একজন মেয়ে হিসাবে আপনার রিপ্রোডাক্টিভ অরগ্যান, শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া আর পিরিয়ড সংক্রান্ত হাইজিন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা আছে কি? আর ছেলেদের কাছে প্রশ্ন আপনার স্ত্রী, বোন কিংবা মেয়ের পিরিয়ডের পরিচ্ছন্নতা আর স্বাস্থ্য নিয়ে আপনি সচেতন তো? তাই আজ আমাদের টপিক পিরিয়ড ট্যাবু ! কিছুদিন আগে জনপ্রিয় এক দৈনিকে বলিউড তারকা অক্ষয় কুমারের “প্যাডম্যান” ছবি নিয়ে একটা আর্টিকেল চোখে পড়ল যেটা মেন্সট্রুয়াল হাইজিনকে ফোকাস করে নির্মিত।
ইতিমধ্যে বেশ আলোড়ন ফেলেছে গোটা ভারতে। পিরিয়ডের ব্যাপারে ট্যাবু ভাঙতে আর সচেতনতা বাড়ানোর অংশ হিসাবে অনেক বলিউড তারকাকে সোশ্যাল মিডিয়াতে ‘স্যানিটারি ন্যাপকিন’ হাতে ছবি শেয়ার করতে দেখা গেছে। অনেক অভিনেত্রী আবার নিজেদের অভিজ্ঞতার কথাও শেয়ার করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট অনেকটাই আলাদা, এই প্রাকৃতিক বিষয় নিয়ে লজ্জা আর সংকোচের যেন শেষ নেই আমাদের সমাজে! যদিও বেশিরভাগ মানুষই জানে পিরিয়ড কেন হয়, তারপরও আমরা এই ব্যাপারে আজ একটু বিশদভাবে জানবো এবং ট্যাবু বা কুসংস্কার ভাঙতে কী করা যেতে পারে সে ব্যাপারেও কথা বলবো। চলুন পিরিয়ড এবং মাসিক চক্র সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা নেয়ার চেষ্টা করি।
পিরিয়ড নিয়ে সামগ্রিক আলোচনা
কেন হয় পিরিয়ড?
পিরিয়ড বা মাসিক বা ঋতুস্রাব যেই নামেই ডাকুন না কেন এটা সৃষ্টিকর্তা কতৃক নির্ধারিত মেয়েদের প্রজনন প্রক্রিয়ায় প্রভাবকারী একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সায়েন্টিফিক্যালি বলতে গেলে একটু ভেঙ্গে বলতে হবে। মেয়েদের প্রজনন তন্ত্র দুটি প্রধান অংশের সমন্বয়ে গঠিত। প্রথমত, জরায়ু, যেখানে ফিটাস বিকশিত হয় এবং পুরুষের শুক্রাণু ফেলোপিয়ান নালিতে পরিবহণ করে নিয়ে যায়। দ্বিতীয় প্রধান অংশ হচ্ছে ডিম্বাশয়, যা ডিম্বাণু উৎপন্ন করে। মাসিক চক্রের সময় শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে হরমোন নিঃসৃত হয়।
এই হরমোনে আছে এসট্রোজেন এবং প্রজেসটেরোন যা শরীরকে গর্ভবস্থার জন্য তৈরি ও নিয়ন্ত্রণ করে। সাধারণত, প্রতি ২৮ দিন পরপর ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু নি:সৃত হয়, যা জরায়ুর দুই পাশের ফেলোপিয়ান নালী (Fallopian tube) দিয়ে জরায়ুর মধ্যে প্রবেশ করে। গর্ভধারণ না করলে, অনিষিক্ত ডিম্বাণু এবং জরায়ুর আবরণ (এন্ডোমেট্রিয়াম) একত্রে প্রত্যেক চক্রে শরীর থেকে ঝরে যায়। একেই পিরিয়ড বা মাসিক বলা হয়। যারা এতসব কঠিন কথা বুঝতে রাজি না তাদের জন্য এক কথায় বলি মাসিক হলো এমনই একটি ন্যাচারাল প্রক্রিয়া যেটা না থাকলে আপনার, আমার জন্মই হত না।
মেন্সট্রুয়াল সাইকেল সম্পর্কে ধারণা আছে কি?
মেন্সট্রুয়াল সাইকেল কিভাবে চলতে থাকে জানা আছে কি? তিনটি অংশে এই সাইকেলকে ভাগ করা হয়, প্রথমটি গড়ে চারদিন স্থায়ী হয় (৪-৭ দিন) এবং একে মিনস্ট্রাল ফেজ, দ্বিতীয়টি ১০ দিন (৮-১০ দিন) একে প্রলিফারেটিভ ফেজ এবং তৃতীয়টি ১৪ দিন (১০-১৪ দিন) স্থায়ী হয় একে সেক্রেটরি ফেজ বলা হয়। মিনস্ট্রাল ফেজে ইস্ট্রোজেন এবং প্রজেস্টেরন হরমোনের যৌথ ক্রিয়ায় যোনি পথে রক্ত বের হয়, যেটাকে আমরা পিরিয়ড বলি।
প্রলিফারেটিভ ফেজে শুধু ইস্ট্রোজেন হরমোনের প্রভাবে জরায়ু নিষিক্ত ডিম্বাণুকে গ্রহণ করার জন্য প্রস্ততি নেয়। সেক্রেটরি ফেজ ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন উভয় হরমোনের যৌথ কারণে হয়। এই সময় নিষিক্ত ডিম্বাণুর বৃদ্ধির জন্য জরায়ু সর্বোচ্চ প্রস্ততি নিয়ে থাকে আর এটা না হলে আবার মেন্সট্রুয়াল ফেজে চলে যায়। এভাবেই পূর্ণ বয়স্ক মেয়েদের ঋতুচক্র চলতে থাকে একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত। মাসিক হওয়ার পরে মেয়েরা প্রজননক্ষম মানে সন্তান ধারণের ক্ষমতা লাভ করা।
তবে এই সাইকেলটা কতদিন চলতে থাকে জানেন কি? সাধারণত ০৯-১৩ বছর বয়সে যে কোন সময় মাসিক শুরু হয় এবং ৪৫-৪৯ বছর বয়সে স্বাভাবিক নিয়মেই মাসিক বন্ধ হয়ে যায়। মেয়েদের প্রতি ২৪ থেকে ৩২ দিন অর্থাত্ গড়ে ২৮ দিন পর পর মাসিক হয়।
পিরিয়ড ট্যাবু ও আমাদের সমাজ
“কি দিন আসলো, লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে সবার সামনেই পুরুষের হাত থেকে প্যাড কিনছে!”
“বাইরে যাবি না কেন? কিরে, হইছে নাকি!“
“টয়লেটে এত সময়…কী মাসিক হইসে!”
মেয়ে হিসেবে এইরকম অনেক কথাই আমাকে শুনতে হয়। মিলিয়ে নিন তো আপনার সাথে এমন কোন ঘটনা ঘটেছে কিনা বা আপনি নিজে কখনও এমন আচরণ করেছেন কিনা! চুপচাপ কাউকে বসে থাকতে দেখলে বা বাইরে বের হতে না চাইলে, ওয়াশ রুমে গিয়ে একটু বেশি সময় নিলে বা কোন মেয়েকে ফার্মেসীর দোকানে প্যাড কিনতে দেখলেই কানাঘুষা শুরু, সাথে মুখ টিপে হাসাতো আছেই। এমন অনেক ইন্সিডেন্ট আমাদের আশেপাশেই কিন্তু হচ্ছে। ট্যাবু নিয়ে যেহেতু কথা বলছি, আমি নিজের অভিজ্ঞতা আর আশেপাশের ঘটনা থেকে জাস্ট কিছু উদাহরণ দিলাম আর কী।
পৃথিবীর সকল নারীকেই তো এই প্রাকৃতিক পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যেতে হয় তাহলে এটা নিয়ে কেন মজা নিতে হবে? আর এসব কারণে অনেক মেয়েরা তাদের সমস্যার কথা শেয়ার করতে লজ্জা পায় কিন্তু পিরিয়ড সংক্রান্ত সমস্যা লুকিয়ে রাখলে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। বিব্রত হওয়ার ভয়ে স্কুলগামী কিশোরীরা স্কুলে যেতে চায় না পিরিয়ডের সময়। একটা স্বাভাবিক বিষয় নিয়ে উভয় পক্ষের এত গোপনীয়তা, সংকোচ কিংবা ঠাট্টার মনোভাব কেন? যারা এমনটা করেন বা করেছেন নিজেকে একবার প্রশ্ন করে দেখুন তো!
অনেক বাবা-মাকেই দেখেছি পিরিয়ডের বিষয়ে সন্তানের সাথে কথা বলতে অস্বস্তিতে পড়েন। টিভিতে পিরিয়ড সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন এলে তা চট করে সরিয়ে ফেলার অভ্যাসটাও তৈরি হয়ে গেছে আমাদের। আমরা মেয়েরাও কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে যথেষ্ট লুকোচুরি করি। কোন সমস্যা হলেও ডাক্তারের কাছে যেতে লজ্জা পায়। হাইজিন নিয়েও সচেতনতার অভাব আছে। পিরিয়ড নিয়ে কিছু বিষয় ছেলে মেয়ে সবারই জানা উচিৎ। ট্যাবু ভাঙ্গার বিষয়টা নিজের ঘর থেকেই শুরু করুন।
কিভাবে পিরিয়ডের ট্যাবু ভাঙ্গতে পারি?
আমাদের দেশে পিরিয়ড নিয়ে ট্যাবু ভাঙ্গতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমাধান হচ্ছে সচেতনতা কার্যক্রম। পরিবারের সুরক্ষার ভার যেমন আপনাকেই নিতে হবে, তেমনি সামাজিক কুসংস্কার দূর করারও উদ্যোগটা নিতে হবে নিজ নিজ অবস্থান থেকে। এটা ঠিক যে রাতারাতি আপনি সমাজ বদলাতে পারবেন না, কিন্তু আস্তে আস্তে সবাইকে যদি এই ব্যাপারে আমরা সচেতন করতে পারি তাহলে সুদিন আসতে খুব বেশী দেরি হবে না। তবে চলুন দেখে নেই কিভাবে পিরিয়ড ট্যাবু ভাঙ্গতে পারি!
পিরিয়ড ট্যাবু ভাঙ্গার পদক্ষেপসমূহ
১. প্যাড কেনা
স্যানিটারি ন্যাপকিন সবার চোখের আড়ালে কেনার জিনিস না। নিজেকে পরিচ্ছন্ন রাখাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর সেজন্যই কেনা হয় স্যানিটারি ন্যাপকিন। ঠিক খাবার আগে হাত ধোয়ার মতোই পিরিয়ডের সময়ে পরিচ্ছন্নতাও যে একান্ত প্রয়োজন এটাও আমাদের বুঝতে হবে।
২. স্যানিটারি ন্যাপকিন পরিবর্তনের সময়
সব রকমের কুসংস্কার আর ট্যাবুর মধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, পিরিয়ডকালীন স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব। নোংরা কাপড় ব্যবহার, অনেকক্ষণ একটা প্যাড ইউজ করার জন্য জরায়ুর ইনফেকশন, সার্ভিক্যাল ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। তাই হাইজিনের ব্যাপারে কোন আপোষ চলবে না। তাই ৪/৬ ঘণ্টা পর পর প্যাড বদলাতে হবে।
৩. সন্তানের সঙ্গে পিরিয়ড নিয়ে কথা বলুন
সন্তান প্রশ্ন করার আগেই তার সঙ্গে কথা বলুন বয়ঃসন্ধিকাল কি, পিরিয়ড কখন এবং কেন হয়, কী কী সতর্কতা মেনে চলতে হয় ইত্যাদি। তাহলে তার যখন প্রথম পিরিয়ড হবে, তখন সে ঘাবড়ে যাবে না। সমাজকে আপনি একদিনে পাল্টাতে পারবেন না। তাই মেয়ে সন্তানের মেন্টাল স্ট্রেন্থ-এর দিকেও নজর দিন। আশেপাশের কটু কথায় সে যেন মানসিকভাবে ভেঙে না পড়ে সেভাবেই তাকে প্রস্তুত করুন। তবে কথা বলার আগে লক্ষ্য রাখবেন আপনার সন্তান এই কথাগুলো একসেপ্ট করার মতন ম্যাচিউরড হয়েছে কিনা।
৪. মেয়েকে মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রস্তুত করুন
মেয়েরা যাতে পিরিয়ডকালীন শারীরিক ও মানসিক বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে প্রিয়জনদের সাথে আলোচনা করতে পারে, সেই পরিবেশটা তৈরি করতে হবে পরিবারের সবার। মানসিক আর শারীরিক অস্বস্তির সাথে লড়াই করেও মেয়েরা প্রতিনিয়ত সমাজের সকল ক্ষেত্রেই তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।
৫. পিরিয়ড নিয়ে স্কুলে সচেতন করা
পিরিয়ডের সময়ে স্কুলগামী মেয়েরা যাতে ক্লাসে অনুপস্থিত না থাকে এবং তাদের পরিচ্ছন্নতা নিয়ে যেন কোনো আপোষ না করতে হয়, সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে বাবা-মা আর শিক্ষক-শিক্ষিকাকে। নিজেকে কিভাবে সে পরিচ্ছন্ন রাখবে, সেটাও আগে জানিয়ে দিন। স্যানিটারি ন্যাপকিনের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করাটা এখন সময়ের দাবি। স্কুলগামী কিশোরীদের সচেতন করতে ইতিমধ্যে অনেক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান কাজ করছে, সরকারিভাবেও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
পুরুষের করনীয় কী?
দায়িত্ব কি শুধুই মেয়েদের? অবশ্যই না! কিভাবে সাপোর্ট দেবেন সেটাই ভাবছেন তো?
১. স্পেশাল ফিল করান
ভাই, বাবা, স্বামীকে নিজ নিজ জায়গা থেকে বুঝতে হবে তার বোন, মেয়ে আর স্ত্রীর প্রয়োজন৷ এটা স্বাভাবিক শারীরিক বিষয় হলেও যার সাথে হচ্ছে সে কিন্তু স্বাভাবিক থাকতে পারে না। বমিবমি ভাব, পেট ব্যথা এগুলোর জন্য শারীরিকভাবে সে অস্বস্তিতে থাকে। আর সবচেয়ে বড় প্রবলেম হল মুড সুয়িং, খিটখিটে মেজাজ যেটা হরমোনের প্রভাবে হয়। ওই দিনগুলোতে তার সাথে আর্গুমেন্টে নাই বা গেলেন, ঘরের কাজে একটু হেল্প করলেন, তাকে একটু স্পেশাল ফিল করালেন, ব্যস! আপনার সাপোর্টটা ওই মুহূর্তে খুবই প্রয়োজন তার।
২. বাবার ভূমিকা
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেটা, আপনার সঙ্গী, মেয়ে কিংবা বোনের পরিচ্ছন্নতার ভার নিতে আপনিও পদক্ষেপ নিন। তার প্রয়োজন বোঝার চেষ্টা করুন। বাবাও কিন্তু তার দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারেন না। আপনার মেয়ের সাথে এই ব্যাপারে স্বাভাবিকভাবেই আলোচনা করুন এবং সে যাতে আপনার কাছে তার সমস্যা নির্দ্বিধায় প্রকাশ করতে পারে সেই পরিবেশ তৈরি করুন। দরকার হলে প্যাড কিনে আনুন, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কোন সমস্যা হলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে দেরি করবেন না।
৩. মাসিক নিয়ে তিরষ্কার নয়
“পিরিয়ড” ব্যাপারটা নিয়ে পুরুষদের মাঝে অনেকেরই তাচ্ছিল্য টাইপের মানসিকতা দেখা যায় যেটা অবশ্যই পরিহার করা উচিৎ। কিশোর বয়স থেকে যদি ছেলেদের কাছে এটা নিষিদ্ধ জ্ঞান হিসেবে আবির্ভূত হয় তাহলে বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই মানুষগুলোর আচরণ অসংবেদনশীল হয়ে যাওয়াটা অসম্ভব কিছু না। তাই ভাইও চাইলে বোনের জন্য প্যাড কিনতে পারেন। তাই এই স্বাভাবিক ঘটনাটা সহজ ভাষায় তাদেরকে বুঝিয়ে বলতে হবে। স্কুলের শিক্ষক, মা, বড় বোন এই দায়িত্বটা পালন করবেন।
পিরিয়ড কোনো রোগ বা লজ্জার বিষয় নয়। আমাদের মানসিকতা পাল্টালে সমাজও বদলে যাবে। এই বিষয়ে অহেতুক মজা নেওয়ার আগে একবার ভাববেন এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া না চললে কেউই পৃথিবীর আলো বাতাস দেখতে পেত না। শেষে একটা কথাই বলতে চাই, জানুন, বুঝুন এবং নিজের মানসিকতা পরিবর্তন করুন। পিরিয়ড নিয়ে মনের হীনমন্যতা দূর করুন আজই।
ছবি- সংগৃহীত: সাটারস্টক; মেন্সটুয়াল.কম; টাইমস অব ইন্ডিয়া