম ফলমূল ও সবজি বেশি পরিমাণে রাখুন। এ সমস্ত খাবারে ভিটামিন, মিনারেল, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বেশি পরিমাণে থাকে যা ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে।
২. ধূমপান ও মদ্যপান থেকে বিরত থাকুন। নিয়মিত এক্সারসাইজ করুন এবং সঠিক ওজন বজায় রাখুন।
৩. যারা ঝুঁকিতে আছেন বলে ধারণা করছেন যেমন যাদের মলাশয়ে পলিপ আছে দ্রুত সেটার চিকিৎসা করুন। বংশে কোলন ক্যান্সার হয়েছে এমন কেউ থেকে থাকলে নিয়মিত স্ক্রিনিং করা প্রয়োজন।
৪. ঠিক কতদিন পর পর বা কোন কোন পরীক্ষার মাধ্যমে এ রোগের স্ক্রিনিং করতে হবে, এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা একমত না হলেও কিছু কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে সচেতন হতে পারবেন। প্রতিবছর মল পরীক্ষা করা, নিয়মিতভাবে সম্পূর্ণ অন্ত্রের পরীক্ষা করা এক্ষেত্রে কাজে দেয়।
এ রোগ সম্পর্কে সচেতনতার অভাব এবং নিয়মিত পরীক্ষা করার উপকারিতা না জানার কারণে কোলরেক্টাল ক্যান্সার-এর স্ক্রিনিং কম হয়। যার ফলে প্রতি বছর নিজের অজান্তে হাজার হাজার মানুষ এই প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। নিজের ও পরিবারের সকলের সুস্বাস্থ্যের জন্য তাই সচেতন হয়ে ওঠার এখনি সময়।
ছবি- সংগৃহীত: সাটারস্টক