আজকাল ঘরে ঘরে ডেঙ্গু জ্বর হচ্ছে। বিগত ২০ বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বেড়েছে। যার ফলে আমাদের মনে এই নিয়ে চরম ভীতি কাজ করছে। সঠিক চিকিৎসার অভাবে ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। একটু সচেতন আর সাবধানতা অবলম্বন করলেই আমরা এ জ্বর থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে পারি। তাহলে চলুন ডেঙ্গু জ্বরের কারণ, লক্ষণ ও এর প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেই!
ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে সার্বিক আলোচনা
ডেঙ্গু জ্বর কিভাবে ছড়ায়?
ডেঙ্গু জ্বরের উৎপত্তি ডেঙ্গু ভাইরাস বাহিত এডিস ইজিপ্টাই (aedes aegypti) নামক মশার কামড়ে হয়। ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশা কাউকে কামড়ালে সেই ব্যাক্তি ৪ থেকে ৬ দিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হতে পারে। আবার এই আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোন জীবানু বিহীন মশা কামড়ালে সেই মশা ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়। এভাবে একজন থেকে অন্য জনে মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে থাকে। এডিস মশা আবার ৪ ধরনের হয়। যাকে সেরোটাইপ (serotype) বলা হয়। তবে কোন সেরোটাইপেকে আক্রান্ত হলো আর কোন সেরোটাইপের জটিলতা কেমন তা নিয়ে গবেষণা না থাকায় চিকিৎসকদের কাছে এখনও আলাদা কোন নির্দেশনা নেই।
লক্ষণ বা উপসর্গ
১) তাপমাত্রা
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে জ্বরের তাপমাত্রা হয় অনেক বেশি। গড়াতে পারে ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত।
২) র্যাশ
রোগীর সারা গায়ে ঘামাচিরমতো লাল লাল র্যাশ উঠতে পারে। সাধারণত বুকের দিকে বেশি দেখা যায়। এই র্যাশ এ চাপ দিলে ঐ জায়গাটা সাদা হয়ে যাবে আবার কিছুক্ষণ পর লাল র্যাশটা ফেরত চলে আসবে।
৩) মাড়িতে রক্তক্ষরণ
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত পরতে পারে।
৪) মলের রঙ পরিবর্তন
ডেঙ্গু জ্বর হলে মলের রঙ পরিবর্তন হতে পারে অর্থাৎপায়খানা কালো হতে পারে।
৫) অনুচক্রিকার সংখ্যা
জ্বরের তীব্র পর্যায়ে ধমনী ছিদ্র হয়ে যেতে পারে এবং রক্তে অনুচক্রিকার সংখ্যা কমে যেতে পারে। ডেঙ্গুর এ তীব্র মাত্রাকে ডাক্তারি ভাষায় “ডেঙ্গু হেমোরেজিক (dengue hemorrhagic)” বা “ডেঙ্গু শক সিনড্রোম (dengue shock syndrome) ” বলা হয়। ডেঙ্গু শক সিনড্রোম-এর উপসর্গ হলো শ্বাস-প্রশ্বাসে অসুবিধা হওয়া কিংবা শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যাওয়া, অবিরাম অস্বস্তি এবং অবসাদ। অনেক ক্ষেত্রে কিডনি (kidney) বিকল হয়ে যাওয়ারও আশঙ্কা থাকে।
এছাড়াও বিরামহীন মাথা ব্যথা, বমি ভাব ও বমি হওয়া, হাড় ও হাড়ের জোড়ায় ব্যথা, পেশীতে ব্যথা, গ্রন্থি ফুলে যাওয়া, চোখের পেছনে ব্যথা হওয়া ইত্যাদি হতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বর পরীক্ষা
ডেঙ্গু জ্বর হয়েছে কিনা তা বুঝতে যে পরীক্ষা করা হয় তা হলো সিবিসি টেস্ট (CBC Test) । এটা হলো রক্তের প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে কিনা তা পরীক্ষা করতে করা। প্লাটিলেট ( platelets) সাধারণত দেড় লক্ষের নীচে হলে সন্দেহ করা হয় ডেঙ্গুর দিকে যাচ্ছে। আর ডেঙ্গু এনএস১এজি (Dengue NS1AG) এই অ্যান্টিজেন থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় ডেঙ্গু হয়েছে কিনা।
ডেঙ্গু জ্বর হলে চিকিৎসা কেমন হবে?
ভাইরাল জ্বরের মতোই ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা। ভাইরাল জ্বর হলে আমরা প্যারাসিটামল খাই। তেমনি ডেঙ্গু জ্বর হলেও প্যারাসিটামল খেতে হয়। তবে ডেঙ্গু জ্বর হলে তরল খাবার যেমন লেবুর শরবত, স্যালাইন, টেষ্টি স্যালাইন পরিমাণে বেশি খেতে হবে। এই জ্বরে পানিশূণ্যতা বেশি দেখা দেয়, প্রশ্রাবের পরিমাণও কমে যেতে পারে। তাই বেশি করে পানি পান করতে হবে।
কখন হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে?
ডেঙ্গু জ্বর হলেই যে হাসপাতালে ভর্তি হতেই হবে তেমন নয়। প্লাটিলেট কাউন্ট যখন ৩০ হাজারের নিচে নামে তখন আপনি হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেন। এছাড়াও যদি অনেক বমি শুরু হয় আর দাঁতের মাড়ি দিয়ে রক্ত যায়, কালো পায়খানা হয় এবং রোগী অনেক দূর্বল হয়ে যায়, তখন প্রেশার কমে গেলে দেরী না করে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধে করণীয় ও সতর্কতা
১) টীকা
ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধের জন্য “ডেংভ্যাক্সিয়া (Dengvaxia)” নামক টীকা পাওয়া যায় যা ৯ থেকে ৪৫ বছর বয়সীদের জন্য প্রযোজ্য। ১২ মাসে ৩ ডোজের মাধ্যমে এই টীকা দেয়া হয়। প্রায় ৫০ শতাংশ কার্যকর এই টীকা।
২) মশার ক্ষেত্রে সতর্কতা
ডেঙ্গু ভাইরাসবাহী মশা দিনের বেলা সক্রিয় থাকে বেশী। তাই দিনের বেলা মশা যাতে না কামড়ায় সেদিকে ব্যবস্থা নিতে হবে।যদিও সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে এই মশা রাতেও কামড়ায়। তাই মশার কয়েল, মশারি, আ্যারোসল ইত্যাদি নিয়মিত ব্যবহার করার চেষ্টা করতে হবে।
৩) বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে
ডেঙ্গু মশা পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে। খেয়াল রাখতে হবে কোন খোলা পাত্রে, ফুলের টবে, টায়ার, এয়ারকুলারে যেন পানি জমে না থাকে। সুতরাং বাড়ির আশপাশ বেশ ভালো করে পরিষ্কার করতে হবে।
৪) পেইন কিলার
কোন প্রকার পেইন কিলার দেয়া যাবে না। রোগীকে ভুলেও অ্যাসপিরিন ( aspirin) দেয়া যাবে না।
৫) ভুল ধারণা
ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে আরেকটি কথা না বললেই নয় যে, অনেকেই ভাবে ডেঙ্গু একবার হলে বোধহয় আর হয় না। এটা সম্পূর্ণ ভুল চিন্তা! ডেঙ্গু একবার হলে যে আরেকবার হবে না, এর কোন নিশ্চয়তা নেই। বরং দ্বিতীয়বার হলে এর মাত্রা আরও বেশী হয়।চিকিৎসকদের মতে,যে টাইপের এডিস মশার কারণে একবার ডেঙ্গু হয়, সেই একই টাইপের ভাইরাস থেকে একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হবে না। এডিস মশার বাকী তিন টাইপের ভাইরাস থেকেও ব্যক্তি আবারও আক্রান্ত হতে পারে।
পরিশেষে এতটুকুই বলা যায়, আমাদের সতর্কতা আর সচেতনতাই হতে পারে ডেঙ্গু থেকে দূরে থাকার প্রধান উপায়। মশা থেকে বাঁচতে শুধু অ্যারোসল আর কয়েলই নয় নিয়মিত মশারি ব্যবহার করুন। বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখুন আর জ্বর হলে তা শুরুতেই গুরুত্ব দিন কারণ ডেঙ্গু জ্বর হলে প্লাটিলেটের সংখ্যা হঠাৎ করেই কমে যায় যা খুবই ভয়ানক ব্যাপার। সবার সুস্থতা কামনা করছি। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন!
ছবি- সংগৃহীত: সাটারস্টক