বুঝিগো সন্ধ্যার কাছে শিখেছে সন্ধ্যার মায়া
ওই আঁখিদুটি ,
চাহিলে হ্নদয় পানে মরমেতে পড়ে ছায়া ,
তারা উঠে ফুটি।
রবীন্দ্রনাথ তার দৃষ্টি কবিতায় এভাবেই বলেছেন মনের কথা গুলো। চোখ নিয়ে কাব্য, কবিতা, গান যে কত শত তার ইয়ত্তা নেই। ইংরেজীতে একটি কথা আছে , EYE SPEAK LOUDER THAN WORDS। যথার্থই, চোখ মাঝে মাঝে মুখের চেয়ে মনের কথা অনেক সহজেই বলে দিতে পারে। চোখ যে মনের কথা বলে। আমার কাছে পৃথিবীর অন্যতম একটি সুন্দর দৃশ্য হলো , কিশোরী বা তরুণী মেয়েদের জলভরা অভিমানী নয়ন। নিজে তাই কাঁদতে বসলে আয়না নিয়ে বসতাম কিশোরীকালে। কাঁদতাম আর নিজেই মুগ্ধ হতাম। অনেক কাব্য করে ফেলেছি তাইনা? কিন্তু কি করবো বলুন ? আমাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই অঙ্গটি এবং বিধাতার অন্যতম একটি উপহার হলো এই সুন্দর পৃথিবীকে দেখতে পারা। কাব্যতো তাই কিছুটা চলেই আসে। তবে আর কাব্য নয়। চলুন আজ জেনে নেই চোখের যত্ন সম্পর্কে , এর কিছু সমস্যা ও সমাধান নিয়ে।
চোখ এত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ হলেও আমরা এর যত্ন নিতে ভুলে যাই। ভাবি আলাদা করে আর কি যত্ন নেব ? অথচ অযত্নে এই চোখ গুলোর অনেক সমস্যা হতে পারে। চলুন জেনে নিই চোখের সাধারণ কিছু যত্ন।
চোখের সাধারণ কিছু যত্নঃ
০১. চোখের যত্নের প্রথম কথাই হলো চোখ ভালো ভাবে পরিষ্কার রাখতে হবে নিয়মিত। পরিষ্কার পানি দিয়ে চোখ ধুতে হবে।
০২. শরীর নীরোগ রাখতে হবে। কেননা, শরীরের অসুখ হলে চোখেও তার প্রভাব পড়ে। যেমন – ধরেন , আপনার যদি কোষ্ঠ্যকাঠিন্য থাকে তাহলে চোখে নোংরা ও কাদাকাদা রঙের জিনিস জমে। আবার জন্ডিস থাকলে চোখ হলুদ হয়ে যায়। শরীরে রক্তশূন্যতা থাকলে চোখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। আবার পানিশূন্যতা হলে চোখ বসে যায়। থাইরয়েড হরমোন এর সমস্যা হলে চোখ ফোলাফোলা দেখায়। তাই এসকল রোগ থাকলে তা দূর করতে হবে।
০৩. প্রচুর পানি পান করুন। পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান না করলে শরীরের দূষিত পদার্থ বের হতে পারেনা। এতে শরীরের দূষিত পদার্থ জমে ডার্ক সার্কেল তৈরি করে আপনার সৌন্দর্যহানি করে।
০৪. পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার খান যাতে ভিটামিন ও মিনারেল বেশি থাকে। বিশেষ করে ভিটামিন এ। এছাড়া সবুজ শাক সবজি, ফলমূল, বাদাম, ছোট মাছ, গাজর, কলিজা খাবেন বেশি বেশি করে।
০৫. নিয়মিত ব্যায়াম করুন। এতে আপনার শরীরের রক্তসঞ্চালন বাড়বে। চোখ ভালো থাকবে। হাঁটা একটি অত্যন্ত ভালো ব্যায়াম। নিয়মিত কমপক্ষে ২০ মিনিট হাঁটুন।
০৬. সম্ভব হলে বছরে একবার একজন চোখের চিকিত্সকের কাছে যান।
০৭. রোদে সানগ্লাস পড়ুন।
০৮. এলকোহল ও সিগারেট খাবেন না। কেননা সিগারেটের নিকোটিন ও এলকোহলের টক্সিন চোখের অপটিক নার্ভ কে নষ্ট করে দিতে পারে।
০৯. পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমান। দিনে কমপক্ষে ৮ ঘন্টা।
এতো গেলো চোখের সাধারণ যত্ন। এবার চোখের বিশেষ কিছু সমস্যা ও তার যত্ন নিয়ে কিছু টিপস –
ডার্ক সার্কেল বা চোখের নীচের কালো দাগ:
০১. ৩ টুকরা শশা নিয়ে চিপে রস বের করে ,রস টুকু একটা পাতলা পরিষ্কার কাপড় দিয়ে ছেঁকে নিন। এই রসে তুলা গোল করে ২ মিনিট ভিজিয়ে রাখুন। এই তুলাটি এবার চোখ বন্ধ করে চোখের উপরে ও ডার্ক সার্কেলের উপর দিয়ে ১৫ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন। এভাবে ২/৩ দিন।
০২. ১ টেবিল চামচ টমেটোর ভেতরের বিচি সহ রসের সাথে ১ চিমটি হলুদের গুঁড়া মিশিয়ে এতে আধা চামচ লেবুর রস এবং ১ টেবিল চামচ ময়দা দিয়ে একটি পেস্ট তৈরি করুন। এটি ডার্ক সার্কেলে লাগান। ভেজা তুলা দিয়ে ৩০ মিনিট পর তুলে ফেলুন। এভাবে ১ সপ্তাহ।
গর্তে ঢুকানো চোখ , বা বসা চোখঃ
০১. ১ টেবিল চামচ মধু , হাফ চামচ বাদাম তেল একসাথে মিশিয়ে প্রতিদিন শুতে যাওয়ার আগে হালকা ভাবে চোখে ম্যাসাজ করে লাগাতে হবে ১ সপ্তাহ।
০২. ৫টি কাঁচা চিনাবাদাম সারারাত ভিজিয়ে রাখুন। পরদিন পিষে ১ গ্লাস দুধের সাথে মিশিয়ে খান সকালবেলা। এভাবে ২১ দিন।
পাফি বা ফোলাফোলা চোখঃ
০১. একটি কাঁচা আলু স্লাইস করে কেটে অথবা পিষে রস ছেঁকে তুলায় নিয়ে চোখে লাগান। তুলাটি ১৫ থেকে ২০ মিনিট রাখুন। এরপর ধুয়ে ফেলুন।
০২. কাঁচা ঠান্ডা দুধে তুলা ভিজিয়ে চোখ লাগান। ১৫ মিনিট রাখুন।
০৩. ১ কাপ ঠান্ডা পানিতে কিছু ফোটা ভিটামিন ই ক্যাপসুপ দিন। তুলা এতে ৫ মিনিট ভিজিয়ে রাখুন। এরপর চোখের উপর রাখুন ২০ মিনিট।
০৪. ২টি ব্যবহৃত টি ব্যাগ ফ্রীজে রেখে ঠান্ডা করুন। এরপর বাইরে থেকে ফেরার পর এই টি ব্যাগ দুটি চোখের উপরে দিয়ে ১০মিনিট রাখুন।
কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের জন্য চোখের যত্নের কিছু টিপসঃ
বর্তমান যুগে অনেক পেশা আছে যাতে দীর্ঘক্ষণ কম্পিউটারের সামনে বসে কাজ করতে হয়। এছাড়াও যারা দীর্ঘক্ষণ টিভি দেখেন তাদের জন্য নীচের পদ্ধতি গুলো
মেনে চলা উচিত।
০১. প্রতি ২০-৩০ মিনিট পর পর কাজের ফাঁকে ফাঁকে মনিটর থেকে চোখ সরিয়ে দূরের জিনিস দেখুন। পারলে সবুজ গাছপালা দেখুন। এসময় চোখের পলক কয়েকবার ফেলুন। এটি আপনার দৃষ্টি আরো ফোকাস হতে সাহায্য করবে।
০২. চোখের পলক ঘন ঘন ফেলুন। একটানা পলক না ফেলে মনিটরে কাজ করবেন না। কেননা এতে করে Dry eye হতে পারে। মিনিটে গড়ে ১৫ থেকে ২০ বার চোখের পলক ফেলার চেষ্টা করুন।
০৩. চোখের ব্যায়াম করুন কাজের বিরতিতে। চোখের ব্যায়াম খুব সোজা। চোখের পলক ফেলুন কয়েকবার। এরপর চোখ বন্ধ করে ঘড়ির কাঁটার দিকে ও বিপরীত দিকে চোখ ঘুরান। এসময় ধীরে ধীরে গভীর শ্বাস নিন। এরপর ধীরে ধীরে চোখ খুলুন।
০৪. দুই হাতের তালু ঘষে গরম করুন। এরপর তালু দিয়ে চোখ ঢাকুন ১মিনিটের জন্য।
০৫. কাজের বিরতির সময় পানি দিয়ে চোখ ধুয়ে ফেলুন ।
০৬. একটানা অনেকক্ষণ বসে না থেকে একটু পর পর হাঁটুন ।
০৭. glare free স্ক্রীন লাগান মনিটরে অথবা glare free চশমা ব্যবহার করুন কাজ করার সময় ।
০৮. মনিটর এক হাত দূরে রেখে ও চোখের লেবেল হতে ২০ ডিগ্রী নীচে রেখে কাজ করুন।
এছাড়া চোখে অস্বাভাবিক পানি পড়তে থাকলে , লাল হলে , অতিরিক্ত চুলকানি হলে ডাক্তারকে দেখাবেন সাথে সাথে। অবহেলা করবেন না। মেয়েরা চোখের নীচের কালো দাগ ঢাকতে কনসিলার ব্যবহার করতে পারেন। ছোটদের চোখের যত্ন নিন। তাদের ভিটামিন এ খাওয়ান। ভালো থাকুন।
লিখেছেনঃ মৌসুমী
ছবিঃ এসএমএস.সিএস